×

Everyday: 10:00AM - 10:00PM

(+88) 01708500125

(+88) 09666741741

Email: care@hellodoctor.asia



× Home Our Doctors Blog Contact Us
(+88) 09666741741
Everyday: 10:00AM - 10:00PM Email: care@hellodoctor.asia
Title Image

Blog

Home  /  Blog

থাইরয়েডের সমস্যা কীভাবে মিলবে রেহাই

ডাঃ প্রদীপ মুখোপাধ্যায় (সহকারি অধ্যাপক, এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগ, পি.জি.হাসপাতাল)
2019-03-22 15:31:35

আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হল থাইরয়েড। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থগুলো কোনো নালিকা ছাড়াই সরাসরি রক্তে মেশে। অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণে ক্ষরিত এই জটিল জৈব রাসায়নিক পদার্থগুলোর নাম হরমোন। আমাদের শরীরের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ এবং সেগুলোর মধ্যে সুসমন্বয় রক্ষা করে বৃদ্ধি, মানসিক গঠন ও বিকাশ, বয়ঃস্বন্ধি তথা জননতন্ত্রের বিকাশ ও সুনিয়ন্ত্রণ, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতি ও বিকাশ, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া সর্বোপরি সামগ্রিক শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষা করাই হল এই হরমোনতন্ত্র বা এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ডগুলোর প্রধান কাজ।

থাইরয়েডের রোগ এখন অতি পরিচিত একটি সমস্যা। প্রত্যেক বাড়িতেই হয়তো বা কেউ না কেউ এই সমস্যাতে ভুগছেন, তাই থাইরয়েডের রোগ সংক্রান্ত ব্যাপারে অল্পবিস্তর ধারণা হয়তো সকলেরই আছে। এছাড়া গলগন্ড কথাটির  সাথেও হয়তো অনেকেরই পরিচয় আছে। আবার এমনও দেখা যায় বাহ্যিকভাবে কোনো লক্ষণ নেই অথচ তারা থাইরয়েডের রোগে ভুগছেন। অনেক সময় রোগী এসে ডাক্তারবাবুকে বলেন ‘আমার থাইরয়েড হয়েছে’। এটা পরিভাষায় ভুল। তারা আসলে বোঝাতে চান যে তার থাইরয়েডের থাকাটাই অস্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণভাবে থাইরয়েডের রোগ বলতে হাইপোথাইরয়েডিজমকে বোঝানো হলেও নানা রকম ভাবে হতে পারে এই রোগ। তাই থাইরয়েডের রোগের ব্যাপারে সহজে ও স্বল্পপরিসারে একটা ধারণা দেবার জন্যই এই লেখা।

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থান ও শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া সম্পর্কে। থাইরয়েড শব্দটির উৎস হল থাইরয়েড নামে একটি গ্রীকশব্দ থেকে যার অর্থ হল শিল্ড বা বর্ম। আকৃতিতে বর্ম সদৃশ হওয়ায় অথবা বর্মের মতো শরীরকে রক্ষা করবার জন্যই হয়তো এই নামকরণ। এই থাইরয়েড গ্রন্থি আমাদের গলায় শ্বাসনালী বা ট্রাকিয়ার দু’পাশে অবস্থিত। আরও সঠিক ভাবে বললে শ্বাসনালীর দ্বিতীয় এবং চতুর্থ তরুণাস্থি বলয়ের দু’পাশে গ্রন্থিটি অবস্থিত। এর ওজন প্রায় ১৫-২০ গ্রাম। এই গ্রন্থির কাজ হল প্রধানত জল বা খাদ্যজল লবণ বা খাদ্যবস্ত্তু থেকে আয়োডিন সংগ্রহ করা এবং বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় টাইরোসিন নামক একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে টি-ফোর বা থাইরক্সিন এবং টি-থ্রি নামে দু’টো হরমোন প্রস্ত্তুত করা যা আমাদের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে জরুরি।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে দৈহিক ১০০ থেকে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন লবণ প্রয়োজন হয়। গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদায়ী মায়ের ক্ষেত্রে আয়োডিন লবণ প্রয়োজন হয় একটু বেশি মাত্রায়। টি-থ্রি এবং টি-ফোর নামকরণের উদ্দেশ্য হল ওই হরমোনের একটি অনুতে যথাক্রমে তিন বা চারটি আয়োডিন পরমাণু থাকে। অন্যদিকে মস্তিষ্কের মধ্যে অবস্থিত পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিশেষ হরমোনগুলোর মধ্যে একটি  হরমোন থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন বা টি.এস.এইচ., থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি, কার্যকারিতা ও হরমোন নিঃসরণে সাহায্য  করে। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোন নিঃসরণ কমে গেলে পিটুইটারি গ্রন্থির থেকে নিঃসৃত টি.এস.এইচ বেড়ে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোন নিঃসরণ বাড়াতে চেষ্টা করে। উল্টোভাবে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোন নিঃসরণ বেড়ে গেলে টি.এস.এইচ, নিঃসরণ কমে যায়। এই শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতিটিকে বলা হয় নেগেটি। ফিড ব্যাক, যার মাধ্যমে শরীরে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোনের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমার অবস্থান করে।

স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যে আয়োডিন লবণের অভাব হলে থাইরয়েড গ্রন্থিটি ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় এবং প্রয়োজন মতো হরমোন সরবরাহের তাগিদে আকৃতিতে বড় হয়ে যায়। এই রোগের বহিঃপ্রকাশ নানা ভাবে হতে পারে যাদের বলা হয় আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিসঅর্ডার। এগুলো অবশ্যই নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ এবং বিশেষভাবে জরুরি কারণ নিয়ন্ত্রণে বেশি দেরি হলে তা থেকে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভারতবর্ষের বেশে কিছু এলাকায়, বিশেষত পাহাড়ী অঞ্চলে পানীয় জলে আয়োডিন লবণের অভাব থাকায় এই রোগ এদেশে কিছুদিন আগেও একটি সমস্যা ছিল। গর্ভাবস্থায় শিশুর দেহে এই আয়োডিন লবণের অভাব তথা থাইরয়েড হরমোনের অভাবের ফলে একটি নিষ্পাপ শিশু সারজীবন জড়বুদ্ধি হয়ে যেতে পারে, যাকে বলে ক্রেটিন। তাই এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ লবণে আয়োডিন মেশাবার পদ্ধতি সুপ্রচলিত ও বিজ্ঞানসম্মত।

আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক মানব শরীরে টি-থ্রি এবং টি-ফোরের ভূমিকাগুলো কী কী। প্রধানত দেহের সকল কোষের বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও আরও নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে এই হরমোনগুলো সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। গর্ভস্থ শিশুর নিজস্ব থাইরয়েড মোটামুটি ভাবে ১০-১২ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করে। গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বিশেষ ভাবে এই হরমোনগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া শৈশবে মস্তিষ্কের বিকাশও এই হরমোনগুলো ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সে শরীরের দৈর্ঘ বৃদ্ধি বিশেষত অস্থি এবং তরুণাস্থির বৃদ্ধি তথা গ্রোথ হরমোনের কার্যকারিতা বাড়ানো এই হরমোনগুলোর আর একটি প্রধান কাজ, যার অভাবে বামনত্ব প্রাপ্তি বা গ্রোথ ফেলিওর হতে পারে। বয়ঃসন্ধি তথা জননতন্ত্রের বিকাশ ও সুনিয়ন্ত্রণের জন্য এই হরমোনগুলোর প্রভাব থাকে অত্যন্ত সক্রিয়। এই বয়সে এই হরমোনগুলোর অভাব ঘটলে বয়ঃসন্ধি দীর্ঘায়িত বা বিলম্বিত এমনকী অনুপস্থিতও থাকতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এই হরমোনগুলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে অপরিহার্য়।

এবারা আসা যাক থাইরয়েডর রোগ নিয়ে কিছু আলোচনায়। নানারকম হতে পারে থাইরয়েডের রোগ। যেমন থাইরয়েড থেকে টি-ফোর থাইরক্সিন এবং টি-থ্রি নিঃসরণ আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার নাম হাইপোথাইরয়েডিজম। আবার অধিক পরিমাণে এই রস নিঃসরণের জন্য হতে পারে থাইরোটক্সিকোসিস। আবার থাইরয়েড থেকে থাইরক্সিকোসিস। আবার থাইরয়েড থেকে থাইরক্সিন নিঃসরণ স্বাভাবিক থেকেও এই গ্রন্থির সম্পূর্ণ বা আংশিক বৃদ্ধি ঘটতে পারে। এই বৃদ্ধি সম্পূর্ণ মসৃণ ভাবে হতে পারে অথবা দলা পাকানো মাংসপিন্ড আকারেও হতে পারে। আংশিক বৃদ্ধি হয়ে এক বা একাধিক প্রায় গোলাকার বিভিন্ন সাইটের টিউমার বা নডিউল প্রায়শই দেখা যায় এবং এগুলোতে শতকরা ৫-১০% ক্ষেত্রে ক্যানসার হয়ে থাকতে পারে। পরিভাষায় যেকোনোরকম ভাবেই এই গ্রন্থির বৃদ্ধিকে বলা হয় গলগন্ড বা গয়টার। এছাড়া আরও নানারকমভাবেই থাইরয়েডর অসুখ হতে পারে, যেমন পিটুইটারি গ্রন্থির কর্মহীনতার ফলেও হতে পারে হাইপোথাইরয়েডিজম।

এবার জেনে নেওয়া যাক হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ বিষয়ে! প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো এক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থিটি আকৃতিতে বড় হয়ে যেতে পারে অথবা গ্রন্থিটি কুচকে ছোট হয়ে যেতেও পারে। যে যে লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায় তার মধ্যে হল শারীরিক দুর্বলতা, কাজে তীব্র অনীহা, সব সময় অলস অলস ঘুম ঘুম ভাব, চোখে একটু ঢুলু ঢুলু ভাব, স্মৃতিহীনতা, ক্ষুধামান্দ্য অথচ ওজন বৃদ্ধি, শীতকাতরতা,শরীরে ঘাম কম হওয়া, চামড়ায় খসখসে ভাব, মাথার এবং ভ্রুর বাইরের দিকের খসখসে ভাব, মাথার এবং ভ্রুর বাইরের দিকের চুল পড়ে যাওয়া, হাত-পা এমনভাবে ফুলে যাওয়া যেটি টিপলে বসে যায় না, ডায়াস্টোলিক প্রেসার বেড়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তল্পতা, গলার স্বর ভেঙে যাওয়া, পায়ের পেশিতে টান ধরা, অতিরিক্ত রজঃস্রাব ইত্যাদি। এই লক্ষণগুলো সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে শৈশব ও কৈশোরে এইসব লক্ষণ থাকতে পারে নাও থাকতে পারে। সাধারণ ভাবে শারীরিক দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির গতি হ্রাস, পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়া এবং দীর্ঘায়িত বয়ঃসন্ধি এই বয়সের থাইরয়েড গ্রন্থিটির কর্মহীনতার প্রধান লক্ষণ। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রধান লক্ষণ। আর সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য হল একটি শিশুর জন্মের প্রথম দিন থেকেই থাকতে পারে এই রোগ। নবজাতকের যে যে লক্ষণগুলো এই রোগটির উপস্থিতি জানান দেয় সেগুলো হল শিশুটির অস্বাভাবিক রকম নিস্তেজ হয়ে থাকা, মায়ের বুকের দুধ ঠিকমতো টানতে না পারা, জন্ম পরবর্তী দীর্ঘায়িত জনডিস (এই জনডিস সাধারণত ২-৪ দিনের মধ্যে সেরে গেলেও হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে তা দু’সপ্তাহের বেশি থেকে যায়) অত্যন্ত শক্ত পায়খানা ইত্যাদি। তাড়াতাড়ি এই রোগ ধরা পড়লে শিশুটি একদম সুস্থ ভাবে বড় হয়। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে নবজাতকের রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও আমাদের দেশে নবজাতকের রক্ত পরীক্ষা এখনো বাধ্যতামূলক হয়নি। নবজাতকের পরবর্তী অবস্থায় জীবনের প্রথম ২-৩ বছরে শারীরিক, বৌদ্ধিক, ভাষা ও আবেগের বিকাশে স্বাভাবিকতায় অন্য শিশুদের তুলনায় বিলম্ব হওয়া এই বয়সে এই রোগের প্রধান লক্ষণ।

তবে হাইপোথাইরয়েডিজমের ব্যাপারে একটা কথা জানা জরুরি যে সব লক্ষণই সব সময় প্রকাশ পাবে তা কিন্তু নয়। এমনকী থাইরয়েড গ্রন্থি কর্মহীন হলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক কেবলমাত্র শারীরিক দুর্বলতা বা মনঃসংযোগের অভাব নিয়েও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।

কিন্তু কেন হয় এই হাইপোথাইরয়েডিজম? অনুন্নত দেশগুলোতে খাদ্য  আয়োডিন লবণের অভাব থেকে থাইরয়েড গ্রন্থিটি ঠিকমতো কাজ করতে না পারার কথা আগেই বলা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে এমনকী ভারতবর্ষেও লবণে আয়োডিন মেশাবার সুপ্রচলিত পদ্ধতি সরকারি প্রোগ্রামের সৌজন্যে ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির ফলে আয়োডিন লবণের অভাবজনিত থাইরয়েডর রোগ এখন আর প্রায় হয় না বললেই চলে। প্রধাণত অটো ইমিউন ডিসঅর্ডার বা নিজের শরীরের থাইরয়েডর প্রোটিনের বিরুদ্ধে কাজ করার প্রবণতা জনিত অসুখের জন্য এই হাইপোথাইরয়েড রোগ হয়ে থাকে। এছাড়াও হৃৎপিন্ড গোলযোগের কিছু ওষুধ, মানসিক গোলযোগের কিছু ওষুধ কিছু ক্ষেত্রে এই রোগের কারণ হতে পারে। বংশগত কারণেও কিছু ক্ষেত্রে এই রোগ হয়ে থাকে। অটো ইমিউন ডিসঅর্ডার জনিত ক্ষেত্রেও এই রোগ কিছুটা বংশগতি ধারা মেনে চলে।

অন্যদিকে থাইরোটক্সিকোসিস রোগে যে যে লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায় তার মধ্যে হল অতিরিক্ত খিদে অথচ ওজন হ্রাস, অতিরিক্ত গরম বোধ করা, অতিরিক্ত ঘাম এমনকী শীতকালেও ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, মানসিক অস্বস্তি ও ছটফটানি বা অস্থির হয়ে ওঠা, বারবার মলত্যাগের প্রবণতা হওয়া, নিদ্রাহীনতা বা রজঃনিবৃত্তি ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে লক্ষণ প্রকাশ পায় তা হল চোখ বড় বগ ও স্থির হয়ে যাওয়া। গ্রেভস বর্ণিত রোগ থাইরোটক্সিকোমিস রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। এটিও অটো ইমিউন ডিসঅর্ডার জনিত রোগ। এক্ষেত্রে চোখ মাঝে মাঝে করকর করতে পারে বা চোখ অস্বাভাবিক রকম লালচে দেখাতে পারে। এছাড়া একটা জিনিসকে দু’টো জিনিস বলে মনে হতে পারে অথবা চোখ ট্যারা হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও গলগন্ড এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। এই রোগেই সাধারণত স্থির দৃষ্টি বিস্ফারিত নেত্র’র প্রকাশ ঘটে।

গ্রেভস বর্ণিত রোগ ছাড়াও আরও নানা ভাবে থাইরোটক্সিকোসিস রোগ হতে পারে। যেমন থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন যেটা অনেক ক্ষেত্রে নিজে থেকে সেরে যায় বা পরে কিছুক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডিজমে পর্যবসিত হয়, প্রসব পরবর্তী কালের বিশেষ থাইরোটক্সিকোসিস, থাইরয়েড গ্রন্থিতে অবস্থিত কোনো একটি নডিউল বা গ্রন্থি থেকে বা একাধিক গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত থাইরক্সিন নিঃসরণ। সবক্ষেত্রেই লক্ষণসমূহ প্রায় একরকম।

অন্যদিকে থাইরক্সিন হরমোন নিঃসরণ স্বাভাবিক থেকেও থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে এইসব সমস্যা হয় না, তবে বাহ্যিক সৌন্দর্যহানি বিশেষ করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়। এর নাম সিম্পল গয়টার। আর অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে এই গ্রন্থি পারিপার্শ্বিক অঙ্গগুলোকে চাপ দিয়ে অসুবিধের সৃষ্টি করতে পারে, যেমন ঢোঁক গিলতে অসুবিধে, শ্বাসকষ্ঠ অথবা গলার স্বর খসখসে হওয়া ইত্যাদি। আবার ঠিক এই সমস্যাগুলোই হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরোটক্সিকোসিসও হতে পারে যদি সেক্ষেত্রে গ্রন্থিটি আকৃতিতে খুব বড় হয়ে যায়।

আসুন এবার সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক কী কী পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় হয়। হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরোটক্সিকোসিস দু’টো ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ভঅবে টি-থ্রি, টি-ফোর অথবা টি.এস.এইচ টেস্ট করা হয়ে থাকে যদিও সব সময় হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে টি-থ্রি জরুরি নয়। সাধারণভাবে হাইপোথাইরয়েডিজমে টি-থ্রি, টি-ফোর কমে যায় এবং ফলে টি.এস.এইচ বেড়ে যায়। টি.এস.এইচ-এর মাত্রা ১০-এর বেশি হলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া জরুরি। এটি রোগ সম্পূর্ণ ভালো করে দেবার ওষুধ নয় বরং আপনার শরীরে যে থাইরক্সিন থাকা উচিত ছিল অথচ নেই সেটি বাইরে থেকে জোগান দেবার ব্যবস্থা। ডাক্তারবাবুর অনুমান মতো ওষুধ শুরু হবার পর কত ডোজে এটি চলবে তা পরপর দেড় থেকে দু’মাসের মধ্যে কয়েখবার টেস্ট করে জেনে নিতে হয়। এই সময় রক্ত পরীক্ষার ফল স্বাভাবিক সীমার এলেও সেটা কেবল মাত্র ডোজের সঠিকতা নির্ণয় করে, এটি রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাওয়া বা ওষুধ বন্ধ হবার কথা বলে না। একবার সঠিকভাবে ডোজ নির্ণয় হবার পর বারবার টেস্ট করার দরকার হয় না। বিশেষ কোনো শারীরিক অসুবিধা না হলে বছরে একবার পরীক্ষাই যথেষ্ট। আবার টি-থ্রি, টি-ফোর-এর মাত্রা স্বাভাবিক থেকে টি.এস.এইচ-এর মাত্রা স্বাভাবিকের বেশি অথচ ১০-এর কম হলে, ওষুধ খাওয়া জরুরি কি না তা অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে যেমন গলগন্ড আছে কি না, মহিলাটি গর্ভবতী কি না, তার শরীরে অ্যান্টি টিপিও নামক পরীক্ষার ফল পজিটিভ কি না, হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষনগুলো খুব প্রকট কি না ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ার চিকিৎসা সারা জীবন চালিয়ে যেতে হয়।

অন্য যে ব্যাপারগুলো জেনে রাখা ভালো সেগুলো হল থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ সকালে খালি পেটে খাওয়া উচিত। ওষুধ খাবার আধঘন্টার মধ্যে চা বা অন্য কিছু খাওয়া উচিত নয়। ঋতুভেদে ওষুধের মাত্রার কোনো তারতম্য হয় না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডের রোগীর ওষুধের মাত্রা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, যেমন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত রোগী বা খিচুনির জন্য যারা ওষুধ খাচ্ছেন অথবা মানসিক রোগে আক্রান্ত কিছু মানুষ। আবার বার্ধক্যে কিছু ক্ষেত্রে এই ওষুধের মাত্রা কমানোর প্রয়োজনও হতে পারে। যারা হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খান তাদের ক্ষেত্রে আয়রন বা ক্যালসিয়াম জাতীয় ওষুধ খাবার প্রয়োজন হলে তা থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খাবার অন্তত চার ঘন্টার মধ্যে খাওয়া উচিত নয়।

থাইরয়েডের অসুখ থাকলে খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে কিছু প্রচলিত কথা প্রায়ই রোগীদের বিভ্রান্ত করে। যেমন বাধাকপি, পুইশাক, শালগম ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালেঅ যে খাদ্যে বা জলে আযোডিন লবণের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে, সেই জাতীয় খাদ্য খাবার ফলে গলগন্ড হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কাজেই আয়োডিন ডেফিসিয়েন্ট এলাকা না হলে বা আয়োডিন যুক্ত লবণ খেলে বা যারা হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খান তাদের ক্ষেত্রে এই জাতীয় সবজিগুলো খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়।

অন্যদিকে থাইরোটক্সিকোসিস হলে টি-থ্রি, টি-ফোর বেড়ে যায় এবং এর ফলে টি.এস.এইচ কমে যায়। রোগের সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য প্রায়ই রেডিও অ্যাক্টিভ আয়োডিন আপটেক ও স্ক্যান বা টেকনিসিয়াম স্ক্যান করা হয়ে থাকে। এটি জানিয়ে দেয় রোগটি গ্রেভস বর্ণিত থাইরোটক্সিকোসিস রোগ না থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন জনিত রোগ।

হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কোনো মহিলা গর্ভধারণ করলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গর্ভ ধারণ করবার আগে যে পরিমাণ ডোজে থাইরক্সিন ওষুধ চলছিল তার থেকে ২৫-৫০% পর্যন্ত ওষুধের পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। এর কারণ হল, মায়ের নিজের শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি যেখানে নিজের জন্য যথেষ্ট থাইরক্সিন প্রস্তুত করতে সমর্থ হয় না এবং মায়ের শরীরে এই সময় নানারকম পরিবর্তন হওয়ায় থাইরক্সিনের প্রয়োজন বাড়ে, পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশু যেহেতু অত্যন্ত তীব্র গতিতে ক্রমবর্ধমান থাকে তার থাইরক্সিন প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি এবং তার নিজের থাইরয়েড গ্রন্থি কাজ করতে বেশ কিছুদিন দেরি হয়, তাই এই সময় ওষুথের ডোজ না বাড়ালে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রসবের পর এই মহিলার সন্তানকে স্তনপান করাতে কোনো আপত্তি নেই।

অন্যদিকে হাইপারথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কোনো মহিলা গর্ভ ধারণ করলে রোগের তীব্রতা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং ওষুধের পরিমাণ কমানোর প্রয়োজন হতে পারে। প্রসবের পর আবার এই রোগের তীব্রতা বাড়তে পারে, তাই এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। উভয়ক্ষেত্রেই দেড়-দু’মাস পরপর পরীক্ষা করে সঠিকভাবে ডোজ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

আবার থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যানসার হলে যে যে লক্ষণ প্রকাশ পায় তা হল গ্রন্থির ভেতর কোনো মাংসপিন্ডের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব শক্ত ধরনের হয়। এছাড়া গলার দু’ধারে অবস্থিত কোনো লসিকা গ্রন্থির হঠাৎ উদ্ভব হতে পারে বা পূর্ববর্ণিত কোনো পারিপার্শ্বিক অঙ্গের কর্মপ্রক্রিয়ায় বাধা পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে অতিসত্বর কোনো চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ বিশেষ প্রয়োজন। কারণ থাইরয়েড। কারণ থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যানসার হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে সেরে যায় বা জীবনকাল প্রলম্বিত করা যায়। এই সব ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে যে যে পরীক্ষা করা উচিত তা হল থাইরয়েড গ্রন্থির আলট্রাসোনোগ্রাফি  এবং এফ.এন.এ বা ফাইন নিডিল অ্যাসপিরেশন। ক্যানসার হলে তাড়াতাড়ি অপারেশনের মাধ্যমে থাইরয়েড গ্রন্থি প্রায় সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বেশি ডোজে রেডিও অ্যাক্টিভ আয়োডিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ সেরে গেলেও সামান্য কয়েক ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এর চিকিৎসা বেশ জটিল এবং বেশি দেরি হলে সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক কম। থাইরয়েড গ্রন্থি প্রায় সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেবার পর আজীবন থাইররিক্সন জাতীয় ওষুধ খাবার প্রয়োজন হয়।

এছাড়াও একটি বিশেষ রোগ হতে পারে, গ্রন্থির ভেতর কোনো অংশে জলীয় পদার্থ জমে যেতে পারে, যার নাম থাইরয়েড সিস্ট। এটিও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

পরিশেষে জানাই, থাইরয়েডের রোগ নিয়ে জনমানসে রয়েছে নানারকম ভূল ধারণা। এই গ্রন্থির অধিকাংশ রোগের চিকিৎসা করায়ত্ত। কাজেই অহেতুক ভয় না পেয়ে এবং গুজব না ছড়িয়ে যত শীঘ্র সম্ভব চিকিৎসা করলে এই রোগের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সম্ভব। ক্রমবর্ধমান থাইরয়েডের রোগ হয়তো ক্রমবর্ধমান জনসচেতনতা আর তার সাথে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতিগত উন্নতি ও সহজলভ্যতার ফসল।

সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন