ইন্টারনেট অ্যাডিকশন আগামী প্রজন্মের এক ভয়াবহ সমস্যা
ডাঃ সঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়
2019-03-29 12:09:33

স্বর্ণাভ, ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র, মাধ্যমিকে স্টার মার্কসের ওপরনাম্বার ছিল। বাবা-মা’য়ের একমাত্র সন্তান, উজ্জল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলছিল। পাঁচ-পাঁচটা প্রাইভেট টিউটর। বাবার ইচ্ছে ও বড় হয়ে একজন ডাক্তার হবে। বিগত কয়েক মাস যাবৎ স্বর্ণাভ মায়ের থেকে একটি অ্যানড্রয়েড ফোন জোর করেই আদায় করেছে। বাড়িতে থাকলেই পড়ার ঘরে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, ছাদে গেলেও ছাদের দরজা বন্ধ করে রাখে। মাঝে মাঝে কিছু বন্ধ হঠাৎ করে হাজির হয়ে একসঙ্গেই পড়ার ঘরে ঢুকে পড়ে। সবার হাতেই, মা লক্ষ্য করেছেন, একটা করে দামি মোবাইল ফোন। ছেলে, ছেলের বন্ধুরা ওই যন্ত্রুটুকু নিয়ে সারাদিন কী করে চলেছে মা বুঝতেই পারেন না। ছেলে বাবাকে বলে বাড়িতে একটা ওয়াই ফাইও লাগিয়ে নিয়েছে, জিজ্ঞেস করলে বলে, মা তুমি ওসব বুঝবে না। এখন পড়ার বই পড়ে কিসসু হবে না, ইন্টারনেটেই সব পড়াশোনা। নেট ব্যবহার না জানলে পিছিয়ে পড়তে হয়। মা তুমি কি জানো ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ব্লু টুথ, জেন্ডার এসব কি, তুমি না বড্ড সেকেলে। আমার বান্ধবী পর্ণার মা-বাব সবাই ফেসবুক করে। তোমাকে একটা ফেসবুক খুলে দেব। স্বর্ণাভ’র মা তার ব্যবসাদার বাবাকে বলতে চেষ্টা করলেও বলতে পারেন না। কেননা ওর বাবা বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে। বেশির ভাগ দিনই মুখে মিষ্ট গন্ধ, জড়ানো গলার স্বর, মেজাজা সপ্তমে চড়ে থাকে। মা একদিন সাহস করে স্বর্ণা ‘র মামাকে বলেই ফেলে, ভাই, তোর ভাগ্নেটা এবারে ইলেভেনের পরীক্ষায় খুবই খারাপ রেজাল্ট করেছে, কিন্তু পড়াশোনা তো সারাক্ষণই করে বলেই মনে হয়। পড়ার ঘরে ঢুকেই তো আছে। তবে ওর এখন একটাই সঙ্গী, একটা দামি মোবাইল ফোন। খেতে বসেও ওই আঙুল হড়কানো যন্ত্রটায় আঙুল বোলাচ্ছে সর্বক্ষণ। বললে বলে ও তুমি মা বুঝবে না। তা ভাই আজ সুমন্তবাবুর কাছে ও কেমিস্ট্রি পড়তে গেছে। উনি ওনার কোচিং-এ মোবাইল নিয়ে ঢুকতে দেন না। তাই মোবাইলটা ওর পড়ার টেবিলে পড়েই আছে। স্বর্ণাভর মামা হাতে ফোনটা তুলে নিয়ে নেট সার্চের হিস্ট্রিতে চোখ বোলায়। মামা চমকে ওঠে। সবই তো পর্ণোগ্রাফি, নয়ত ক্লাসের কোনো না কোনো বান্ধবীর হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো নানান ভঙ্গিমার ছবি। মা স্বর্ণা ‘র মোবাইল কিছুদিনের জন্য তার থেকে কেড়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকেই ছেলেটি মানসিকভাবে ক্রমশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাগ, উত্তেজনা, অমানোযোগিতা, নিজেকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে আরও একা হয়ে পড়ে। অগত্যা স্বর্ণাভকে নিয়ে তার বাবা-মা ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে সচেষ্ট হন। এই বিষয়টাকেই ডাক্তারি পরিভাষায় কেউ বলছেন মোবাইল ম্যানিয়া, কেই বলছেন ইন্টারনেট অ্যাডিকশন। সংক্ষেপে এই ইন্টারনেট অ্যাডিকশনের বিপদ সংকেত বা ওয়ানিং সাইন এটাই।
যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা বিশেষত বয়ঃসন্ধির ছাত্র-ছাত্রীরা যারা তথাকথিত আধুনিকতার নামে চলতি হাওয়ায় নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিয়ে সাজপোশাক, আচার-ব্যবহার, বাবা-মা-গুরুজন-শিক্ষক এমনকী বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গেও নিজস্বতা নিজেদেরই অনেক বিপদ ডেকে আনছে, নিজেরই অজান্তে। ইন্টারনেটের এই আসক্তি তাদেরই মধ্যে বেশি দেখা যায় মূলত যারা পূর্বেই কিছু রোগে আক্রান্ত, অথবা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, স্কুল-কলেজের আবহাওয়া সর্বোপরি সামাজিক পরিস্থিতি এই নেশার দিকে ঝুঁবে পড়ার বিপদ বাড়িয়ে দেয়।
এই ব্যাধিতে আমাদের সমাজ ক্রমশ আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে।
- পিতা-মাতার উচিত সন্তানের সঙ্গে আরও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করা।
- অভিভাবকের নিজের সামর্থের বাইরে গিয়ে সন্তানের সমস্ত চাহিদা মোটবার চেষ্টা না করা।
- পিতা-মাতার চরিত্র, সামাজিক মূল্যবোধ, দায়িত্বসচেতনতা সন্তানের চরিত্র গঠনে সাহায্য করে।
- পড়তে বসে পাশে মোবাইল না রাখাই উচিত। এতে ছাত্রের মনঃসংযোগের বিঘ্ন ঘটে।
- বাড়িতে থাকাকালীন সন্তানের মোবাইলটা বাবা-মা’ও যেন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন।
- বাড়িতে, পাড়ার অথবা স্কুলের বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে বাবা-মা’য়েরও ন্যূনতম যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন।
- সন্তান যে কোনো নেশায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই পিতা-মাতার উচিত প্রথম দিনই যথেষ্ট শাসন করা।
- প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য পিতা-মাতার সম্মান করা। যে সন্তান তার গর্ভধারিণী মায়ের মনে শান্তি দিতে পারে না সে নিজে কখনও শান্তি পেতে পারে না।
-
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন