গরমে চর্মরোগের বাড়াবাড়ি
ডাঃ শান্তনু মুখার্জি
2019-03-29 15:44:15

প্রত্যেক সুস্থ মানুষের শরীর গরমে ঘামতে থাকে। ত্বকের ওপরদিকে ছোট ছোট ঘর্মছিদ্র বা সোয়েট পোর আছে। এই ছিদ্রগুলো দিয়ে ঘামের ওপর বেরিয়ে আসে এবং বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে যায়। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ত্বকের প্রায় ৩০ লক্ষ ঘর্মগ্রন্থি থাকে।
ঘামের শতকরা ৯৯ ভাগই জল। বাকি এক ভাগের মধ্যে থাকে নানা ধরনের লবণ, অ্যাসিড, ইউরিয়া, প্রোটিন, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি।
ঘাম হওয়ার কারণে আমরা খুব বিরক্তবোধ করি বটে কিন্তু দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, দেহে জলের পরিমাণ ঠিক রাখা, ত্বককে আর্দ্র রাখা, রোগজীবাণু প্রতিরোধ, অ্যাসিড ও ক্ষারের সমতা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি অনেক কিছুই করে এই ঘাম। ঘামের পরিমাণ কমে গেলে নানা ক্ষতিকর পদার্থ দেহে জমে থাকে, বার হতে পারে না, অস্বস্তি শুরু হয়, ত্বকের স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হয়।
অনেকে বেশি ঘাম হওয়াকে অসুখ মনে করেন। না, এটা কোনো অসুখ নয়। তাই কোনো ওষূধ খেয়ে ঘাম কমাবার চেষ্টা না করাই ভালো। এমনকী ঘাম নিবারণের জন্য বাজার থেকে কোনো পাউডার, লোশন, ক্রিম কিনে এনে ব্যবহার করাও উচিত নয়। কারণ এগুলো ঘর্মগ্রন্থির মুখগুলোকে বন্ধ করে দেয় ফলে ওখানে কোনো ফোঁড়া বা ঘামাচি হতে পারে।
ঘামের গন্ধ
অনেকের ঘামে বেশ দুর্গন্ধ হয়। এই দুর্গন্ধের জন্য এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়াই দায়ী।
দুর্গন্ধ দূর করতে কোনো সুগন্ধি ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করা যেতেই পারে। এগুলোর মধ্যে ব্যাক্টেরিয়ানাশক
নানা রাসায়নিক মেশানো থাকে। আর ঘাম যাতে কম হয় তার জন্য গরমকালে ঠান্ডা জলে ওডিকোলন
ফেলে স্নান করতে পারেন। এতে শরীর ঠান্ডা হওয়ার সাথে সাথে ওডিকোলনের মিষ্টি গন্ধ শরীরে
লেগে থাকবে।
নিজের শরীর সবসময় পরিষ্কার রাখবেন। ঘাম বসতে দেবেন না। অ্যান্টি ফাঙ্গাল বা অ্যান্টি
ব্যাক্টেরিয়া সাবান ব্যবহার করলে যথেষ্ট উপকার পাওয়া যায়।
ত্বকের রঙে বিপর্যয়
ত্বকের স্বাভাবিক রঙের দায়ী মেলনিন নামক এক প্রকার রঞ্জক বা পিগমেন্ট যা ত্বকের মেনোনোসাইট কোষ থেকে তৈরি হয়।
অতিরিক্ত সূর্যালোক থেকে ত্বকে বেশি বেশি মেলানিন তৈরি হয়। এর ফলে ত্বকে ঘন বাদামি ছোপ পড়ে। দেহের আঢাকা অংশে মেলাসমা বেশি হয়। গরমকালে এটা বাড়ে।
রোদে বার হলে ত্বকে হাই পাওয়ার এস.পি.এফ-১৫/৩০ সানস্ক্রিণ লোশন বা সানব্লক ব্যবহার করুন। দয়া করে কত পাওয়ারের সানস্ক্রিন আপনার লাগবে সেটা অবশ্যই জেনে নিন একজন ডার্মাটোলজিস্টকে দেখিয়ে। নিজে নিজে অ্যাপ্লাই নয়। সাথে রাখুন ছাতা । কোনো কড়া সাবান, ক্লেনজার, অতিরিক্ত প্রসাধন ব্যবহার করবেন না। যদি তাতেও না কমে চিকিৎসা আছে, অবশ্যই ডাক্তারবাবুকে জানান। সুফল পাবেন।
ঘামাচি
গ্রীষ্মকালে আর একটি কমস সমস্যা হল ঘামাচি। ঘামাচির সমস্যায় কম-বেশি সকলেই ভুগে থাকেন। শরীরে ক্রমাগত ঘাম ঘর্মনালীর পথ বেয়ে বেরোতে না পারে তবে সেই ঘামগুলো ঘর্মনালীর মুখে জমে জমে একসময় ফেটে যায় এবং বাইরের ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ত্বকের ওপর ছোট ছোট দানার মতো সৃষ্টি হয়। এগুলোকে বলে ঘামাচি। শরীরে এইসময় অস্বস্তি, চুলকানি হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে মিলিয়ারিয়া বলে। টাইট ফিটিং পোশাক কিংবা সিস্থেটিক পোশাক যদি গরমকালে কেউ পরে তবে ঘাম বসে ঘামাচি হতে পারে।
ঘাম যাতে কম হয় তার জন্যে দিনে দু’বার স্নান করতে হবে। মশলা জাতীয় জিনিস কম খেলে ঘাম কম হয়। এ সময় নুন ও চিনির জল খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। তবে রাস্তার নয়, সেই জলটা বাড়িতে তৈরি করে খেতে হবে। ঘামাচিগুলোকে নখ দিয়ে বেশি চুলকালে বিষিয়ে গিয়ে ঘা হতে পারে। ঘামাচির কারণে ল্যাক্টোক্যালামাইন, জেন্টামাইসিন জাতীয় লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। শরীরে যাতে ঘাম না জমে সেজন্য সুতির পোশাক গ্রীষ্মকালে পরা উচিত। যাদের সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরতে হয় তারা সাথে একটা অতিরিক্ত জামা রাখুন যাতে ঘামে ভিজে গেলে বদলে নিতে পারেন। যাদের সুগার বেশি, যারা বেশি মোটা, ঘাম তাদের বেশি হয়। ফলে গরমকালে তাদের ঘামাচি থেকে ফোঁড়া হওয়ার প্রবণতা থাকে যারা একটু আন-হাইজিনিক তাদেরও ঘাম বেশি হয়ে ঘামাচি, ফোঁড়া হওয়ার প্রবণতা থাকে। গ্রীষ্মকালে ব্যাক্টেরিয়ার সমস্যায় ঘাম হয়ে জামাতে হলদেটে দাগ হয়। এর জন্য অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়া লোশন ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
ফাঙ্গাল সমস্যা দাদ-ছুলি
ঘাম থেকে আমাদের শরীরে ফাঙ্গাল বৃদ্ধি পায়। ফাঙ্গাল তিন ধরনের হয়। এক, ডার্মাটোফাইট ফাঙ্গাস, যেটার কারণে দাদ হয়। দুই, ছত্রাক জাতীয়। হাতের আঙুল, পায়ের আঙুলের ভাঁজে দেখা যায় আর একটা মেলাসামিয়া। এটা ইস্ট জাতীয়। এর কারণে ছুলি হয়।
এই ফাঙ্গাসগুলোর সবকটাই আমাদের শরীরের ঢাকা জায়গায় বেশি হয় এবং গরমে বাড়ে। ডার্মাটোফাইট অর্থাৎ দাদ জাতীয় যেগুলো সেগুলো ঘাম থেকে বেশি হয়। কুচকিতে, বগলে, মেয়েদের কোমরে, ভারিস্তনের নীচে, শরীরে চাপা জায়গায় দেখা যায়।
ফাঙ্গাস ক্যানডিডা অর্থাৎ ছত্রাক জাতীয় যেটা, সেটা পায়ের আঙুল ঘাম বসে বসে হয়। সুতির মোজা পরা উচিত। মোজা পরার আগে একটু পাউডার ছড়িয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। এছাড়া অ্যান্টি ফাঙ্গাস লোশন লাগানো যেতে পারে ডাক্তারের পরামর্শে।
ইস্ট জাতীয় ফাঙ্গাস থেকে ছুলি হয়। গ্রীষ্মকালে এটা বেড়ে যায়। সাদা দাগের মতো হয়। গরমে যাতে ঘাম না হয় তার জন্য সুতির হালকা ধরনের জামা-কাপড় পরা উচিত। একটু তো ছোয়াচে বটেই তাই তোয়ালে বা গামছা আলাদা রাখাউচিত। ছুলিতে সেলেনিয়াম সালফাইড লোশন, কিটোকেনোজল ক্রিম, স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ইত্যাদি লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
প্রতিরোধ
প্রথমে দেখতে হবে ঘামাচিকে কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়? শরীরটাকে ঠান্ডা রাখতে হবে। তার মানে যারা খুব ঘামে তারা বেশি ঢাকা জামা, টাইট জামা, সিন্থেটিক ড্রেস পরা থেকে দূরে থাকবে। পোশাক হবে সুতির এবং হালকা রঙের। বেশি ডিপ কালার হলে সূর্যের আলো অ্যাবজর্ভ করবে বেশি। যারা বেশি ঘামে তারা বেশি ফাঙ্গাস ও ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে ভোগে।
ঘামটা কীকরে কমানো যায়? প্রথমত যাদের বেশি ওজন তাদের ওজন কমাতে হবে। যারা খুব গরমে কাজ করছে তারা একটু খোলামেলা জায়গায় কাজ করলে ভালো। যারা সকালবেলায় বেরিয়ে রাতে ফেরেন তারা যদি কোনো এক সময় শার্টের ভেতরের গেঞ্জিটা চেঞ্জ করে নেন তাহলে ভালো হয়। আসলে ঘামে ভেজা গেঞ্জি পরে পরেই নানারকম ব্যাক্টেরিয়াল ফাঙ্গাস তৈরি হয়। দাদ বা ছুলি এভাবেই বাড়ে।
গরমে এমন খাবার খাবেন না যা শরীরের মেটাবলিজস বাড়িয়ে দেয়। যত সহজপাচ্য খাবার খাওয়া যায় ততই ভালো।
যারা বাইরে রোদে বেরোচ্ছেন ঘামের জন্য তারা অ্যান্টি ফাঙ্গাস পাউডার ব্যবহার করতে পারেন। এসব করলে ফাঙ্গাস ইনফেকশন থেকে বাচা যায়।
অনেক সময় লোকে কাগজ পড়ে, টি.ভি দেখে ডাক্তারি লোশন বা মলম ব্যবহার করেন। এগুলো ব্যবহারের আগে কোনো একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবুর সাথে কনসাল্ট করা উচিত। নিজেরা না জেনে ব্যবহার করার ফলে আরো বেশি শারীরিক সমস্যায় সৃষ্টি হয় অনেক সময়।
ঘরোয়া চিকিৎসা বলতে ঠান্ডা জলে স্নান, ঠান্ডা জায়গায় থাকা, জামাকপড় সুতির ব্যবহার করা, ল্যাক্টো ক্যালামাইন ধরনের লোশন ব্যবহার, সহজপাচ্য খাবারকেই বোঝায়। বাড়ির মা-বউরা সকাল সকাল রান্না সেরে নেবেন, বেশি চড়া রোদে গরমের মধ্যে রান্নাঘরে না থাকাই ভালো। খুব বেশি দরকার না পড়লে দশটা থেকে তিনটে অবধি বাইরে না বেরোনাই দরকার।
চিকিৎসকের কাছে কখন যাবেন
সাবধানতা মতো এত কিছু করার পরেও কিছু হচ্ছে না, ইনফেকশন হচ্ছে, ঘামাচি-দাদ-ছুলিতে কষ্ট পাচ্ছেন তখন ডাক্তারবাবু কাছে যাওয়া অবশ্যই দরকার। ডার্মাটোফাইট ইনফেকশন, ফাঙ্গাল ইনফেকশন কিংবা ফোঁড়া হলে, এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে হবে। অ্যান্টি ফাঙ্গাল সোপ বা অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়া সোপ ব্যবহার করলে কিছুটা রিলিফ পাওয়া যায়। অনেকের ধারণা তেল মাখলে স্কিন ভালো থাকবে, আসলে তা কিন্তু নয়। গরমের সময় তেল না মাখাই ভালো। এতে ঘর্মগ্রন্থির মুখগুলো আটকে যায়। ফাঙ্গাল ইনফেকশন তো বাড়েই, ব্যাক্টেরিয়া ইনফেকশনও বেড়ে যায়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন