ইউরিক অ্যাসিড সব খাবার বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই
ডাঃ সুদর্শন চক্রবর্তী (জেনারেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ)
2019-02-01 14:13:48

আমাদের শরীরে মোট বাইশটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের প্রয়োজন। এর মধ্যে চোদ্দটি দেহের মধ্যে তৈরি হয়, বাকি আটটি বিভিন্ন খাদ্য থেকে আহরণ করতে হয়। এইসব অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলোকে দেহের নানা প্রয়োজনের জন্য উপযুক্ত করে তোলা হয় এক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তী পর্যায়ে পাওয়া যায় পিউরিন। এই পিউরিন থেকে তৈরি হয় ইউরিক অ্যাসিড।
শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক মাত্রা হল ৬.৮ এম.এল. প্রতি ডেসিলিটার। এই মাত্রায় কোনো সমস্যা হয় না। এর বেশি হলেই নানান সমস্যা তৈরি হয়।
যদিও ইউরিক অ্যাসিডের নব্বই শতাংশই শরীর থেকে বেরিয়ে যায় শারীরিক নিয়মে। যখন শরীরবৃত্তীয় কারণে শরীরে খুব বেশি ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয় আর শরীর থেকে বেরোয় কম, তখনই জর্জরিত হতে হয় নানান সমস্যায়।
- গাউট: ইউরিক অ্যাসিড থেকে সৃষ্ট সব থেকে পরিচিত সমস্যা হল গাউট। ইউরিক অ্যাসিড জমা হতে হতে এক সময় জয়েন্টে ব্যথা শুরু হয়। ব্যথা সাধারণত পায়ের বুড়ো আঙুলে হয়। অবশ্য এটা যে কোনো পায়েই হতে পারে। এছাড়া পায়ের অ্যাষ্কুল, কনুইতেও হতে পারে ব্যথা। পায়ের বুড়ো আঙুলে হঠাৎ করেই শুরু হয় প্রচন্ড যন্ত্রণা, হাত ছোঁয়ানো যায় না। হাঁটার অসুবিধে প্রধানত রাতের দিকেই বেশি হয়। এমনকী ঘুম ভেঙে যায় যন্ত্রণায়, একে বলে অ্যাকিউট গাউট আর্থ্রাইটিস।
চিকিৎসা: ব্যথা কমানোর ওষুধ দিয়ে ব্যথা কমাবার আপৎকালীন ব্যবস্থা করা হয়। ব্যথা কমানোর ওষুধ পাঁচদিনের বেশি দেওয়া হয় না। বিভিন্ন ধরনের ব্যথা কমার ওষুধ থাকলেও ব্যথা কমানোর সাধারণ ওষুধই ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু অনেক রোগী আছে যাদের ব্যথার কমানোর ওষুধ দেওয়া যায় না (যেমন আলসার বা অন্য সমস্যা)। সেক্ষেত্রে নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগস (এন.এস.এ.আই.ডি) দেওয়া হয়। অর্থাৎ স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। প্রাথমিকভাবে ব্যথা কমার পর রক্ত পরীক্ষা করে ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইউরিক অ্যাসিড লেভেল বেশি থাকে। কিন্তু ত্রিশ শতাংশ ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যাদের ইউরিক অ্যাসিডের কারণে যন্ত্রণা হচ্ছে তাদের রক্তপরীক্ষা রিপোর্ট কিন্তু নরমাল এসেছে। অর্থাৎ ইউরিক অ্যাসিডের কারণে যন্ত্রণা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি নেই। ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ যদি খুব বেশি বাড়ে-কমে তাহলে গাউট হবার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়।
অথচ এমনও দেখা গেছে অনেকের হয়তো ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা সাতের বেশি কিন্তু কোনো সমস্যা আসেনি। এক্ষেত্রে বেশি আছে বলেই ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ দিয়ে কমানো হবে কি হবে না—সেটা নিয়ে এখনও ডাক্তারদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে।
ইউরিক অ্যাসিডের কারণে গাঁটে ব্যথার মতো সমস্যা যদি অনেক দিন ধরে থাকে তবে রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিসের সাথে গুলিয়ে যেতে পারে। কারণ দু’টো রোগেরই প্রায় কমন উপসর্গ। তাই চিকিৎসা করাও জরুরি। তাছাড়া ইউরিকঅ্যাসিডের কারণে শুধু গাউট আর্থ্রাইটিস হবে তা নয়, হতে পারে অন্য অসুখও।
- কিডনি খারাপ: ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলে কিডনিতে স্টোন হতে পারে। কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে রেনাল ফেলিওরও হতে পারে। তাই কিডনির সমস্যা থাকলে এটা নিয়ে চিন্তাভাবনার দরকার আছে যাতে কিডনি খারাপ না হয়ে যায়।
- হার্টের সমস্যা: যাদের ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকে তাদের হার্টের নানান সমস্যার সম্ভাবনা বা প্রবণতা থাকে। এদের মেটাবলিক সিড্রোমও দেখা যায়, যেমন ওবেসিটি, ব্লাডপ্রেসার, রক্তের লিপিড প্রোফাইলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে।তাই ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে।
- কোমরে ব্যথা: ইউরিক অ্যাসিড থেকে কোমরে ব্যথা সাধারণত কমন সমস্যা নয়। কোমরে ব্যথা নানা করণে হতে পারে। তবে ইউরিক অ্যাসিড থেকে কোমরে ব্যথা অসম্ভবও কিছু নয়। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা ৬.৮-এর বেশি হলে পায়ের আঙুলের হাড়ে ব্যথা হয়। কিন্তু খুব বেশি পরিমাণ জমা হলে কোমরে ব্যথা হতেই পারে।
- পারিবারিক ইতিহাস থাকলে সমস্যা আসতে পারে: ২০১৪-২০১৫-তে এসে চিন্তা করতে হয় আর কী কী রোগ আছে বা রোগ প্রবণতা আছে অথবা রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো কী কী।
পাশাপাশি ইউরিক অ্যাসিড বেশি হলে একটু গুরুত্ব দিয়েই চিকিৎসা করতে হবে।
ইউরিক অ্যাসিড বেশি হয়ে গেলে ব্যথার ওষুধ বা স্টেরয়েড দিয়ে কমানো হয়। কমানোর পরে স্থির করতে হয় ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ দিয়ে ইউরিক অ্যাসিড কমানো হবে কি না। যদি রোগীর পারিবারিক ইতিহাস না থাকে তাহলে নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে রোগটা ছেলেদেরই হয়। মেয়েদের মেনোপজের পর হতে দেখা যায়। মেয়েদের এমনিতেই কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইউরিক অ্যাসিডের জন্য হঠাৎ যন্ত্রণা শুরু হলে যদি পারিবারিক ইতিহাস ও অন্য রিস্ক ফ্যাক্টর না থাকে তাহলে তিন বা চার সপ্তাহ অপেক্ষা করার পর স্থির করতে হবে রোগীকে ইউরক অ্যাসিড লেভেলটা কমাবার জন্য চিকিৎসা শুরু হবে কি না। না হলে যেমন ব্যথার জন্য চিকিৎসা অর্থাৎ ব্যথা কমাবার ওষুধই ওথেষ্ট। কিন্তু রোগীর যদি ইউরিক অ্যাসিড লেভেল বারো-তেরো হয় তাহলে তার চিকিৎসার দরকার আছে।
কিডনির কোনো সমস্যা বা হার্টের কোনো সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসার সাথে সাথে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ছে কি না সেটাও দেখা দরকার। কারণ ইউরিক অ্যাসিডের কারণে কিডনির সমস্যা এসে যাবে। এজন্য প্রতিটি রোগীকে আলাদা আলাদাভাবে বিচার করতে হবে। অন্ধের মতো কোনোকিছু করা যাবে না।
খাবার কী ধরনের হবে
জেনে রাখা দরকার খাওয়া-দরকার নিয়ন্ত্রণ করে ইউরিক অ্যাসিডের লেভেলের মাত্রা খুব বেশি হলে এক কমানো যায়। তাই ওষুধের দরকার পড়ছেই। ইদানীংকালে খাবার নিয়ে বলা হচ্ছে, তিনরকম খাবার বাদ দিতে হবে।
- সী ফুড যেমন ইলিশ, পমফ্রেট, চিংড়ি।
- রেড মিট খাবেনই না, চিকেনটাও কম খেলেই ভালো।
- যেকোনো ধরনের অ্যালকোহলে। তবে কঠোরভাবে বিয়ার খেতে মানা করা হয়। টম্যাটো, ঢেঁড়শ, বিনস, মুসুর ডাল অনেকে বাদ দেয় বটে তবে এককিছু বাদ দেওয়ার দরকার নেই। পরিমাণে কম গ্রহণ করলেই হবে।
-
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন