বারবার সংক্রমণ? মূত্রনালীতে ক্রটি নেই তো
ডাঃ রাজীব সিনহা
2019-03-09 12:05:28
প্রস্রাব সংক্রমণ শিশুদের একটি বিশেষ সমস্যা। বিভিন্ন ভাবে এই রোগ প্রকাশ পেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওষুধেই এর নিরাময় সম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
আমাদের দেহে দুটো বৃক্ক বা কিডনি থাকে। সেখানে মূত্র তৈরি হয়। তারপর তা মূত্রনালী দিয়ে নেমে মূত্রথলিতে জমা হয় এবং পরে ইউরেথ্রা দিয়ে বেরিয়ে মূত্র হিসেবে নির্গত হয়।
বিভিন্নভাবে মূত্রের সংক্রমণ ঘটতে পারে। তবে প্রধান উৎস হল মলনালী। ওইসব ব্যাক্টেরিয়া মলে সংক্রমণ না ঘটালেও মূত্রে সংক্রমণ ঘটায়। মলদ্বার যেমন মূত্র সংক্রমণের উৎস, ইউরেথ্রাও সংক্রমণের উৎস হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাক্টেরিয়া কেবল মূত্রথলিতেই থাকে। পরে কোনো সময় তা উপরে উঠে বৃক্ককেও সংক্রামিত করে।
দেখা গেছে প্রতি কুড়ি জন ছেলের মধ্যে একজন এবং প্রতি দশ জন মেয়ের মধ্যে একজন ষোলো বছর বয়স হওয়ার আগে অন্তত একবার মূত্র সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। পাঁচ বছর বয়সের নীচেই এর প্রকোপ বেশি।
মূত্র সংক্রমণের ক্ষেত্রে কয়েকটি শব্দ খুব ব্যবহৃত হয়। সেগুলো হল--
- লোওয়ার ইউ.টি.আই : যখন সংক্রমণ শুধু মূত্রথলি ও ইউরেথ্রায় হয়।
- আপার ইউ.টি.আই: যখন সংক্রমণ বৃক্ক ও মূত্রনালীতে হয়।
- পায়েলোনেফ্রাইটিস: বৃক্ক সংক্রমণ।
- লোইন পেন: যখন পেটের পাশ থেকে ব্যথা হয়, যা বৃক্ক সংক্রমণ নির্দেশ করে।
কারণ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের সংক্রমণের কারণ জানা যায় না। কোনো কোনো শিশু প্রস্রাব করতে চায় না, তাই মূত্রথলিতে অনেকক্ষণ মূত্র থেকে তা সংক্রামিত হয়। এসব ক্ষেত্রে শিশুদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়। আবার অনেক শিশু বিশেষ কারণে প্রস্রাব ঠিকমতো বারই করতে পারে না। যেমন—
- প্রবল কোষ্ঠকাঠিন্য।
- কোনো মানসিক সমস্যা।
- মূত্রনালীর কিছু কিছু সমস্যায় মূত্র নীচে না নেমে ওপরে উঠতে পারে। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে রিফ্লাক্স।
- মূত্রনালীতে পাথর জাতীয় জিনিস থাকলে।
- নার্ভের সমস্যায়।
- শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে, যেমন যার স্টেরয়েড বা কেমোথেরাপি চলছে।
উপসর্গ
খুব ছোট শিশুর ক্ষেত্রে উপসর্গ বোঝা কঠিন। জ্বর, বমি বা ডায়রিয়া, ঘুম ঘুম ভাব, বেশি কান্নাকাটি, প্রস্রাবে রক্ত বা ঘোলাটে ভাব এই সব নিয়েই শিশুরা আসে। এই বিষয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হল যদি শিশুর শরীর কিছুদিন খারাপ থাকে বা জ্বর হয় যেখানে নির্দিষ্ট কোনো উপসর্গ নেই, যেমন সর্দিকাশি, গলাব্যথা ইত্যাদি, তবে মূত্রের পরীক্ষা সবসময় করা উচিত। কারণ ঠিক সময় চিকিৎসা না করালে ফল খারাপ হতে পারে।
পরীক্ষা
মূত্রের সাধারণ পরীক্ষাই প্রথমে করা হয়। সাধারণ মূত্রে কোনো জীবাণু থাকে না। তাই কোনো জীবাণু পাওয়া গেলেই তাকে সংক্রমণ বলেই ধরতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চামড়া থেকে ব্যাক্টেরিয়া মূত্রে গিয়েও ভুল রিপোর্ট আসতে পারে। তাই মূত্র সংগ্রহের পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বড়দের ক্ষেত্রে প্রথম দিকের মূত্র ফেলে মাঝের অংশ ধরতে হয়। বড় মুখওয়ালা বোতলে মূত্র সংগ্রহ করা উচিত। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ন্যাপিতে মূত্র ধরে, সেটি সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে পরীক্ষা করা যেতে পারে। দুধ খাইয়ে তলপেটে একটু আলতো চাপ দিলেই শিশু মূত্র ত্যাগ করে।
মূত্র সংগ্রহের সাথে সাথে সেটা পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হয়। দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তা ফ্রিজে রাখা উচিত।
যদি এর পরও কোনো রকম ভাবে প্রস্রাব সংগ্রহ করা না যায়, তাহলে ডাক্তারের সাহায্য নিতে হবে। সরু একটি নলের সাহায্যে মূত্রাশয় থেকে সব বিমূত্র সংগ্রহ হয়। এটি তে সংক্রমণ বা ব্যথা দু’টোরই সম্ভাবনা প্রায় নেই।
পরবর্তীকালে কী কী হতে পারে
মূত্র সংক্রমণ অ্যান্টিবায়োটিকেই সম্পুর্ণ নিরাময় হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশু একবারই আক্রান্ত হয়, কিন্তু এটি বারবারও হতে পারে। যেসব শিশুর মূত্রনালীতে কোনো আকৃতিগত সমস্যা থাকে, তাদেরই বারবার সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
কখন বিশেষ পরীক্ষার দরকার হয়
যখন শিশু গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে আসে বা অন্য কোনো উপসর্গ থাকে এবং যাদের একাধিকবার সংক্রমণ হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পরীক্ষা যেমন ইউ.এস.জি, ডি.টি.পি.এ স্ক্যান ইত্যাদি করা হয়। এথেকে মূত্রনালীর আকৃতিগত অসুবিধে এবং বৃক্কের কার্যক্ষমতা জানা যায়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে শিশুকে নিয়ে যেতে হবে। খুব অল্প মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক কিছুদিন নিয়মিত দিতে হয় কোনো কোনো শিশুকে। এটি শুধু সংক্রমণ প্রতিরোধ করে না, বৃক্কের ক্ষতি হওয়ার রোধ করে।
কীভাবে মূত্র সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়
- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া।
- বেশি করে শাক-সবজি খাওয়া যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা যায়।
- পরিমিত পরিমাণে জল খাওয়া। খুব সাধারণ রোগ হলেও দেরি করে ধরা পড়লে তা সারানো কঠিন হয়। বারবার সংক্রমণে বৃক্কের ক্ষতি হয় এবং উচ্চরক্তচাপের সম্ভাবনা থাকে। সঠিক সময়ে এবং নিয়মিত চিকিৎসায় এই রোগের প্রতিরোধ ও নিরাময় দুই-ই সম্ভব।
-
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন