স্ট্রোক: পরিচর্যাটা সামান্য ব্যাপার নয়
ডাঃ মধুসুদন ভৌমিক
2019-03-08 16:06:45
এখন থেকে মাত্র কয়েক দশক আগে মস্তিষ্কে স্ট্রোক হলে মানুষ অসহায় বোধ করত। আজও অনেকে এই রোগকে মৃত্যেু পরোয়ানা মনে করেন। অবশ্যই সেটা অজ্ঞতার কারণে। কারণ সমস্যাকে সমাধানে রূপান্তরিত করতে মানুষ ওস্তাদ। যে রোগ আজ দুরারোগ্য কাল সে রোগ সারানো জলভাত হতে পারে। সমস্যাই সমাধানের পথ দেখায়।
স্ট্রোকের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। জীবন নেওয়ার তালিকায় স্ট্রোকের ‘সাফল্য’ মানুষকে চিন্তায় ফেলেছে। সেই চিন্তার ফসল হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞান স্ট্রোক রোগ সারানোর অনেক ওষুধ ও উপায় বের করতে পেরেছে। আবিষ্কার করে ফেলেছে স্ট্রোক না হতে দেওয়ার।মাথায় অস্ত্রোপচারের কথা মানুষ খুলি ফুটো করে জমাট বাধা রক্ত বের করে আনা এখন জলভাত। এখন মস্তিষ্কের যে অঞ্চলে ধমনীতে রক্তের টুকরো আটকে রক্ত চলাচল কমে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে সেখানে কৃত্রিমভাবে জালিকা বুনে, ব্লকেজ বাইপাস করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব হচ্ছে। মাথার খুলি অক্ষত রেখে শিরাপথে নল চালিয়ে ব্লকেজ খুলে দেওয়া নিউরোসার্জেনদের বাঁয়া হাতের খেল। মেডিসিনও পিছিয়ে নেই। আজকাল সফলভাবে থ্রম্বোলাইসিস করে রক্ত চলাচল ওষুধ দিয়েও স্বাভাবিক করা যাচ্ছে। রোগের অগ্রগতি রুখে দেওয়া যাচ্ছে। জটিলতা কমিয়ে দেওয়া সম্ভভ হচ্ছে।
স্ট্রোক চিকিৎসার সাফল্য যৌথ প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে
স্ট্রোক তথা সি.ভি.এ ইস্কোমিক, হেমারেজিক, অ্যামবোলিক, ইনফার্কটিভ, সাময়িক, ক্রমবর্ধমান বা স্থায়ী যে ধরনেরই হোক না কেন তার একটি কমন চিকিৎসা আছে। স্ট্রোক রোগের মোকাবিলা করার জন্য শুধুমাত্র দক্ষ চিকিৎসক নয়, সেখানে আম-আদমি থেকে শুরু করে রোগী, বাড়ির লোক, প্রতিবেশি, সমাজ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। স্ট্রোক হলে গ্যাস, অ্যাসিডের দোহাই দিয়ে, মুখে সাবানজল গুঁজে, আনট্রেন্ড লোকেদের খপ্পরে রেখে মূল্যবান সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে বা স্ট্রোক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসাটাই স্টোক মোকাবিলার প্রথম ও প্রধান শর্ত।
স্ট্রোক রোগের কমন চিকিৎসা
বুদ্ধি ও চেতনার কেন্দ্রে বিপর্যয় হলে রক্তমাংসের মানুষটি নিজের দেখাশোনা করতে পারে না। জীবনের প্রাইভেট, পাবলিক যাবতীয় কাজকর্মের জন্য অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও তাকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। দেশের অলিতে গলিতে পিপড়ের সারির মতো জীবন মেরামতি কেন্দ্র আছে। লাইফ কেয়ার, আরোগ্য-ধাম, ধন্বন্তুর, মৃত সঞ্জীবনী, মাদার কেয়ার, জীবন দান আদি গালভরা নামের নাসিংহোম আছে। আলফ্রেড, গোপালন, রাঘবন ও চ্যাটার্জি ব্যানার্জি নামের স্টোক বিশারত আছেন। কিন্তু নার্সিংহোমগুলোতে কতজন নার্স, কতজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা আছে, প্রতিটি নার্সিহোমে আর.এম.ও আছেন নাকি মরে ভূত হয়ে যাওয়া কর্নেলের নামে একাধিক নার্সিং হোম চলছে, নার্সিংহোমের উপযুক্ত পরিকাঠামো আছে না জেলা নেতৃত্বকে ম্যানেজ করে লাইসেন্স বেঁচে আছে, সর্বোপরি দেশি-বিদেশি মাল্টি ডিগ্রিধারী ডাক্তারবাবুদের কে আসল আর কে জালি সে খবর কতজন রাখেন! এইসব চিটিং ব্যবসা নিয়ে বিতর্ক ও প্রতিবেদন প্রতিদিন খবরের শিরোনামে থাকলেও জালিদের জালের একটাও ফাস আলগা হচ্ছে না।
ডাক্তারবাবু ওষুধপত্র ও সেবা সম্বন্ধীয় নির্দেশ দেবেন এবং নাসিং দপ্তর সেই নির্দেশ পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। এজন্য কিছু ভালো স্পেশালাইজড স্ট্রোক ইউনিট আছে। কিন্তু চরম বিপদের দিনে প্রিয় মানুষটির মুখ পরিষ্কার করা, ত্বকের যত্ন নেওয়া, প্রাইভেট অঙ্গের পরিচর্যা, বিছানার চাদর পাল্টানো, পায়খানা-প্রস্রাব পরিষ্কার করার মতো কাজগুলো আপনজন ছাড়া বাইরের কারো পক্ষে নিপুণভাবে সামলানো সম্ভব কি ? এই কাজগুলো কিন্তু মোটেও সামান্য নয়। জ্ঞানহারা রোগীকে ঘন ঘন পাশ ফিরিয়ে না দিলে, নিজের দেহের চাপে বিছানাতে সেটে থাকা অংশগুলোতে রক্ত চলাচল কমে গিয়ে পচন শুরু তথা বেড সোর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সেখান থেকে মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো সেপটিসেমিয়াও হতে পারে। একইরকম অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শক্ত হয়ে বেকে যেতে পারে।চোখে ঘা হতে পারে। ছত্রাক জমতে পারে। মাইনে নেওয়া নার্স অবাধ্য ও অক্ষম রোগীকে খাওয়াতে ব্যর্থ হতে পারেন। দু’এক চামচ মুখে গুজে দায় সারতে পারেন। বাবা বাছা করে শিশুকে খাওয়ানোর মতো করে তাদের পুষ্টি না যোগালে অপুষ্টিতে জীবনের রথ থেমে যেত পারে। কাজেই নার্স হতে হবে আপনজনকেই। চিকিৎসকের কাছে জেনে নিয়ে জীবন সামলানোর কাজে আপনিই হবেন দক্ষ সৈনিক। চিকিৎসক দেবেন ডেফিনিটিভ থেরাপি এবং আপনি প্লে করবেন সাপোর্টিভ রোল। চিকিৎসাকেন্দ্রের লোক ও বাড়ির লোকের যৌথ প্রচেষ্টার সি.ভি.এ নামক জীবনখেকো স্ট্রোক রোগের সঙ্গে টক্কর দিয়ে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং অক্ষমতা প্রতিরোধ করতে হবে।
আপনিও যখন নার্স
মেয়েরা মায়ের জাত। মায়ের থেকে অধিক যত্ন নেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। অসহায় স্ট্রোক রোগীর সেবা-শুশ্রুষার দায়িত্ব কোনো একজন পটু ও দরদী মহিলার ওপর অর্পণ করা বুদ্ধিমানের কাজ। নীচে বেশ কিছু টিপস দেওয়া হল, আশা করি এগুলো তাকে আরও উন্নত পরিষেবা দিতে সাহায্য করবে।
- যদি রোগী সজ্ঞানে থাকে তবে তাকে ভরসা দিতে হবে।
- সজ্ঞানে থাকলেও যদি তার হেমিপ্লেজিয়া অর্থাৎ শরীরের একপাশ কমজোরি থাকে তবে প্রতিবার খাওয়ানোর সময় গলার খাদ্যবস্তু লেগে বিষম লাগতে পারে। অল্প অল্প করে ধীরে ধীরে খাওয়ানো বাঞ্ছনীয়।
- শোয়ানো অবস্থায় না খাইয়ে রোগীর পেছনে সার্পোট দিয়ে আধবসানো অবস্থায় খাওয়াতে হবে।
- একবার গিলে ফেললে তবেই দ্বিতীয়বার মুখে খাবার দিতে হবে।
- তরল খাদ্য বাটিতে ভরে রোগীর মুখে ধরতে হবে। অনেক সময় রোগী তার প্রয়োজন মতো খাদ্য চুমুক দিয়ে খেতে পারে।
- নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য একবারে না খাইয়ে বারে বারে খাওয়াতে হবে। প্রতিবার খাওয়ার শেষে হেক্সিডিন জাতীয় মাউথ ওয়াস দিয়ে মুখ ধুইয়ে দিতে হবে।
- রোগীর জামাকাপড় ও বিছানাপত্র শুকনো ও পরিষ্কার রাখতে হবে।
- ডাক্তারবাবুর নির্দেশ মেনে খাবারের ধরন ও পরিমাণ ঠিক করতে হবে।
- কতখানি খাওয়ানো গেল তা লিখে রাখতে হবে।
- রোগী অর্ধচেতন বা অবচেতন থাকলে ডাক্তারবাবুর নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না।
- ডাক্তারবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী রোগীর মাথার দিক একটু উচিয়ে বা নামিয়ে রাখতে হবে। সাধারণত ইস্কেমিক স্ট্রোকের রোগীর মাথা একটু নামিয়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ বাড়ে। যদি হেমারেজিক স্ট্রোক হয় তবে মাথার দিক সামান্যে উচিয়ে রাখলে সেরিব্রাল ইডিমা কমে।
- রোগীকে ঘন ঘন পাশ ফিরিয়ে দিতে হবে। পিছনের দিকে স্পিরিট, আয়োডিন পেইন্ট করে দিলে ভালো হয়। প্রস্রাবে যাতে পেছনদিক ভিজে গিয়ে বেডসোর তৈরি না হতে পারে সেদিতে খেয়াল রাখতে হবে।
- বেডসোর তথা ঘা হলে ক্ষতস্থান ভালো করে নরমাল সেলাইন স্প্রে করে ধুইয়ে দিতে হবে। ক্ষত গভীর হলে কয়েক ফোঁটা হাইড্রোজেন পারক্সাইড, বিটাডাইন দ্রবণ দিয়ে মুছিয়ে নিতে হবে। এরপর বিটাডাইন পাউডার স্প্রে করে বা সোফ্রামাইসন জাতীয় মলম লাগিয়ে বা জেলোনেট বসিয়ে স্টেরাইল সার্জিকাল গজ দিয়ে ক্ষতস্থান ঢেকে দিতে হবে ও সেলোপোর দিয়ে আটকে দিতে হবে।
-
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন