বোল ফোটার গল্প
ডাঃ অঞ্জন ভট্টাচার্য
2019-03-15 11:57:01
দশ বছর হয়ে গেল অনীশের। এখনও কথা বলতে শেখেনি সে। ১৫ মাস বয়স নাগাদ যদিও বা সে ‘বাবা’, ‘মামা’ আওয়াজ দিত, ১৮ মাস বয়স হতে না হতেই চুপচাপ। মাঝেমধ্যে গোঙানির আওয়াজ ছাড়া আর কোনো কথাই সে বলল না কোনোদিন।
উপরন্ত্ত ক্রমাগত দুরন্ত হয়ে উঠতে শুরু করল সে। কোনো এক জায়গায় আর স্থির হয়ে বসতে চায় না সে। কথায় কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অনীশের বাবা-মা হাজার চেষ্ট করেও বুঝে উঠতে পারেন না যে কী কারণে ক্ষিপ্র হয় অনীশ। ইদানীং মায়ের গায়ে হাত তুলতে শুরু করেছে সে।
অনীশকে অনেক কাকুকি-মিনতি করেছেন তার বাবা-মা। লাভ হয়নি কিছুই। সেই আড়াই বছর বয়স থেকেই স্পীচ থেরাপিস্টের কাছে যাচ্ছে অনীশ। এই সাড়ে সাত বছরের লাগাতার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে।
অনীশ যখন কারণে-অকারণে হাতগুলো অস্বাভাবিকভাবে বাঁকাতে শুরু করে বা আঙুলগুলোকে চোখের কাছে এনে বাঁকাচোখে আঙুলগুলোর নড়াচড়া অস্বাভাবিকভাবে দেখতে থাকে, অনীশের ভবিষ্যৎ চিন্তার আতষ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন তারা। ধৈর্য তাই হারাননি কখনো। স্পীচ থেরাপিস্টের কথা অনুযায়ী চালিয়ে গেছেন অক্লান্ত প্রচেষ্টা। এছাড়াও গেছেন ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে। ভেলোর, নিমাহ্যান্স, এইমস, দিল্লি, বম্বে, সাউথ ইন্ডিয়া, সব চষে ফেলেছেন তারা।
যথেচ্ছাচার করেননি তা বলে। এমন নয় যে উদভ্রান্তের মতো এই জায়গার থেকে অন্য জায়গায় কেবল দৌড়েই বেড়িয়েছিন। সমস্ত খোঁজ-খবর নিয়ে আটঘাটা বেঁধেই গেছেন এক একটি জায়গায়। কয়েক মাস থেকে চিকিৎসা করাতে হয় সেটা জেনে প্রস্ত্তুতি নিয়েই গেছেন বারে বারে।
চিকিৎসকরা, থেরাপিস্টরা, স্পেশাল এডুকেটররা সবাই যে যা বলেছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন অনীশের বাবা ও মা। জলাঞ্জলি দিয়েছেন নিজেদের সাংসারিক জীবন। অবহেলা করেছেন অনীশের দিদির প্রয়োজন বা পড়াশুনো। সৌভাগ্য তাদের যে অনীশের দিদি তাদের উত্তরবঙ্গের বাড়িতে যৌথ পরিবারে বিনা ঝামেলায় বেড়ে উঠেছে, বাবা-মা’কে অনীশের পেছনে লেগে থাকার সুযোগ করে দিয়ে।
এত শত করেও দশ বছর বয়সেও অনীশ বলেনি কোনো কথা। বললেও কিছু বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে শুধু আপনমনে গোঙায় এবং থেকে থেকে উত্তেজিত হয়ে মারাত্মক দৌরাত্ম্য শুরু করে দেয়। খুব ক্ষেপে গেলে নিজের হাত কামড়াতেও থাকে। আজকাল তো চিকিৎসকরাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কলকাতার নামীদামি শিশু চিকিৎসার কেন্দ্রগুলোতে শিশু বিশেষজ্ঞরাও জবাব দিয়েছেন। বলেছেন যে অনীশের অটিজম আছে। ভালো হবে না কোনোদিন। এতদিন কোনো কথাই যখন বলেনি বা বোঝেনি তাহলে ওই আশা ছেড়ে তাকে স্পেশাল স্কুল বা ইনস্টিটিউটে যদি পুরো দেওয়া যায় তো সেটা এক ধরনের সমাধার আর কি। ফলে বাবা-মা খুবই হতাশ। তবু আশা রাখতে চাইলে টেলিভিশনে অটিজম নিয়ে একটা প্রোগ্রাম দেখে।
কলকাতার এক হাসপাতালে নাকি ভারতবর্ষের প্রথম চাইল্ড ডেভেলপমেন্টাল সেন্টার খোলা হয়েছে কর্পোরেট হেলথ কেয়ার সেট-আপ এ। একজন অস্ট্রোলিয়ার প্রফেসরকেও বলতে শোনা গেল যে এই চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নাকি তাদের দেশের সিডনি শহরের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের মতোই। হতাশার মধ্যেও আশার রূপোলি রেখা দেখে এগিয়ে এলেন তারা।
অনেকেই বললেন, ‘মিছি মিছি পয়সা নষ্ট’, ‘কত জায়গাই তো গেলে, কিছু হল? ‘অনীশের খুব সিরিয়াস কেস, এ তো আর সিম্পল কেস নয় যে ডাক্তার কিছু করতে পারবে’ বা আউট-রাইট ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত ! আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কি ও সব জায়গা ? যাও কিছু পয়সা নষ্ট করে এসো আবার’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনীশের বাবা-মা অনীশের পিছনে খরচা তো ইতিমধ্যে করেই ফেলেছেন চার-পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু একটা বোলও তো ফোটেনি অনীশের মুখে। তবু তারা চেষ্টা ছাড়তে রাজি নন। ডাক্তারদের পক্ষে বা আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে বলা যতটা সহজ ‘স্পেশাল হস্টেলে পাঠিয়ে দাও’, বাবা-মা হয়ে সেই পরিণতি মেনে নেওয়া কি সোজা ? শেষ চেষ্টা না করে?
বুকে বেঁকে, নামি দামি জায়গা জেনেও তারা চলে এলেন ওই বেসরকারি হাসপাতালের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার বা সি.ডি.সি-তে। এখানে প্রথম অনীশকে দেখলেন শিশুবিকাশ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। বাবা-মা’কে বলা হল যে প্রথম তাদের একট শিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হবে। এক সপ্তাহের সেই প্রশিক্ষণ পদ্ধতি শেখানো হবে প্রথমে বাবা-মা’কে। দু’জনকেই সেটা শিখতে আসতে হবে। ফলত, অনীশকে রাখবার বন্দোবস্ত করতে হবে বাবা-মা’কে অন্য কোথাও।
সে কি? সি.ডি. সি ব্যবস্থা করে দেবে না? সত্যিই তো ! ক্রেশ ফেসিলিটি সি.ডি.সি-রই তো বন্দোবস্ত করার কথা। কিন্তু ডাক্তার বোঝালেন যে পশ্চিমবঙ্গীয় কারণে এই শিব ঠাকুরের আপন দেশে এই সব প্রয়োজনীয় আইন-কানুন বন্দোবস্ত করে দিতে না পারার জন্য তারা আন্তরিকভাবে দুঃখিত, কিন্তু অসহায়।
অনীশের বাবা ভারি বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, ভাববেন না। আপনি শুধু বলুন আমাদের কী করতে হবে, আমরা তা ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলব।
ডাক্তারবাবু বললেন যে, ব্যাস। শুধু এই সহজ বোঝাটুকুই তিনি চান বাবা-মা’দের কাছ থেকে। তা হলেই তিনি তার বিশেষজ্ঞদের সদ্ব্যবহার করে অনীশদের মতো শিশুদের কাছে পৌছে দিতে পারেন এই বিষয়ের বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি। অনীশের মা যদিও এই ঝামেলায় ভারি বিরক্ত হয়ে গেলেন। ভাবলেন ‘ এ কেমন ডাক্তার, বলছে যে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, অথচ এটুকু বোঝে না যে অনীশের মতো ছেলেদের অন্য কারো ভরসায় ছেড়ে আসা কতটা বিপজ্জনক?’ তবু, অনীশের বাবার কথার ওপর কথা না বলে চেম্বার থেকে বেরোলেন মনে একরাশ বিরক্তি নিয়েই। বেরোনোর সময় ডাক্তারবাবু আবারও মনে করিয়ে দিলেন যে বাবা ও মা দু’জনেই যেন অতি অবশ্যই এই ট্রেনিং নেন। যে কোনো একজন যেন না আসেন। অনীশের মতো সিরিয়াস কেসের ক্ষেত্রে তাহলে কিন্তু সুফল ফস্কে যেতে পারে!
ওরা সদূর উত্তরবঙ্গ থেকে আত্মীয় আনিয়ে নিলেন অনীশের এক সপ্তাহের দেখভাল করার জন্য, যতক্ষণ তারা ট্রেনিং নিচ্ছেন, ততক্ষণের জন্য। আজ তারা ভাবেন, যে ডাক্তারের এই কথাটুকু অক্ষরে অক্ষরে পালন না করে ফেললে আজ তাদের না জানি কত বড় ক্ষতি হয়ে যেত।
অনীশকে নিয়ে যখন দ্বিতীয় দিন বাবা-মা ডাক্তারবাবুর সামনে এসে বসলেন এক সপ্তাহের ট্রেনিং নিয়ে এসে, তখন বাবা ডাক্তারবাবুকে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, যে ছেলে আজ সাত বছর ধরে এমন দৌরত্ম করে যে তাকে পাকড়ে না ধরে থাকলে কার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে বা কোন গাড়ির তলায় আসবে, সে এই সাত দিনের মধ্যেই আজ জীবনে প্রথম বাবা-মা’র হাত না ধরে পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পনেরো-কুড়ি মিনিটের পথ হেঁটে সল্টলেক থেকে হসপিটালে শান্ত সভ্য ছেলের মতো এসে দেখুন আপনার সামনে বসেছে। বাবা হিসেবে আমার মন ভরে গেছে।’
মা বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, এ সত্যি ভাবা যায় না, এত অল্প সময়ে এত উন্নতি। কিন্তু ছেলে কথা তো বলল না।
ডাক্তারবাবু তখন অনীশকে একটা শিশুবিকাশ প্রোগ্রাম (ইনডিভিজুয়াল ডেভলপমেন্টাল ইন্টারভেনশনাল প্রোগাম) ডিজাইন করে দিলেন। বললেন অনীশের যেহেতু সিরিয়াস কেস, দীর্ঘদিন সে কথা বলতে বা বুঝতে পারত না, তাই তিন মাস তাকে কলকাতায় থেকে এই শিশুবিকাশ প্রোগ্রাম চালিয়ে যেত হবে এবং সপ্তাহে অনীশকে ডাক্তারবাবুর কাছে আনতে হবে চেক-আপের জন্য।
দশ সপ্তাহের মাথায় উত্তেজনায় আত্মহারা বাবা এসে জানালেন ‘ডাক্তারবাবু অ্যাতো জায়গায় অ্যাতো পয়সা খরচা করেছি, অনীশ-কাড়েনি।
কিন্তু আজ যে ছেলে দশ বছর কোনো কথা বলেনি, সে দশ সপ্তাহের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছে!
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন