মাইনাস পাওয়ার কমানো যায়
ডাঃ সুগত পাল
2019-03-09 15:45:49
চোখ মানুষের অমূল্য রতন। এই পৃথিবী যে কত সুন্দর সেটা জানা যায় আমাদের চোখ আছে বলে।
চোখের ব্যাপারটা ঠিক একটা ক্যামেরার মতো। ক্যামেরায় যেমন কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব ফিল্মের ওপর পড়ে ঠিক সেরকম আমাদের দেখা বস্তুর গা থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি কর্ণিয়া ভেদ করে পিউপিলের মধ্যে দিয়ে লেন্সের মাধ্যমে রেটিনায় এসে উল্টো প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। আলোকরশ্মির প্রভাবে রেটিনার রড ও কোন কোষ উদ্দীপ্ত হয়। আলোক-অনুভূতি অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কের সেরিব্রামের দৃষ্টিকেন্দ্রে পৌঁছয়। সেখানে পৌঁছবার পর বস্তুকে আমরা সোজা দেখতে পাই। কোনো কারণে এই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে তা অন্ধত্বের কারণ হয়। তাই চোখের ব্যাপারে আমাদের অনেক বেশি যত্নের প্রয়োজন।
চোখে দেখার অসুবিধে থেকেই আসে চশমার ব্যবহার। চশমা যেমন দেখার সুবিধে করে দেয় তেমন চশমা ব্যবহার নানান অসুবিধেও হয়। সেই অসুবিধের জায়গা থেকে রোগীরা ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করেন ‘পাওয়ারটি কি কমানো যায়? চোখের পাওয়ার কমানো সম্ভব?’
এই কথায় বলা যায়, হ্যাঁ, কমানো যায়। তবে এর জন্য সঠিক সময় বেছে নিতে হয়। যেমন কম বয়সে বাচ্চারা প্লাস নিয়ে আসে। সাধারণ মানুষ ভাবে চল্লিশের পর যে চালশে হয় তাতে প্লাস পাওয়ার লাগে, কিন্তু অনেক বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে দূরের জিনিস দেখতে অসুবিধে হচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে দূরের জিনিস দেখার জন্য তাদের প্লাস পাওয়ারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্লাস পাওয়ার স্বাভাবিক ভাবে অনেকটাই কমে যায়। কিছু ক্ষেত্রে টিন এজে গিয়ে প্লাস পাওয়ারটা পুরোপুরি চলেও যেতে পারে।
এরপরে আছে মাইনাস পাওয়ারের সমস্যা। মাইনাস পাওয়ার কিন্তু নিজ থেকে কমে না। সাধারণ পাওয়ারটা বাড়তেই থাকে। গ্রোইং এজে মাইনাস পাওয়ারটা বাড়তেই থাকে। গ্রোইং এজে মাইনাস পাওয়ার বাড়তে বাড়তে একটা বয়সে গিয়ে সেটা স্থিতি পায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাইনাস পাওয়ারের রোগীদের দূরের জিনিস খালি চোখে দেখতে অসুবিধে হয়। প্লাস পাওয়ারের রোগীদের ক্ষেত্রে তাদের প্লাস পাওয়ার থাকা সত্ত্বেও চোখের মাসলকে ব্যবহার করে প্লাস পাওয়ারকে অনেক সময় কমিয়ে নিয়ে দেখতে পারেন। মাইনাস পাওয়ারে দূরে দেখার অসুবিধে সব সময় হয়, আর এ ধরনের রোগীরাই জিজ্ঞেস করেন, পাওয়ার কমানোর কোনো উপায় আছে কি না ?
ল্যাসিক সার্জারি
বিগত দুই দশক ধরে চোখের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে ল্যাসিক সার্জারি। এই ল্যাসিক সার্জারির সাহায্যে মাইনাস পাওয়ারকে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
এই পদ্ধতিতে কী করা হয়
আমাদের চোখের যে কালো স্বচ্ছ লেয়ার থাকে, যাকে আমরা কর্নিয়া বলি, সেই কর্নিয়ার ওপরের লেয়ার বা স্তরটাকে পাতলা করে তুলে নেওয়া হয়। তার তলার লেয়ারটা একজাইমা লেজারের সাহায্যে লেপটাকে পরিবর্তন করে মাইনাস পাওয়ারটাকে তুলে দেওয়া হয়। লেজার হয়ে গেলে আবার ওই কর্নিয়ার ওপরের স্তরটাকে যথোচিত বিন্যাসে সাজিয়ে দেওয়া হয়। পুরো পদ্ধতিটা করা হয় মেশিনের সাহায্যে। এর ফলাফল খুবই ভালো।
অনেকের ধারণা মাইনাস টেন না হলে ল্যাসিক সার্জারি করানো যায় না। এই ধারণা কিন্তু ভুল। বরং মাইনাস টেন পাওয়ার হলে ল্যাসিক সার্জারি না করানোই ভালো। কারণ সার্জারি করালেও পুরোটা করা সম্ভব হয় না। পুরোপুরি কারেকশন করে দিলেও সেটা আবার ফেরত চলে আসে।
ল্যাসিক সার্জারিতে কর্নিয়ার লেয়ারের শেপটাকে মডিফাই করে দেওয়া হয়। এর ফলে কর্নিয়াটা পাতলা হয়ে যায়। কর্নিয়া যদি খুব বেশি পতলা হয়ে যায় তাহলে শেপ বা আকারটা আবার পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে এবং আবার মাইনাস পাওয়ার ফেরত আসতে পারে।
ল্যাসিক করার আগে আমাদের বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। যেমন কর্নিয়ার থিকনেসটা ঠিক আছে কি না, কর্নিয়াতে কোনো কেরাটেকোনাস আছে কি না বা লেপটা ঠিক আছে কি না বা রেটিনায় কোনো সমস্যা আছে কি না ইত্যাদি। মাইনাস পাওয়ারের রোগীদের রেটিনাতে গর্ত থাকতে পারে, থিমিং থাকতে পারে। ল্যাসিক করার আগে রেটিনার সমস্যা সব সময় ঠিক করে নেওয়া উচিত। তা না হলে অপারেশনের পরে রেটিনাল ডিটাচমেন্ট হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে।
ল্যাসিক করার ক্ষেত্রে আর একটা জিনিস মনে রাখতে হয় ড্রাই আই বা শুষ্ক চক্ষু কি না। যদি শুষ্ক চক্ষু হয় তাহলে ল্যাসিকের পর শুষ্কতা বেড়ে যেতে পারে এবং এই সব ক্ষেত্রে অপারেশনের পরে শুষ্ক চক্ষুর ড্রপ নিয়মিতভাবে প্রত্যেকদিন দিয়ে যেতে হয়।
ল্যাসিক ছাড়া আর একটা উপায়ে পাওয়ার কমানো যায়, তাকে বলা হয় Lasek । এটা ল্যাসিক-ই কিন্তু পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম।
রেডিয়াল কেরাটোমি
কিছু বছর আগে আর একটা পদ্ধতি ছিল যার সাহায্যে পাওয়ার কমানো হত, যেটাকে বলা হয় রেডিয়াল কেরাটোমি। তাতে সাইকেলের চাকায় যেমন স্পাইক থাকে সেইরকম স্পাইক রেখে কর্নিয়াকে সেমি থিকনেসে খুব সূক্ষ্ম ব্লেডের সাহায্যে কেটে দিয়ে পাওয়ারটা কমানো হত। এর রেজাল্ট কিন্তু খুব আনপ্রেডিক্টেবল এবং এর ফলে রাতে দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হত রোগীদের। এর ফলে এই পদ্ধতিটা বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় বন্ধ হয়ে গেছে।
বিশ্বের কিছু কিছু জায়গায় আর একটা পদ্ধতি চালু আছে, যার নাম ক্লিয়ার লেন্স এক্সচেঞ্জ। এক্ষেত্রে কর্নিয়ার ওপর অপারেশন না করে চোখের যে স্বাভাবিক লেন্স আছে, সেই লেন্সটাকে বার করে দিয়ে যে পাওয়ারের লেন্স বসালে মাইনাস পাওয়ারটা চলে যাবে সেই পাওয়ারের লেন্স চোখের ভিতর বসিয়ে দেওয়া হয়।
ফেকিক আই.ও.এল
আর একটা পদ্ধতি আছে যার নাম ফেকিক আই.ও.এল। এই পদ্ধতিতে স্বাভাবিক জিনিসটা বার না করেই তার ওপর দিয়ে আর একটা নেফ্রাইসিং লেন্স বসিয়ে পাওয়ারটা ঠিক করে দেওয়া হয়।
বিশ্বে মোটামুটি এই চারটি পদ্ধতিই প্রচলিত পাওয়ার কমানোর জন্য। এবং চিকিৎসার ফলও আশানুরূপ। সব থেকে ভালো ফল পাওয়া যায় মাইনাস পাওয়ারের রোগীদের। তার পরে যাদের অ্যাস্টিগমাফিজম আছে তাদেরও ফল ভালোই হয় চিকিৎসায়। তার পরে যাদের প্লাস পাওয়ার আছে তাদের হয়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন