নাক ডাকা: প্রাণ ঘাতী হতে পারে
ডাঃ দেবাশীষ মুখার্জী (বিশিষ্ট ই.এন.টি বিশেষজ্ঞ, নাইটিঙ্গেল হাসপাতাল)
2019-01-31 15:13:50

অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়া বা ও.এস.এ যাদের থাকে তাদের নাক ডাকার সঙ্গে আরও নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। শ্বাসনালীর ওপরের অংশের আংশিক প্রতিবন্ধকতা থাকলে এইরোগ দেখা যায়। এক্ষেত্রে শ্বাস নেবার প্রক্রিয়ায় কিছু ক্ষণের জন্য শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এই শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াকে ‘অ্যাপনিয়া’ বলে।গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ২৪ জন পুরুষ এবং ১৪ জন মহিলা নাক ডাকেন। ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে পুরুষদের মধ্যে নাক ডাকা এবং ও.এস.এ-র আধিক্য থাকে। ৫০ বছরের পরে তা আরও বাড়ে।
বেশি বয়সের পুরষ যাদের ওজন বেশি, যারা মদ্যপান করেন বা ঘুমের ওষুধ খান তাদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি।
ও.এস.এ অনেকাংশে নির্ভর করে প্রত্যেক মানুষের খুলির গড়নের ওপর। নাকের ভিতর বা মুখের ভিতরের অংশ কোনো কারণে সরু হয়ে থাকতে পারে। বাতাস যাওয়ার পথ সরু থাকলে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অতিরিক্ত জোর দিতে হয়। এইভাবে জোর করে শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার ফলে বাতাস যাওয়ার পথ পরক্ষণেই বেশি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। বারবার এই ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার ফলে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যায় এবং বুকের মধ্যের বাতাসের চাপ মারাত্মক ভাবে কমে যায়।
এক মূহূর্তের জন্য যখন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তখন শ্বাসের সঙ্গে বাতাসের চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে তখনকার মতো রক্ত চাপ বেড়ে যায়।
বুকের মধ্যে বাতাসের চাপ কমে গেলে ঘুম ভেঙে যায় এবং রোগী তখন খুব জোর শ্বাস নিয়ে ওই কম চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন খুব জোর আওয়াজ করে শ্বাস নিতে হয়। এইরোগে আক্রান্ত মানুষের দিনের বেলায় ঘুম পায়। কোনো জরুরি মিটিং করতে করতে হয়তো ঘুম পেয়ে গেল এমনকী গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তাহলে এর বিপজ্জনক দিকটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।
এক্ষেত্রে হার্ট কে যেহেতু বেশি কাজ করতে হয় তাই রক্তচাপ বাড়তে পারে এবং হার্ট বড় হয়ে যায়।
এই রোগে আক্রান্ত মানুষ সামাজিক ভাবে এবং মেধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে পারে। বিদেশে এই রোগে আক্রান্ত মানুষের অতিরিক্ত নাক ডাকার কারণে ডিভোর্স অবধি হয়। তাছাড়া দিনের বেলায় ঘুমিয়ে পড়ার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।
উপসর্গ
- নাক-ডাকা—শ্বাসনালীর ওপরের অংশের প্রতিবন্ধকতার ফলে ভীষণ জোরে নাক ডাকে। এই নাক ডাকার সঙ্গে ব্যাপক কম্পন হয়। বিছানায় থাকা সঙ্গী এই প্রক্রিয়া ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারে। কখনো কখনো এমনও মনেহয় যে রোগী এখনই শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবেন। ঘড় ঘড় করে মুখ দিয়ে আওয়াজ হয়। অনেক সময় সঙ্গী ভয় পেয়ে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
- দিনের বেলায় ঘুম---রোগী দিনের বেলায় যখন তখন ঘুমিয়ে পড়তে পারে। টিভি দেখতে দেখতে বা বই পড়তে পড়তে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো জরুরি মিটিং কিংবা বসের সামনে বসে জরুরি বিষয় আলোচনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লে কী সমস্যা হতে পারে তা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন। সব থেকে মারাত্মক এইসব রোগী যখন গাড়ি চালান বা মেশিন চালান, এ সময়ে ঘুমিয়ে পড়লে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
- সকালে মাথা ব্যথা—এরকম রোগীদের সকালের দিকে মাথা ব্যথা হয়। বেলা বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে মাথা ব্যথা কমে যায়।
- মেধা কমে যায়---এইসব রোগীদের মেধা ক্রমশ কমে যায়। স্মৃতি শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। হঠাৎ দেখলে খুব চেনা লোকের নাম মনে করতে পারেনা বা কোন জিনিস কোথায় রেখেছে তা মনে করতে পারেনা।
- ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন—এই রোগীদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। আগে নিজের মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস থাকত তার ঘাটতি দেখা দেয়।
- অস্বাভাবিক অঙ্গ সঞ্চালন—ঘুমের সময় এমন রোগীদের হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করে। এতে শয্যাসঙ্গীর ঘুমের খুব অসুবিধা হয়।
- ঘন ঘন প্রস্রাব—রোগী রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব করতে যাওয়ায় ঘুম কখনোই গাঢ় হয়না।
- যৌন অক্ষমতা—রোগীদের যৌন ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসে এবং দীর্ঘদিন এই রোগে ভুগলে যৌন অক্ষমতা দেখা যায়।
- স্থূলতা---রোগীদের বেশির ভাগই ওজন বেশি থাকে। দেখা গেছে স্বাভাবিক ওজনের শতকরা বিশ শতাংশ ওজন বেশি হলে এই রোগ দেখা যায়। এক্ষেত্রে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া দরকার।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
প্রথমে রোগীর কাছ থেকে তার অসুবিধা গুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া হয়। রোগীর উচ্চতা ও ওজন মাপা হয়। দেখা হয় উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশি কিনা। রক্ত চাপ মেপে উচ্চরক্তচাপ আছে কিনা দেখা হয়।নাকে বাতাস ঠিকমতো চলাচল করছে কিনা, নাকের মাঝের পার্টিশন বাঁকা কিনা, নাকে কোনো টিউমার বা পলিপ আছে কিনা, নাকের পেছনে একধরনের টনসিল—অ্যাডেনয়েড বা নাকের পেছনে কোনো টিউমার আছে কিনা দেখা হয়। তালুর পেছন দিকের পেশির কোনো দুর্বলতা আছে কিনা বা ভোকাল কর্ডের নড়া চড়া ঠিকঠাক আছে কিনা তাও দেখা হয়। এই সমস্ত অসুবিধা আছে কিনা দেখার জন্য কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন সিটিস্ক্যান বা ফাইবার অপটিকল্যারিঙ্গোস্কোপি, নাকের এন্ডোস্কোপি। এছাড়া যে পরীক্ষাটি করা দরকার হতেপারে তা হল পলিসনোগ্রাফি। ঘুমন্ত অবস্থায় এই পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষা হাসপাতালে বা বাড়িতেও করা যায়। হাইপো-থাইরয়েডিজম আছে কিনা রক্তপরীক্ষা করে তাও দেখা হয়।
প্রতিকার
- ব্যায়াম এবং খাদ্যতালিকার সাহায্যে ওজন কমাতে হবে।
- ঘুমের ওষুথ খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
- থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে উপযুক্ত চিকিৎসা করতে হবে।
- নাকের শল্যচিকিৎসা—নাকে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে শল্যচিকিৎসা করে তা ঠিক করতে হবে। যেমন নাকের মাঝের দেওয়াল বাঁকা থাকলে তা সোজা করতে হবে। নাকে কোনো পলিপ বা টিউমার থাকলে শল্যচিকিৎসা করে ঠিক করে নিতে হবে। নাকের পেছনে অ্যাডেনয়েড জাতীয় কোনো টনসিল বা টিউমার থাকলে শল্যচিকিৎসা করতে হবে।
- টনসিল বড় হওয়ার কারণে মুখের মধ্যে বাতাস যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা থাকলে শল্যচিকিৎসা করে টনসিল বার করে দিতে হবে।
- তালুর পেছনের দিকের পেশি বেশি আলগা হয়ে গেলে তা গলার পেছনের দিকের দেওয়ালে পড়ে বাতাস যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসা করে ওই পেশিকে ছোট করে দেওয়া হয়।
- কারও কারও জিভ অতিরিক্ত লম্বা হওয়ায় ঘুমের সময় জিভ পেছনের দিকের দেওয়ালে গিয়ে পড়ে। তাতে বাতাস যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়। এক্ষেত্রে লেজারের সাহায্যে জিভটা ছোট করে দেওয়া হয়।
- কোনো কারণ না পাওয়া গেলে রোগীকে সি-প্যাপ যন্ত্র ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।এক্ষেত্রে মেশিনের সাহায্যে পজিটিভ প্রেসার অক্সিজেন দিলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।
-
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন