ওভারিতে সিস্ট মানেই অপারেশন না
ডাঃ জয়ন্ত পাল
2019-03-27 11:33:42
কিশোরীদের পি.সি.ও.এস রোগের চিকিৎসা
অনেকটা পঞ্চপ্রদীপের মতো কিশোরীদের চিকিৎসা বলতে বোঝায়—
১. ডায়েট কন্ট্রোল, ২. ব্যায়াম, ৩. মেটরফরমিন ইনসুলিন সেন্সিটাইজার, ৪. ওরাল পিল বা অ্যান্টিঅ্যান্ড্রোজেন বড়ি এবং ৫. ইলেকট্রোলাইসি বা ডি-পাইলেশন এবং বিশেষ মলম যা মুখের চামড়াতে লাগানো হয়।
যেহেতু এই রোগের কোনো সঠিক কারণ নির্ধারিত হয়নি সেজন্য চিকিৎসার দিশা ঠিক করা মুশকিল। এবং নানা কিশোরীর নানারকম ভাবে, চিকিৎসা করা হয়। আর পাঁচটি রোগের মতো এর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। অপারেশনে তো নয়ই।
পি.সি.ও.এস কোনো টিউমার নয়, সেজন্য কখনোই কখনোই অপারেশন নয়
ভারতে বহু কিশোরীর অহেতুক ডিম্বাশয়ের সিস্ট অপারেশন হয়-যা একেবারেই নিন্দনীয় কাজ। দুঃখের কথা বাবা-মায়েরা ভেবে নেন যে তার কন্যার ডিম্বাশয়ে সিস্ট হয়েছে এবং সেই সিস্ট এখনই বাদ না দিলে তার কন্যার ডিম্বাশয়ে দুইটির চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে। কিছু বিচক্ষণ ডাক্তারবাবু জোর গলায় প্রতিবাদ করলে তখন সংশ্লিষ্ট বাবা-মা অন্য ডাক্তারবাবুকে ম্যানেজ করে অপারেশন করিয়ে নিয়ে ভাবেন—যাক কন্যার তা হলে রোগমুক্তি হল। কিন্তু এদের প্রায় প্রত্যেকেরই দু’চার বছর পর ফের সিস্ট হয়। সেজন্য বলা যে, পি.সি.ও.এস (পলিসিস্টিক ওভারি) কোনো টিউমার জাতের ব্যাধি নয় এবং এই রোগের জন্য অপারেশন একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।
ওজন কমাতে হবে
পি.সি.ও.এস রোগে বিশেষত যে সব কিশোরী স্থূলকায়া তাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও নিয়মিত ব্যায়াম খুবই জরুরি। এ নিয়ে বাংলা ভাষাতেই হাজার প্রবন্থ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক এমন স্থূলকায়া পি.সি.ও.এস কিশোরীর দেখাও পেয়েছেন যাকে ব্যারিয়াটিক সার্জারি করে চর্বি বাদ দিতে হয়েছে।
শরীরে বাড়তি পুং-হরমোন কমাতে হবে
এর জন্য দুই শ্রেণীর ওষুধ আছে। প্রথমত গর্ভরোধক বড়ি, দ্বিতীয়ত অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন বড়ি। গর্ভরোধক বড়ি ডিম্বাশয়ে পুং-হরমোন তৈরি কমায়। এই উদ্দেশ্যে সাধারণত ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ বড়ি ব্যবহার করা হয়। কমপক্ষে ৬ মাস থেকে এক বছর ওরাল পিল খেতে হবে। এর ছয় মাসের আগে উপশম চোখে পড়বে না। বড়ি খেলে অনেকেরই ব্রণ এবং চুল পড়া কমে যায়।
অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন জাতীয় ওষুধ
অনেক সময় গর্ভরোধক বড়িতে ব্রণ কমে না, অবাঞ্চিত লোমের সমস্যাও দূর হয় না। তখন গর্ভরোধক বড়ি বাদ দিয়ে অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন জাতীয় কিছুটা অপ্রচলিত ওষুধ লিখতে হয়। আবার অনেক কিশোরী বা তার মা তার অবিবাহিতা কন্যাকে গর্ভরোধক বড়ি খাওয়াতে অস্বীকার করনে। গ্রামের মায়েদের এই ব্যাপারে রাজি করানো বেশ মুশকিল। সেই সব মায়েরা ভেবেই নেন যে আমার অবিবাহিতা মেয়ের রোগটা ডাক্তারবাবুরা ঠিক মন দিয়ে শোনেননি বা শুনলেও রোধ ধরতে পারেননি।
সে যাই হোক, স্বল্প সংখ্যক পি.সি.ও.এস কিশোরী অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন বড়ি খেতে দেওয়া হয়। এই ধরনের বড়িগুলি মূখ্যত কাজ করে ত্বকের ওপর সোজাসুজি। এই ওষুধগুলি সব ত্বকে অ্যান্ড্রোজেন উৎসেচকের (এনজাইম) ওপর বা অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের গ্রাহক কোষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে, এনজাইমা বা গ্রাহক কোষকে অনেকটাই ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
রক্তে পুং-হরমোন না কমলেও চামড়াতে পুং-হরমোনের প্রতিফলন কমিয়ে দেয়। ফলে এই ধরনের অ্যান্টি অ্যান্ডোজেন বড়ি খেলে ব্রণ যেমন কমে তেমনি কমে অবাঞ্চিত লোম। চুলপড়াও অনেকের বন্থ হয়।
এইসব ওষুধ খাবার পরে মুখের লোম উধাও হয়ে যাবার ফলে এবং ব্রণ কমে যাবার দরুন বিশোরীটি পুনরায় স্বাভাবিক জীবনযাপন অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কী সেই সব ওষুধ যেগুলি মুখে খেলে লোম কমায় ? সেগুলি হচ্ছে—১. সিপ্রোটেরোন অ্যাসিটেট, ২. স্পাইরোল্যাকটোন, ৩. ফ্লুটামইড জফিনাসটেরাইড, ৫. মিগ্র/প্রত্যহ এবং ৬. ওজকিটাকেনাজোল।
ওরাল পিল সাথে অ্যান্টি অ্যান্ড্রোজেন বড়ি বেশ কিছু ডাক্তারবাবু গর্ভরোধক বড়ির সাথে অ্যালডাকটিন জাতীয় ওষুধ খেতে বলেন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবু তত্ত্বাবধানে মেটফরমিন ও সিপ্রোটেরোন অ্যাসিটেট একসাথে খেতে হতে পারে। মেটফরমিন কমাবে অত্যধিক ইনসুলিন এবং সিপ্রোটেরোন অ্যাসিটেট কমাবে অত্যধিক পুং-হরমোনের প্রভাব।
ফেসিয়াল করতে হবে বৈকি
গালে অত্যধিক ব্রণ হলে তখন ওষুধ গর্ভরোধক বড়ি বা অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন বড়ি খাবার সাথে প্রথম দু’চার মাস উচ্চমানের পার্লারে যেতে হবে। নতুবা চুলের রেখার জন্য লজ্জায় কলেজ কামাই হবে। ওই দুই শ্রেণীর বড়ি খেলে লোমের ব্যাপারে উপশম পেতে পেতে প্রায় পাঁচ-ছ’মাস লেগে যায়। ওই প্রথম ছ’মাস অত্যধিক লোম বা ব্রণর জন্য যাতে সামাজিক জীবনযাপন মুখ ইতিমধ্যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে বা যাদের ঠোঁটে বা চিবুকে বেশ কালো চুলের রেখা স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। ওড়না দিয়ে তো আর সব সময় চিবুক ঢাকা থাকে না। ফুল-হাতা ব্লাউজ পরে হাতের লোম ঢাকবেন—এই উপদেশ দিয়ে লেখক বার কয়েক কিশোরীদের কাছে মারধোর খাওয়ার পর এখন আর কোনো কিশোরীকে ফুলহাতা ব্লাউজ পরার উপদেশ দেন না। বরং লেজার পদ্ধতিতে নামী পার্লারে ফেসিয়াল করতে উপদেশ দেন। সাথে অবশ্যই গর্ভরোধক বড়ি বা অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন বড়ি চালিয়ে যাবার উপদেন দেন।
ত্বকের ডাক্তারবাবুর বিধান মতো ওয়াক্সি, প্লাকিং, সেভিং, ডেপিলেশন, ইলেকট্রোলাইসিস বা লেজার থেরাপি করে অবাঞ্ছিত লোমের সমস্যা সাময়িকভাবে দূর করা যাবে।
মুখের লোম বা ব্রণ কমাবার নিমিত্ত মলমসমূহ
১. ডেপিলেটরি ক্রিম চুম কমায়। এই উদ্দেশ্যে বাইরের দেশে Difluoro-methly-ornithine (DMFO) ক্রিমের চল খুব বেশি। Eflornithine Cream 13.9% এই মলম দিনে দু’বার লাগাদে হবে মোট ৬ মাস।
২. মেটফরমিন : যেসব কিশোরী ওরই মধ্যে একটু স্থূলকায়া (বি.এম.আই>২৬) এবং ব্যায়াম করে ও খাদ্যাভ্যাস বদলিয়েও যে কিশোরীর ওজন কমছে না, তাদের মেটফরমিন জাতীয় ওষুধ ছ’মাস থেকে এক বছর যাবত খেতে দেওয়া হয়। অনেকে মাঝে মাঝে এইরূপ ওষুধ খাবার বিধান দেন। তবে লিভার ফাংশন ও কিডনি ফাংশন স্বাভাবিক হওয়া চাই এবং ছ’মাস অন্তর সেসব মাপকাঠির পরিবর্তন হচ্ছে কি না তা দেখে নিতে হবে। মেটফরমিন খেলে ওজন যেমন কমবে, তেমনি অনেক সময় রজঃস্ব ঠিক ছন্দে ফিরে এসে কিশোরিটিকে স্বস্তি দেয়।
বিবাহিতা পি.সি.ও.এস-দের ক্ষেত্রে এখনও মেরফরমিন ওষুধের চল থাকলেও অবিবাহিতদের মধ্যে এই ওষুধ দেওয়া উচিত কি না তা নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক শুরু হয়েছে। লেখত নিজে অবিবাহিতাদের মেটফরমিন দেবার পক্ষে নন। তবে আপনার নিজস্ব ডাক্তারবাবু যা বলবেন তাই মেনে নেবেন।
নীচে দেওয়া সারণি থেকে বোঝা যাবে যে একটি বিশেষ পি.সি.ও.এস কিশোরীর কোন উপসর্গ বেশি সেইমতো ওষুধ দিতে হবে। যাতে করে কিশোরীটির সেলফ ইমেজ নষ্ট না হয়।
কী কী উপসর্গ হচ্ছে
১. ব্রণ থাকলে বা অবাঞ্ছিত লোম থাকলে.
২. দিনের পর দিন অনিয়মিত রজঃস্রাব বা অত্যধিক রজঃস্রাব।
৩.স্থূলকায়া পি.সি.ও.এস কিশোরী।
৪. ঘাড়ের পিছনে চামড়াতে কালো মোটা দাগ থাকলে।
কী পদক্ষেপ নিতে হবে
১. সিপ্রোটেরোন দেওয়া ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ বা অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন বড়ি। সাথে প্রয়োজনে ব্রণ কমাবার মলম।
২. ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল
৩. ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাসের অদলবদল ও বিশেষ প্রয়োজন মেটফরমিন।
৪. মেটফরমিন, ডায়েট কনট্রোল।
বিবাহটা আগাম সেরে নিন
যাদের ভালো রকম পি.সি.ও.এস আছে তাদের খুব দেরি করে বিবাহ বা সন্তান নেওয়া ঠিক হবে না । কারণ যতই দিন যাবে ততিই ডিম্বাশয়ের অবস্থা সঙ্গীন হবে।
পারলে ২৩-২৪ বছর বয়সে বিবাহ সেরে নিয়ে দু’এক বছরের মধ্যে প্রথম সন্তান নিয়ে নেওয়া ভালো হবে। নতুবা পরবর্তীকালে ক্লোমিফেন এবং মেটফরমিন, এমনকী আই.ভি.এফ এবং প্রয়োজনে আই.ভি.এম পদ্ধতিও প্রয়োগ করতে হতে পারে। যা করতে গিয়ে হয়তো বা নিজের সাধের গয়নাগুলোও বিক্রি হয়ে যাবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন