থাইরয়েড: নিরাময়ে যোগাসন
ডাঃ দিব্যসুন্দর দাস
2019-03-22 15:40:14
আজকের যুগে থাইরয়েডের অসুখ খুব পরিচিত। অনেকে মনে করেন এ রোগ বংশগত। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই রোগের কোনো বংশগত কারণ নেই। প্রধানত চারটি কারণে থাইরয়েডের অসুখ হয়ে থাকে। যেমন, আনডেভেলপ থাইরয়েড গ্ল্যান্ড (অপরিণত থাইরয়েড গ্রন্থি), আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি (আয়োডিনের অভাব), অটো ইমিউন ডিসঅর্ডার (প্রতিরক্ষা বা আনক্রম্যতার গোলযোগ), টি.এস.এইচ ডেফিসিয়েন্সি (থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের অভাব)।
অল্প বয়সে রোগটি হলে ক্রেটিনিজম। বেশি বয়সে হলে মিক্সিডিমা। এগুলি হাইপো থাইরয়েডিজমের অন্তর্গত অর্থাৎ হরমোন নিঃসরণ কম হয়। হরমোন নিঃসরণ বেড়ে গেলে বলে হাইপার থাইরয়েডিজম, অনিয়ন্ত্রিত ও ক্ষতিকর বৃদ্ধির নামই হল ক্যানসার। থাইরয়েডেও ক্যানসার হয়।আবার নির্দোষ বা বিনাই্ন টিউমার হতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থি প্রদাহ, যাকে বলে সাব-অ্যাকিউট থাইরয়েডাইটিস যা প্রধানত ভাইরাসঘটিত কারণে হয়ে থাকে। এছাড়া থাইরোগ্লসালসিস্ট, ব্যাক্টেরিয়াল থাইরয়েডাইটিসের মতো রোগ হয়। থাইরয়েডের অসুখ বললে তিন রকমের সমস্যার কথা বলতে হয়। যেমন—
- থাইরয়েড গ্রন্থিটি আকারে বড় হয়ে থাকলে গয়টারবা গলগন্ড।
- থাইরয়েড গ্রন্থিটি কম কাজ করলে বলা হয় হাইপো-থাইরয়েডিজম।
- গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থিটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজ করলে হাইপার থাইরয়েডিজম বলা হয়।
এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। যেকোনো বয়সে যেকোনো মানুষের এই রোগ হতে পারে। সাধারণত মহিলারাই এই রোগে বেশি ভোগেন। জন্মাবার পর ছোট বাচ্চারাও এই রোগে ভুগতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের এই রোগ বেশি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।তুলনামূলকভাবে কুড়ি থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সীদের এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
থাইরয়েড নিরাময়ে যোগাসন প্রভৃতি উপকার দেয়। উপযুক্ত যোগ প্রশিক্ষকের পরামর্শে বেশি কিছু যোগাসন নিয়মিত অনুশীলন করলে থাইরয়েড মোকাবিলা করা যায়। যোগানগুলো হল যথাক্রমে পবনমুক্তাসন, হলাসন, মৎস্যাসন, উষ্ট্রাসন. সর্বাঙ্গাসন, সিংহাসন, জালন্ধরে সিংহাসন, শবাসন।
পবনমুক্তাসন:
পদ্ধতি” চিৎ হয়ে শুয়ে প্রথমে ডান-পা হাঁটু থেকে ভাঁজ করে পেট ও বুকের সঙ্গে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরুন। হাঁটু জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিতে ডান হাতের তালু বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপর এবং বাঁ-হাতের তালু ডান হাতের কনুইয়ের ওপর রাখুন। যদি হাতের চেটা দিয়ে অপর কনুই ধরা সম্ভব না হয় তবে এক হাতের আঙুল অপর হাতের আঙুল গলিয়ে দিয়ে ধরবেন। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ শুনুন। এরূপ বাঁ-পা ধরে এবং পরে দু’পা। এরপর শবাসনে বিশ্রাম। এভাবে তিনবার। যারা খুব রোগা-পাতলা, তারা তোয়ালে ভাঁজ করে দিলে পেটে চাপ পড়ে।
হলাসন:
পদ্ধতি: চিৎ হয়ে শুয়ে হাত দুটি পাশে রাখুন। পা-দুটি জোড়া অবস্থায় মাটি থেকে তুলে ধীরে ধীরে মাথার পিছনে নিয়ে যান এবং পায়ের আঙুলগুলি মাটিতে ঠেকান। দু’হাটু যেন না বাঁকে। চিবুক বুকের সঙ্গে লেগে থাকবে। কেউ কেউ দু’হাত কনুই থেকে মুড়ে হাতের তালু পিঠে রেভে অভ্যাস করেন।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: কেউ কেউ হাত দুটি মাথার ওপর মাটিতে রেখে ডান হাত দিয়ে বাঁ-কনুই এবং বাঁ-হাত দিয়ে ডান কনুই ধরেন। স্বাভাবকি শ্বাস-প্রশ্বাসে এই অবস্থায় মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে ত্রিশ গুনন। এভাবে তিনবার অভ্যাস করুন। প্রতিবার করার পর শবাসনে বিশ্রাম নিন।
উষ্ট্রাসন
পদ্ধতি: হাঁটু গেড়ে (নিলডাউন ভঙ্গিতে) বসুন। পিছনদিকে হেলে দু’হাত দিয়ে পায়েল গোড়ালি ধরে মাথা পিছনের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে পেট সামনের দিকে এগিয়ে দিন। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ডান গোড়ালির ভিতর দিক ও অন্যান্য আঙুলগুলো বাইরের দিকে থাকবে। এবং বাঁ-হাত বাঁ-গোড়ালির ওপর অনুরূপভাবে থাকবে। পায়ের পাতা মাটিকে পাতা থাকবে। স্বাভাবকি শ্বাস-প্রশ্বাসে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ গোনার পর শবাসন বিশ্রাম নিতে হবে। এরূপ তিনবার।
মৎস্যাসন
পদ্ধতি: পদ্মাসন করে দুটো কনুইয়ের সাহায্যে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটো মাথার দু’পাশে মাটিতে রেখে তার ওপর ভর দিয়ে পিঠটাকে মাটি থেকে তলুন। ঘাড় হেলিয়ে দিয়ে মাথার তালু মাটির ওপর রাখুন। এবার দু’হাত দিয়ে দু’পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে টানুন আর বুক উচু করুন। কনুই মাটিতে লাগান। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ গুনন। এরপর থেকে মাথার পাশে এনে পিঠ আলগা ও মাথা সোজা করে শবাসনে বিশ্রাম নিন। এরূপ তিনবার।
সর্বাঙ্গাসন
পদ্ধতি:: বিপরীতকরণীর মতো দু’পা সোজা করে ওপরে তুলন। দ’হাতের চেটো দিয়ে পিঠকে ঠেলে ধরুন। পিঠকে এমনভাবে ঠেলে ধরুন যেন ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত এক সরলরেখায় থাকে। চিবুক বুকের সঙ্গে লেগে থাকবে। দৃষ্টি থাকবে পায়ের আঙুলের দিকে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে ত্রিশ গুনন। শবাসন বিশ্রাম নিন। এভাবে তিনবার অভ্যাস করুন।
সিংহাসন
পদ্ধতি: প্রথমে বজ্রাসনে বসুন। তারপর গোড়ালি ও পায়ের পাতা দুটি ফাক করে নিতম্বের দু’পাশে রেখে মাটিতে বসুন। গোড়ালি নিতম্বের সঙ্গে লেগে থাকবে ও পায়ের পাতা পাশে ফেরানো থাকবে। হাটু দুটি জোড়া থাকবে। দু’হাত দু’হাটুর ওপর রাখুন। হা করে জিভ যতদূর সম্ভব বার করুন। চিবুক কন্ঠ সংলগ্ন রাখুন। এ অবস্থায় মুখ দিয়ে শ্বাস নিয়ে গলার ছয় গোনা পর্যন্ত ‘অ্যা’ শব্দ করতে করতে শ্বাস ছাড়ুন। এরূপ পর পর ছ’বার অভ্যাস করুন। তাপর শবাসনে বিশ্রাম নিন।
জালন্ধরে সিংহাসন
পদ্ধতি : কন্ঠে চিবুক লাগানোকে জালন্ধর বলে। এতে কন্ঠ রোধ হয়। খাদ্যনালী ও শ্বাসনালীর পধ রুদ্ধ হয়। এই অংশে থাইরয়েড গ্রন্থির ওপরও চাপ পড়ে। ফলে সাময়িক রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। চিবুক শিথিল করে দিলে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি ঘটে। ফলে থাইরয়েড গ্রন্থির পুষ্টি বৃদ্ধি, কর্মক্ষমতা সুনিয়ন্ত্রিত হয়। থাইরয়েড গ্রন্থির সুস্থতা বজায় থাকে। সিংহাসন করে ওই অবস্থায় কন্ঠে চিবুক স্থাপন বা জালন্ধর বা জালন্ধরে সিংহাসন বলা হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, যোগাশাস্ত্র মতে, তিনপ্রকার বন্ধের মধ্যে জালন্থর বন্ধ অন্যতম। অন্য দু’প্রকার বন্ধ হল উড্ডীয়ান বন্ধ এবং মূলবন্ধ। বাহুল্যরোধে লেখা হল না।
শবাসন
পদ্ধতি : চিৎ হয়ে শুয়ে পা দুটো লম্বা করে ছড়িয়ে দিন। হাত দুটো শরীরের দু’পাশে দেহসংলগ্ন রাখুন। হাতের চেটো। শিথিলভাবে থাকবে। হাত, পা , দেহ অবশ হয়ে গেছে এরূপ ভেবে মৃত ব্যক্তির মতো শুয়ে থাকুন। যে আসন যতবার ও যতক্ষণ অভ্যাস করবেন, শবাসনেও ঠিক ততবার ও ততক্ষণ অবশ্যই বিশ্রাম নেবেন। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে।
দ্বিতীয় পদ্ধতি : আর এক প্রকার শবাসন করা যায়। তা হচ্ছে উপুড় হয়ে শুয়ে মাটিতে কান পেতে সমস্ত শরীর শিথিল করে শুয়ে থাকা। দু’ হাত শরীরের দু’পাশে সংলগ্ন থাকবে। হাতের চেটো শিথিলভাবে পাতা থাকবে। যে সকল আসন উপুড় হয়ে শুয়ে করতে হয় সে সকল আসনের পর এই শবাসন অবশ্য করণীয়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন