গর্ভাবস্থায় অত্যধিক বমি হতে পারে লিভারের গন্ডগোল
ডাঃ সবুজ সেনগুপ্ত
2019-03-27 11:27:00
হাইপার এমেসিস গ্র্যাভিডেরাম। কি খটমটে নাম রে বাবা। মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতোই। আরো বেশি মাধা ঘুরে যাবারা আগেই বলে দিই এটার অর্থ হচ্ছে মাতৃত্বের সূত্রপাতেই প্রচন্ড বমি। একটু-আধটু বমি প্রায় প্রত্যেকেরই হয় কিন্তু প্রচন্ড বমি যা মাকে প্রায় বিছানায় শুইয়ে দেয়, সেটার নামই হচ্ছে হা্পারএমেসিস।
কেন যে কারো কারো এত বেশি বমি হয়, পন্ডিতরা তা নিয়ে ভেবেছেন কিন্তু ঠিক ধরতে পারেননি। কোনো কারণ ধরতে না পারলেই ডাক্তারদের স্বভাব হচ্ছে সেটাকে ‘মানসিক কারণ বলে দেগে দেওয়া”।
কতখানি গুরুতর এ অসুখটা বোঝা খুব মুশকিল যদি না ক্রমাগত বমির ধাক্কায় মা একেবারে কাহিল হয়ে পড়ে। অত্যন্ত ওজন কমে যাওয়া, শরীরের জলীয় ভাগ কমে যাওয়া, যেটা দেখলেই বোঝা যাবে মা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু তখন তো অনেকটা অসুস্থ হয়েই পড়েছে মা। তার মানে অনেকটা অসুস্থ হয়ে না পড়লে সাধারণত কেউ পাত্তাই দেয় না।
বহু শতাব্দী আগে থেকেই সবাই জানত যে মা হতে গেলেই এরকম অসুস্থতা হতে পারে কিন্তু প্রথমে এ নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখা কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পাওয়া যায় না। শুধু আমেরিকাতেই বছরে প্রায় ৬০০০০ কেসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ সংখ্যা তো শুধু যে মায়ের কষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের তো ধরা হয়নি যারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করিয়েছেন বা বহির্বিভাগে দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে চলে গেছেন। সুতরাং সত্যিকারের সংখ্যাটা অনেক অনেক বেশি। আর এটা মোটেও উড়িয়ে দেবার মতো অসুখ নয়। ঠিক ঠিক মতো চিকিৎসা সঠিক সময়ে না করালে রোগী চরম হতাশার মধ্যে ডুবে যেতে পারে।
প্রথম প্রথম ভাবা হয়েছিল অতিরিক্ত বমি হবার কারণ শরীরে কোনো টক্সিন বা বিষাক্ত, দূষিত কিছুর প্রাদুর্ভাব বা কোনো ধরনের সংক্রমণ অথবা কোথাও ক্ষত হবার জন্য। এমনকী গর্ভাধারণের কোনো ক্রটিজনিত সমস্যাও ভাবা হয়েছিল কারণ হিসেবে। কিন্তু ধোপে কোনোটাই টিকল না।
বিংশ শতাব্দীর শুর থেকে এই মানসিক কারণের তত্ত্বটা পন্ডিতদের মাথায় এল। আশ্চর্যের ব্যাপার কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও আজও এই ধারণাটাই কিন্তু বলবল আছে। শারীর বিদ্যায় সব ধরনের ছাত্রদেরই যেমন ফার্মাসিস্ট থেকে নার্স, অ্যালোপ্যাথি থেকে ন্যাচারোপ্যাথি সবেতেই শেখানো হয় যে এটা একটা ব্যাধি যার পেছনে আছে মানসিক বৈকল্য।
সুতরাং আশ্চর্যের ব্যাপার কিছু নেই যখন ‘ও কিছু নয়, সেরে যাবে’ বা ‘বেশি আদিখ্যেতা, অত প্রশ্রয় না দিলেও চলবে’ ইত্যাদি ধারণা আজও চলছে। ফলে ঝকঝকে চেহারার একটি মেয়ে দিন দিন ম্লান থেকে আরও বেশি ম্লান হয়ে হতাশার কোলে ঢলে পড়ে।
প্রতি বছর নতুন নতুন তত্ত্বের আগমন হয়। শরীরে ‘ইস্ট্রোজেন’ হরমোনের আধিক্য বা খাদ্যনালীর ভালব ঢিলে হয়ে যাওয়া—এগুলোও এগিয়ে ধরা হয়েছে কারণ হিসেবে।
কী কী কারণে হতে পারে—
আসল কারণ তো জানাই গেল না শুধু তত্ত্বের বোঝা। তাই নিয়েই আলোচনা করা যাক।
- হরমোন সংক্রান্ত: হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রফিন বলে একটা হরমোনকে দোষী সাবস্ত করা হয়েছে বহুদিন ধরেই। এটা আরও জোরদার হয়েছে এইজন্য যে যমজ বাচ্চা থাকলে বা মোলার প্রেগন্যান্সি বলে একটা ঝঞ্ঝাটের রোগে এই কোরিওনিক গোনাডোট্রফিন লেভেলটা খুব বেড়ে যায় আর তাদের বমিটাও অত্যন্ত বেশি হয়।
ইস্ট্রোজেনের আধিক্য একটা কারণ হতে পারে আগেই বলেছি। বার্থ কনট্রোথ বড়ি খেলে যাদের অত্যন্ত অসুবিধে হয়, দেখা গেছে প্রেগন্যান্সি হলে তাদেরও বমিও বেশি হয়।
প্রেগন্যান্সিতে প্রোজেস্টেরন হরমোনের আধিক্য বেশি হয় এবং তার জন্য পাকস্থলির প্রবেশপথের ভালব ঢিলে হয়ে যায়, এগুলোকেও কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে।
থাইরক্সিন, প্রোল্যাক্টিন এগুলোও তত্ত্ব হিসেবে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে।
- সংক্রমণ : হেলিতোব্যাক্টিরিয়া পাইলারি এক ধরনের জীবাণু। পেপটিক আলসারের সাথে এর সম্পর্ক আছে, যেখানে একই ধরনের লক্ষণ দেখা যায়, সুতরাং একেও দোষী ধরা হবে না কেন?
- খাদ্যনালীর স্বাভাবিক ক্রিয়া বা সংবহন ব্যাহত হয়। কারণ সেই প্রোজেস্টেরন হরমোনের আধিক্য সব ঢিলে করে দেয় বলে। এটা কি কারণ হতে পারে না?
- খাদ্যে শর্করার ভাগ কম থাকলে (যেমন রাতে উপোস দিলে সকালে বমি বেশি হয়) বা ভিটামিন-বি৬, ভিটামিন-বি১, আর প্রোটিনকেও দোষী করা হয়েছে।
- অ্যালার্জি।
- জেনেটিক কারণ : কারণ মেয়ে, বোনদের মধ্যে এক একটা পরিবারে দেখা যায়।
- মানসিক “ সেই সাইকোলজিক্যাল তত্ত্ব। তবে একদম বোধহয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ জায়গা পরিবর্তন করলে হঠাৎ দেখা গেছে বমি একদম বন্ধ বা রোগী একদম সুস্থ।
- লিভারে গোলযোগ : হ্যাঁ, লিভারের কিছু গোলযোগ থাকলেও হতে পারে অত্যধিক বমি।
প্রেগন্যান্সির মধ্যে কিছু অসুখ-বিসুখও হানা দিতে পারে, তখনও এই একই রকম প্রচন্ড বমি চিকিৎসকদের বিভ্রান্ত করতে পারে।
কী কী অসুখে একরকম হতে পারে?
- সার্জিক্যাল
- অ্যাপেন্ডিসাইটিস।
- পেপটিক আলসার
- ইনটেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন।
- গলব্লাপারে সংক্রমণ
- ওভারিয়ান সিস্ট যদি পেচিয়ে যায়।
- জরায়ুতে ফাইব্রয়েডের পচন ধরলে।
- মেডিক্যাল
- মূত্রনালীর সংক্রমণ
- হেপাটাইটিস
- প্যানক্রিয়াটাইটিস
- খাদ্যনালীতে কৃমির প্রাদুর্ভাব।
কী কী পরীক্ষা করতে হবে?
- রক্ত পরীক্ষা : সম্পূর্ণ রক্ত পরীক্ষা, রক্তে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা, সোডিয়াম পটাশিয়াম লেভেল, সিরাম অ্যামাইলেজ ও লাইপেজ পরীক্ষা , লিভার ফাংশন টেস্ট।
- ইউরিন পরীক্ষা।
- আলট্রাসোনোগ্রাফি : যমজ সন্তান বা মোলার প্রেগনেন্সি আছে কি না দেখে নেওয়া।
- ই.সি.জি।
- চক্ষু পরীক্ষা : খুব সাংঘাতিক বমিতে রেটিনাল হেমারেজ হয়েছে কি না দেখা।
কী করে সামলানো যাবে
- প্রথমেই বমি বন্ধ করার চেষ্টা করতে হবে।
- শরীরের জলীয় ভাব যেটা কমে যাচ্ছে সেটাকে পরিপূরণ করতে হবে।
- অতিরিক্ত বমিতে বাড়াবাড়ি হবার আগেই সেটা নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে।
এটাও দেখা গেছে যে সন্তান সম্ভাবনার আগেই যদি ভিটামিন দেওয়া হয় তো বমির আধিক্য প্রেগনেন্সিতে কম হয়।
যেহেতু ৭০% ক্ষেত্রে এই বমি বমি ভাব নিজের থেকে তিন-চার মাসের মাথায় কমে যায় তাই রোগিণীকে আস্থা দেওয়া, তার মনে সাহস ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি।
বারবার খাও আর কম খাও—এটা কিন্তু খুব কাজে দেবে। আদার কুচি মুখে দিলে অনেকটা বমিভাব কমবে। দৈনন্দিন খাবারে একটু অদল-বদল কিন্তু দারুণ ফল দিতে পারে। ভিটামিন বি৬ যার ডাক্তারি নাম পাইরিডক্সিন অত্যন্ত ভালো ফল দেয়।
অ্যারোমা থেরাপি—ল্যাভেন্ডার, গোলাপ বা আদার গন্ধও কারো কারো ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারে।
আকুপ্রেসার বা হোমিওপ্যাথি—শুনতে পাই নাকি খুব ভালো ফল দেয়। তবে আমার অভিজ্ঞাতা এ বিষয়ে কম।
এই তো ক’দিন আগেই ইংল্যান্ডে রাজপরিবারে নতুন আগন্তুক এল। কেট সন্তান সম্ভাবা হবার সাথে সাথেই প্রায় হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলেন এই হাইপার এমেসিস বা অতিরিক্ত বমি নিয়ে। সুতারাং রানীদেরও রেহাই নেই।
বিখ্যাত লেখিকা চার্লট ব্রন্টি যখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, এই হাইপার এমেসিসেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। শোনা যায় তিনি জলও নাকি খেতে পারছিলেন না।
যাইহোক, এত কথা বলার উদ্দেশ্য, অতিরিক্ত বমি মাতৃত্বের শুরুতেই হলে অবহেলা না করে তাকে সাহস জোগাতে হবে আর তাড়াতাড়ি সুচিকিৎসকের মতামত নিয়ে সে যেন হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন