টিবি ছাড়া আরও অনেক অসুখ কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ে
ডাঃ গৌতম সাহা
2019-04-17 15:45:47
সৃষ্টিধরের শরীরটা মোটেই ভালো যাচ্ছে না। মাস তিনেক যাবত ঘুসঘুসে জ্বর। সন্ধের দিকে বেশ বাড়ে। রাতের দিকে ছেড়ে যায়। প্রচুর ঘাম-বিছানা, বালিশ ভিজে এক-সা হয় তখন। গত এক মাস ধরে বুকে পিঠে ব্যথা, সঙ্গে কাশি। খিদে কমে গেছে। মনে হয় দিন-দিন ওজনটাও কমছে। শরীরে মোটেই বল পাচ্ছে না সৃষ্টিধর। মাঠের কাজেও শক্তি নেই। তিনদিন কাজেই যেতে পারেনিও। গতকাল থেকে আবার কাশির সঙ্গে চাপ-চাপ রক্ত।
রক্ত দেখে ভয় পেয়ে যায় সৃষ্টিধর। এতদিন গা করেনি। হাতুড়ে ডাক্তার নিতাইয়ের কাছ থেকে টুকটাক পুরিয়া, শিশির ওষুধ এনে খাচ্ছিল। কিছুটা আরাম পেত, তবে একেবারে সেরে যেত না।
ভয় একা সৃষ্টিধরই পায়নি। ময়নাও পেয়েছে। বলে, ‘ওগো কালকেই চল, শহরে যাই। বড় ডাক্তার দেখাই। রক্ত পরীক্ষা, বুকের ফটো যা করতে হয় করে নিই গে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা মা-মায়েতে কোথায় যাব?’
সৃষ্টিধর বলে, ‘এসব করতে পয়সা লাগে না? মাগনা করে দেবে নাকি তোর শহরের ডাক্তাররা? বুকের ফটো, রক্ত পরীক্ষা করতে তো আমাদের নেতাই ডাক্তারও বলেছিল।’
ময়না আঁচলে চোখ মোছে, ‘রূপোর হারটা না হয় বেচেই দাও।’
সৃষ্টিধর বল, ‘ও-তে ক’টাকাই বা আসবে শুনি?
ময়না কেঁদে ফেলে, ‘তাহলে যা হয় একটা কিছু করো।
শহরে আনতে আনতে সৃষ্টিধরের বেশ বাড়াবাড়িই হয়। কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া বেড়েই চলে। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় সরকারি হাসপাতালে। সেখানে অবস্থায় সেরকম উন্নতি না হওয়ায় ধার-দেনা করে স্থানীয় একটি নাসিংহোমে ভতি করা হয় সৃষ্টিধরকে।
প্র্যাক্টিসের এক বছর পূর্ণ হল গেল মাসে। ব্লু-ভিউ নার্সিংহোম পেশেন্ট ভর্তি রাখি। এক সন্ধেয় রাউন্ড সেরে অফিসঘরে বসে প্রেসক্রিপশন লিখছি। এমন সময় ডক্টর মিত্র এলেন।
উঠে দাঁড়ালাম, ‘গুড ইভনিং স্যার।’
‘গুড ইভনিং’, পিঠ চাপড়ে বললেন ডক্টর মিত্র।
‘ভালো আছ তো? তোমার পেশেন্ট ভর্তি আছে বুঝি ‘
‘হ্যা স্যার।’
‘কী কেস ?’
‘হেমাপটিসিস।’
‘ডায়াগনোসিস হয়েছে?’
‘ইয়েস স্যার, কক্স।’
‘ইউ মিন পালমোনারি টিউবারকিউলোসিস।’
ডক্টর মিত্র বসলেন। ওর রাউন্ড তখনও বাকি। একটু থেমে বললেন, ‘আচ্ছা, তোমরা তো বেশ পড়াশোনা করো। বলো তো, হোয়াট আর দ্য কজেজ অফ হেমাপটিসিস’
হেমপটিসিস মানে হল কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া বা ‘রক্ত-কাশি’। কাছাকাছি শুনতে আর একটি সিমটম আছে যাকে বলে হেমাটেমেসিস অর্থাৎ রক্ত-বমি। রোগীরা অনেক সময় গুলিয়ে ফেলেন। ভালো করে রোগের ইতিহাস (কেস-হিস্ট্রি) নিয়ে তফাৎ করতে হয় হেমেটেমেসিস থেকে হেমাপটিসিস।
ডক্টর মিত্রের প্রশ্নের উত্তরে এক এক করে উল্লেখযোগ্য যতগুলো কারণ জানি বলে গেলাম। যেমন—
- শ্বাসনালী ও শ্বাসযন্ত্রঘটিত
- সংক্রমণজনিত---
অ্যাকিউট ব্রষ্কাইটিস, অ্যাকিউট অন ক্রনিক ব্রষ্কাইটিস, ব্রষ্কিয়েকটেসিস, পালমোনারি টিউবারকিউলোসিস (টিবি) বা যক্ষ্ম, সাপুরেটিভ নিউমোনিয়া, লাং অ্যাবসেস বা ফুসফুসের ফোঁড়া।
- টিউমার, ক্যানসার---
ব্রষ্কিয়াল অ্যাডেনোমা, ব্রষ্কোজেনিক কার্সিনোমা (ক্যানসার)।
- অন্যান্য---
চোট-আঘাত (ট্রমা), ফরেন বডি, পালমোনারি ইনফার্কশন।
- হৃদপন্ত্রের কারণ
মাই ট্রাল স্টেনোসিস, এয়োরটিক অ্যানিউরিজম, অ্যাকিউট লেফট ভেন্ট্রিকিউলার ফেলিওর।
- রক্ততঞ্চন ঘটিত সমস্যা ও অন্যান্য
লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যানসার, হিমোফিলিয়া, থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া ইত্যাদি।
মন দিয়ে সব শুনলেন ডক্টর মিত্র। তারপর বললেন, ‘বেশ বলেছ। অবশ্য আরও দু-একটি কারণ আছে। তবে তোমাদের জানার কথা নয়।’
চুপ করে রইলাম। উনি বললেন, ‘তাহলে একটা ঘটনা বলি, শোনো।
আমি তখন ইংল্যান্ডে। লন্ডনে এম.আর.সি.পি করছি। একটা হাসপাতালের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের রেজিস্ট্রার হয়ে আছি। একদিন ডিপার্টমেন্টের রেজিস্ট্রার হয়ে আছি। একদিন এমার্জেন্সি থেকে একটি পেশেন্ট ভর্তি হল। এ কেস অফ হেমপটিসিস। হতদরিদ্র এক মহিলা। পথের ভিখারিণী। নাম লিজা। টাইটেল নেই। স্ট্রিট-বেগারদের আবার পদবি ! কোনো কালে কোনো দেশেই থাকে না।
সমস্ত ইনফেস্টিগেশন পাঠানো হল। এক্স-রে টেস্ট, মান্টু টেস্ট ইত্যাদি। এমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট দিলাম। এক রাতের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ। দু’ দিনের মধ্যে সব রিপোর্ট চলে এল। এভরিথিং ওয়াজ ও-কে।
বস প্রফেসর ব্রাউন সব দেখেশুনে তিন দিনের মাথায় বললেন, ‘রিলিজিং হার---পেশেন্টকে ছুটিদিয়ে দাও। আর কোনো ভয় নেই। ও বিপম্মুক্ত। ফলো-আপের জন্য আউটডোরে আসতে বলো।’
বললাম, কিন্তু স্যার, ডায়াগনোসিস কী লিখব?’ প্রফেসর বললেন, ‘লেখো, হেমাপটিসিস ফর ইনভেস্টিগেশন।’
মান্টু টেস্টের জন্য তিনদিন সময় রাখা হয়েছিল। রিপোর্ট এল। রেজাল্ট—নেগেটিভ। আর রাখার দরকার নেই পেশেন্টকে। এর পরবর্তী চিকিৎসা আউট পেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট বা ওপিডি থেকেই হবে। প্রফেসর ব্রাউনের স্পষ্ট ইঙ্গিত।
ওদিকে পেশেন্ট কিন্তু দিব্যি আছে। দু’ বেলা পেট পুরে খাবার---লাঞ্চ, ডিনার। সকাল-সন্ধে ডিম, পাউরুটি, দুধ, কলা। তার কাছে অনেক। ভালো-ভালো খাবারেই সে ভালো হয়ে গেছে। আর আমরা কত কী ডায়াগনোসিস ভাবছিলাম! গরিব, খেতে পায় না, অপুষ্টিতে ভুগছে----টিবি না হয়ে যায় না। যা চেহারা—নির্ঘাত যক্ষ্মা। ডিফারেনসিয়াল ডায়াগনোসিসের মানে অন্যান্য সম্ভাবনার মধ্যে ব্রষ্কোজেনিক কার্সিনোমার মতো ক্যানসারকেও রেখেছিলাম। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পৌঁছতেই রোগীকে ছেড়ে দিতে হবে। পরে যদি আউটডোরে ফলো-আপে না আসে? ভেবেই একটু দমে গেলাম।
সকালে রাউন্ডে এসে প্রফেসর ব্রাউন পেশেন্টকে ছুটি দিতে বলে তো চলে গেলেন। মনে খুতখুঁতনি নিয়ে ইুভিনিং রাউন্ডে এসে পৌঁছতেই সিস্টার বললেন, ‘হ্যালো ডক্টর মিত্র, আপনার পেশেন্টের আবার কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ছে।’
বললাম, ‘ঠিক বলছেন?’
সিস্টার বললেন,‘হ্যাঁ, ঠিক-ই বলছি। আপনি নিজে এসে ুদেখুন না!’
পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ছে?’
লিজা মাথা নাড়ল। রক্ততঞ্চনের ওষুধ হিমোস্ট্যাটিক ইঞ্জেকশন লিখে দিয়ে সিস্টারকে বললাম, ‘ওর কাল ছুটি হচ্ছে না। আপাতত থাক।’
পরদিন প্রফেনর ব্রাউন এসে শুনলেন পেশেন্ট আবার ব্লিড করেছে। বললেন, ‘সব ইনভেস্টিগেশন রিপিট করো। যতক্ষণ না কোনো কনক্লুশনে পৌঁছচ্ছি ততদিন ও এখানেই থাক।’
দু’ তিন দিন লেগে গেল সব রিপোর্ট আসতে । কফে টিবি-র জীবাণুটা দেখা বাকি ছিল সেটাও হয়ে গেল এই ফাঁকে। রিপোর্ট—নেগেটিভ।
এদিকে পেশেন্টেরও কোনো কমপ্লেন নেই। খাচ্ছে-দাচ্ছে, ওয়ার্ডময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবার খোঁজখবর নিচ্ছে। সিস্টারদের ফাইফরমাসও খেটে দিচ্ছে। ওয়ার্ডে বেশ পরিচিত হয়ে গেছে লিজা। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে স্বস্থ্যই ফিরে গেছে মেয়েটার। দু’ কেজি ওজনও বেড়েছে। বেশ একটা জৌলুস এসেছে চেহারায়।
ডায়াগনোসিসে পৌঁছতে না পারলেও রোগীর অবস্থার উন্নতি দেখে আমি খুশি। ভারতীয় জল-হাওয়ায় বিশেষত বাংলায় মানুষ-হওয়া ব্যক্তিত্বে স্নেহ মায়া মমতাটা বোধ হয় একটু বেশিই থাকে। মনে মনে বললাম, থাক না বেচারি আরও ক’দিন। অন্তত দুটো খেতে তো পাচ্ছে। ছুটি হয়ে গেল তো আবার সেই ভিখারিণীর জীবন!
কিন্তু প্রফেসর ব্রাউনের অ্যাটিটিউড বেশ ফর্মাল,রিজার্ভড। হসপিটালের বেড অক্যুপাই করে কোনো পেশেন্ট বেশিদিন থাকতে পারবে না। ‘ক্রাইসিস ইজ ওভার, নাউ ডিসচার্জ হার। উই নিডস বেডস।
অগত্য ছুটির কাগজ লিখতে সন্ধেবেলা রাউন্ড শেষে টেবিলে বসেছি। হঠাৎ নার্স চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ডক্টর মিত্র, তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ। পেশেন্টের আবারও ব্লিডিং হচ্ছে !’
ছুটে গেলাম। দেখি, লিজা কাশছে, সঙ্গে রক্ত। ইঞ্জেকশন, ওষুধের ব্যবস্থা লিখে ‘ডিসচার্জ’ স্থগিত করে রাখলাম।
পরদিন সকালে প্রফেনর ব্রাউন পেশেন্টকে বেডে দেখে বললেন, ‘ও এখনও এখানে আছে দেখছি! এনি প্রবলেম?’
বললাম, ‘স্যার, কাল সন্ধেবেলা ওর আবার কাশির সঙ্গে রক্ত পড়েছে।’
প্রফেসর একটু ভাবলেন। তারপর নার্সকে বললেন, ‘মাই ডিয়ার সিস্টার, একটা স্প্যাচুলা ও একটা টর্চ আনবেন প্লিজ।!
জিভ নামিয়ে গলার ভিতরটা ভালো করে দেখার জন্য চামচের মতো ছোট যন্ত্র ‘স্প্যাচুলা’ এল। প্রফেসর বাঁ হাতে টাং-ডিপ্রেসারটা নিয়ে লিজার জিভটা চেপে গলার ভিতরে টর্চের আলো ফেলে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। ব্রাউনের চোখ লিজার গলায়, লিজার ভয়-ভয় চোখ ব্রাউনের মুখে, আর আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানার জন্য।
এক সময়ে প্রফেসরের পরীক্ষা শেষ হল। নিজের দেখা শেষ করে আমাকে ডাকলেন, ‘লাল দাগগুলো দেখতে পাচ্ছ? এগুলো সব প্রিকিং মার্কস। নিউ অ্যান্ড ওল্ড বোথ। ‘আমরা অবাক!
এর পরের পনেরো মিনিট গোয়েন্দা-গল্পের রহস্য উম্মোচনের মতো। প্রফেসর ব্রাউনের জোর জেরা ও চাপের মুখে লিজা ভেঙে পড়লেন। সে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে ছুটির কথা শুনলেই বাথরুমে গিয়ে গলার ভিতর সূঁচ ফুটিয়ে রক্ত বার করে। হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছে এই কৌশলে। কারণটা কোনো শারীরিক, মানসিক ব্যাধি নয়। আর্থ-সামাজিক দুরারোগ্য অসুখটিই হল আসল কারণ—দারিদ্র।
পথের ভিখারিণী যেখানে এক বেলাই ভালো করে খেতে পায় না, সেখানে হাসপাতালের বেডে আরামে টিফিন, ‘খাবার’ মিলিয়ে চারবেলা আহার! এই ‘সুখের আশ্রয়’ ছেড়ে আবার পথে নামতে হবে ভাবলেই সেলফ ইনফ্লিকটিং ইনজুরি বা আত্মপীড়ন করে বসে লিজা। দু’ একবার সফল হওয়াতে ওর আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়।
অবশেষে প্রফেসর ব্রাউন লিজাকে শুনিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘এক্ষুনি পুলিশে খবর দাও এবং ওকে তাদের হাতে তুলে দাও।’
তবে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘ডক্টর মিত্র, আফটার অল মেয়েটি আমাদের গেস্ট। অতটা কঠোর হওয়ার প্রয়োজন নেই, বুঝলে? বরং কাল সকালে ওকে রিলিজ করে দাও এবং পরবর্তী আউটডোরের ডেটে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে বলো। ও-কে ’
আমি বললাম, ‘ইয়েস স্যার।’
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন