জরায়ু-মুখের ক্যানসার প্রতিরোধ যোগ্য
ডাঃ অবিনাশ চন্দ্র রায়
2019-04-23 11:45:01

কেন হয় জরায়ু-মুখের ক্যানসার
চিরাচরিত ধারণা ছিল ২০ বছর বয়সের নীচে বিয়ে, যৌন সহবাস এবং সন্তান ধারণ, বেশি সংখ্যার সন্তান প্রসব, নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জরায়ু মুখে ঘা ইত্যাদি জরায়ু-মুখ ক্যানাসরের অন্যতম কারণ। এছাড়াও যৌন রোগাক্রান্ত মহিলা অথবা যে মহিলার যৌন সহবাসের সঙ্গী বেশি অথবা সেই মহিলার স্বামীর যদি যৌনসঙ্গী বেশি থাকে তাহলেও মহিলার জরায়ু-মুখ ক্যানাসরের সম্ভাবনা বাড়ে। শুক্রাণুর মধ্যে যে নিউক্লিক অ্যাসিড থাকে তা-ও জরায়ু-মুখ ক্যানাসরের কারণ হতে পারে যদি মেয়েটির বয়স হয় ২০ বছরের নীচে। এই জন্য সন্ন্যাসিনী অর্থাৎ যারা সহবাসে অভ্যস্ত নন, তাদের মধ্যে এই রোগ দেখা যায় না।
কিন্তু বর্তমানে হিউম্যান প্যাপিলোম ভাইরাস (HPV) অর্থাৎ এইচ.পি.ভি-কে এই ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয়। প্রতি ১০ জন মহিলার মধ্যে ৮ জনই জীবদ্দশায় এই ভাইরাস সংক্রমণের কবলে পড়ে। যদিও বেশিরভাগ এইচ.পি.ভি সংক্রমণ আপনা থেকে নিরাময় হয়ে যায় মানুষের শরীর সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতার জোরে। কিন্তু কিছু কিছু এইচ.পি.ভি টাইপ পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। যার ফলে জরায়ু-মুখ অর্থাৎ সারভিক্স, যোনি, ভালভা ইত্যাদিতে দীর্ঘদিন থাকে এবং এর জন্য ক্যানসার অথবা ওয়ার্ট-এর সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে যে মোটামুটি ১০০-এর বেশি ধরনের এইচ.পি.ভি ভাইরাসের জন্য সংক্রমণ হতে পারে। এর মধ্যে ৩০টিরও বেশি টাইপ মহিলার শরীরে প্রজনন অঙ্গে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এইচ.পি.ভি সংক্রমণ সহজেই যৌন সহবাস দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে। সাধারণত এইচ.পি.ভি ১৬, ১৮, ৩১, ৩৩ এবং ৪৫ এই পাঁচ ধরনের ভাইরাস জরায়ু-মুখ ক্যানসার সৃষ্টি করে। তাই ওই ভাইরাসগুলি বেশ বিপজ্জনক। মোটামুটি ৯০ শতাংশ ক্যানসার সৃষ্টি করে ওই পাঁচ ধরনের ভাইরাস।
এই রোগের লক্ষণ
ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার প্রথম দিকে এই রোগের কোনও লক্ষণ নাও থাকতে পারে। পরবর্তীকালে গন্ধযুক্ত এবং রক্তমাখা অতিরিক্ত স্রাব হয়। অনিয়মিত রক্তস্রাব এই রোগের একটি প্রধান লক্ষণ। যৌন সহবাসের পর রক্তস্রাব অথবা মলমূত্র ত্যাগের পর রক্তস্রাব এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। ঋতুচক্রের মাঝামাঝি যেকোনো সময়ে রক্তস্রাব এই রোগের ব্যাপারে সন্দেহের কারণ। শ্রোণির ভিতরের স্নায়ু এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য ব্যথা হয়। এই রোগ বেশি বিস্তার লাভ করলে কোমরে বেশি ব্যথা হয়। ওজন কমে যাওয়া, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া, রক্তাল্পতা ইত্যাদি এই রোগ বেশি বিস্তার লাভ করলে হতে পারে।
এই রোগের চিহ্ন
যোনির ভিতর পরীক্ষা করলে দেখা যাবে জরায়ু-মুখে ঘা। এই ঘা আঙুল দিয়ে ছুঁলে সহজেই রক্তক্ষরণ হয়। ক্যানসারের পরবর্তী পর্যায়ে এর চেহারা অনেকটা ফুলকপির মতো দেখতে হয়।
চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ
জরায়ু-মুখ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। চাই এ বিষয়ে সচেতনতা। একটা বিষয়ে সচেতনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে ক্যানসার রোগ হওয়ার আগে অন্তত ১৩ থেকে ২০ বছর সময় ধরে তা থাকে প্রি-ক্যানসার পর্যায়ে। এই প্রি-ক্যানসার পর্যায়ে যাতে এই রোগ ধরা পড়ে তার জন্য দরকার ক্যানসার স্ক্রিনিং। মানে মাঝে মাঝে মহিলার জরায়ু-মুখ পরীক্ষা করে দেখা এবং প্যাপস্মিয়ার করে পরীক্ষা করা। প্রি-ক্যানসার রোগ ধরা এবং তার জন্য যথাযথ চিকিৎসাই হল ক্যানসার প্রতিরোধের যথাযথ হাতিয়ার। প্রি-ক্যানসার পর্যায়ে চিকিৎসা করলে আর ক্যানসার হওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। দেখা গেছে উন্নত বিশ্বে শুধুমাত্র ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্যাপস্মিয়ার টেস্ট করেই প্রায় ৮০ শতাংশ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে এবং এই ক্যানসারের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ মৃত্যু এড়ানো গেছে। এছাড়াও জরায়ু-মুখ ক্যানসার প্রতিরোধে প্রয়োজন ২০ বছরের আগে বিবাহ এবং যৌন সহবাস না করা। পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই যৌনাঙ্গ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। প্রথম সন্তান ২০ বছর বয়সের পর হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনই সন্তান সংখ্যা এক বা দুইয়ের মধ্যে সীমিত রাখাও জরুরি। সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক অবস্থায় উন্নতি বিশেষ প্রয়োজন। ৩৫ বছরের পর প্রত্যেক মহিলার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বার ক্যানসার স্ক্রিনিং পরীক্ষা এবং প্যাপস্মিয়ার টেস্ট করা উচিত কিছুদিন বাদে বাদে।
ক্যানসার ভ্যাকসিন
একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর আবিষ্কার হল এইচ.পি.ভি ভ্যাকসিন। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি, পোলান্ড এই টিকা জাতীয় টিকাকরণ সূচিতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে সেটা সম্ভব হয়নি মূলত এর দামের জন্য। প্রতিটি টিকার দাম প্রায় ২৫০০টাকা এবং নিতে হবে তিনটি। প্রথম বার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর দ্বিতীয়টি নিতে হবে এক থেকে দু’মাসের মধ্যে এবং তৃতীয়টি ছ’মাসের মাথায়।
এই টিকা ১১-১২ বছর বয়স থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া যায়।
ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা
এই রোগের জন্য চিকিৎসা করা হয় তা হল শল্য চিকিৎসা, রেডিওথেরাপি, শল্য চিকিৎসা ও রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপি। কোন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে তা নির্ভর করে রোগীর সাধারণ স্বাস্থ্য ও শল্য চিকিৎসা বা রেডিওথেরাপির সুযোগ সুবিধার ওপর। এছাড়াও রোগের পর্যায়ের ওপরও নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন