অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড আসক্তি ডেকে আনছে ডায়াবেটিস?
ডাঃ জয়ন্ত ব্যানার্জি
2019-01-25 16:24:13

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের জীবন হয়ে পড়েছে একেবারে জেট গতির।আর এই জেট-যুগ পঞ্চ ব্যঞ্জনের দিন শেষ।রান্না ঘরে ঢোকার সময়ের অভাব, তাই খাবার-দাবারেও এসেছে চটজলদি-ভাব।সেই কারণে আমাদের খাবার-দাবার ঢুকে পড়েছে ফাস্ট ফুড।
ফাস্ট ফুড খাবার প্রবণতাই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ফাস্ট ফুডের দোকান গড়ে উঠতে সাহায্য করছে।
ফাস্টফুড বলতে অর্ডারের সাথে সাথে চট জলদি যে খাবার সার্ভ করা যায় যেমন রোল, চাউমিন, মোমোবার্গার, স্যান্ডউইচ, বিরিয়ানি কাটলেট ইত্যাদি।
ফাস্টফুড খাবার প্রবণতা এখন অল্প বয়সী ছাড়িয়ে বড়দের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।যদিও শতকরা হিসাবে দেখলে অল্পবয়সী ছেলে মেয়েরাই এর বেশি ক্রেতা।বাবা-মায়েরাও ছেলে মেয়েদের ফাস্টফুড কিনে দেন তাদের খুশি করার জন্য, বায়না সামলাতে।বাড়িতে মায়েদেরও জলখাবারের জন্য হ্যাপা পোয়াতে হয়না আর ছেলে মেয়েরাও মন পসন্দ জিনিস পেয়ে খুশি থাকে।
বর্তমানে বেশি জনপ্রিয় হ্যামবার্গার হটডগ, চিকেনের নানাপদ, ফ্রেঞ্চফ্রাই, পট্যাটোচিপস তার সঙ্গে কোল্ড ড্রিষ্কস।এগুলো সবই আমেরিকা থেকে আমদানি।প্রত্যেকটার মধ্যে রয়েছে ফ্যাট ও শর্করা।এগুলো অতিরিক্ত তাপে ভাজা হয়, বেশি পরিমাণে লবণ থাকে।চাউমিনে থাকে আজিনামোটো যা খাবারকে সুস্বাদু করে।
ফাস্টফুডের মাধ্যমে ফ্যাট ও প্রোটিন শরীরে জমতে শুরু করে।ফলে দেখা দেয় মেদের আধিক্য।স্বাস্থ্যবিধি না মেনে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা তেলসুদ্ধ খাবার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়।ট্রাইগ্লিসারাইডের আধিক্য ঘটে।ডালডা ব্যবহার করা হয় বিরিয়ানি এবং অন্যান্য খাবারে, যার মধ্যে ট্রান্স ফ্যাট থাকে, যা শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক।
এই কারণে আমেরিকায় ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে মেদ বৃদ্ধির ব্যাপক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন সরকার ধীরে ধীরে ফাস্টফুডের ওপর রাশ টানতে শুরু করেছে।এতে ওই সমস্ত সংস্থা গুলো বিপদের মুখে পড়ছে এবং তারা এখন আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে তাদের ব্যবসা জমতে শুরু করেছে।আর আমরা মূর্খের মতো সাদরে ম্যাকিডোনাল্ড, ডোমিনি, কেভিপি, পিৎজাহাটকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছি নিজের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যকে বরবাদ করে।সুতরাং আপনার কাউকে কিছু বলার নেই, কেউ শুনবেনা আপনার কথা।
যে সমস্ত ফাস্টফুড সেন্টার চলে সেখানকার কোয়ালিটি দেখার মতো কোনো দপ্তর আমাদের শহরে নেই।তাই চিকেন রোল তৈরি হয় মরা মুরগির মাংস দিয়ে, লাল কুমড়ো থেকে বানানো হয় টম্যাটো শস, ফাটা, পচা ডিমে তৈরি হয় এগ রোল, চিকেন মোমো তে মুরগির ছাল।এগুলো থেকে তৈরি খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে মারাত্মক রোগ জীবাণু বাসা বাঁধে, ফলে অরেক সময়ই আমরা দেখি ফুড পয়জনিং ।কারণ মারাত্মক রোগ জীবাণু রান্নার পরেও সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়না। দূষিত কাঁচামাল দিয়ে তৈরি খাবার যতই মুখরোচক হোক তা থেকে কলেরা, ডায়রিয়ার মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হতে পারে।বহুক্ষণ কাটা কাঁচা স্যালাড, ভালো করে না ধোওয়া সবজি বিপদ ডেকে আনে যখন-তখন।অনেক সময় আমরা ময়দার মধ্যে পোকা হতে দেখি, সেগুলো ঠিক মতো চেলে নেওয়াও হয়না।বহুদিনের পুরনো দই, বাসি মাংস থেকে ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন হয়।অনেক সময়ই এইসব খাবার দীর্ঘদিন ধরে খাওয়ার ফলস্বরূপ স্নায়ুরোগ, পক্ষাঘাত, কোলনের অসুখ হওয়া অসম্ভব নয়।দিন দিন যে ক্যানসার বাড়ার প্রবণতা তার একটা কারণও কিন্তু বেশি দিন ধরে ফাস্টফুড খাওয়া।
আগে আমাদের দেশে জলখাবার বলতে রুটি-সবজি, মুড়ি-বাদাম, দুধ-মুড়ি, চিঁড়েভাজা ইত্যাদি ছিল। এখন অবস্থা বদলে গেছে।মায়েরা অত খাটা খাটনির মধ্যে যেতে চাননা।চটজলদি চাউমিন বা নুডুলস কিংবা বার্গার হটডগ দিয়ে দেন কিংবা মাসে একবার প্রতিটি বাচ্চার চেক-আপ এসব তো কল্পনার মতো।
যে ধরনের ফাস্টফুডে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি তাতে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ান, জিষ্ক, আয়োডিন প্রভৃতিতে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে অল্পবয়সী ছেলে মেয়েদের। এতে করে ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের ঘন ঘন পেটের অসুখ, হাত-পায়ের পেশিতে ব্যথা, সবকিছুতে উৎসাহের অভাব, ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা এইসব কুফলই আমাদের জনসচেতনতার অভাব।
ভবিষ্যতে ফাস্টফুডের দৌলতে একটি পঙ্গু সমাজ গড়ে উঠতে চলেছে এমন আশষ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে শিশুদের মধ্যে জুভেনাইল ডায়াবেটিসের কথা শোনা যাচ্ছে।প্রায় তিন কোটি শিশু এই রোগের শিকার।শুধু এই রোগ নয়, অত্যধিক ফাস্টফুডের অভ্যাস, মানসিকচাপ, খেলাধুলো করার প্রবণতা না থাকায় শিশুরা নানান রোগের শিকার হচ্ছে।
সনাতন জীবন ধারাকে পুরোপুরি বাতিলনা করে বর্তমান জীবন ধারার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে।খাদ্যাভ্যাসে রাশ টানতেই হবে।রোজকার খাবারে সবজি বিশেষ করে ফাইবার জাতীয় সবজি এবং টাটকা ফল ও স্যালাড রাখতে হবে।এমনি পাউরুটির জায়গায় ব্রাউনব্রেড স্যান্ডউইচে টম্যাটো, শশা ব্যবহার করা উচিত।রঙ করা খাবার, কথায় কথায় ফাস্টফুডের খাদ্য সসম্ভারে আপনার সন্তানকে কখনোই অভ্যস্থ করে তুলবেননা।
এক-আধ দিন ফাস্টফুড চলতেই পারে। তা বলে রোজকার জীবনে ভালোবেসে খাইয়ে নিজের সন্তানের ক্ষতি হতে দেবেন না।ছোট থেকেই তা কে ফাস্টফুডের কুফল সম্বন্ধে সজাগ করুন।
মায়েরা নিজেরাও সময় বাঁচাতে রেডিমেড কুকের প্যাকেট এনে বাড়িতে রান্না করবেন না।কারণ এগুলো প্রিজার্ভ করার জন্য যে নুন ব্যবহার করা হয় তা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সরকারের উচিত নিয়মিত ফাস্টফুড সেন্টারগুলো কতটা হাইজিন মেনে চলছে সেগুলো আচমকা পরীক্ষা করা।স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা রিসার্চ অ্যানালিসিস ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তোলা। তবে মানুষকেও নিজে থেকে সচেতন হতে হবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন