দৃষ্টি হারানোর আশষ্কা থাকে গ্লুকোমায়
ডাঃ কাঞ্চন কুমার চ্যাটার্জি
2019-04-17 16:00:16
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চোখে যে দু’টো সমস্যা বেশি পরিমাণে দেখা দেয় তার একটি হল ছানি এবং অন্যটি গ্লুকোমা। ছানির দৃষ্টিহীনতা অস্থায়ী এবং সফল অস্ত্রোপচারে আবার চোখের সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে। কিন্তু গ্লুকোমার কারণে অনেক সময়ই স্থায়ী অন্ধত্বের সৃষ্টি হয়। যার থেকে কোনোভাবেই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হয় না। সেই বিচারে গ্লুকোমা অবশ্যই একটি মারাত্মক ব্যাধি।
অক্ষিগোলকের অভ্যন্তরীণ তরল পদার্থের দীর্ঘস্থায়ী চাপ বেড়ে যাওয়ার অবস্থাকেই বলা হয় গ্লুকোমা। অক্ষিগোলকের ভিতরে যে তরল পদার্থ অ্যাকোয়াস হিউমার থাকে, তা যদি বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হয় অথবা সেই তরলের স্বাভাবিক আবর্তন পথে যদি কোনো বাধার সৃষ্টি হয়, তবে চোখে গ্লুকোমার আক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। সাধারণত গ্লুকোমা বয়স্ক মানুষের অসুখ। কিন্তু কোনো কোনো সময় শিশুদের ক্ষেত্রেও এই রোগের আক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। যাকে বলা হয় বুল অফথ্যালমস বা বুফথ্যালমস। শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগের পরিণতি মারাত্মক।
বিভিন্ন কারণে গ্লুকোমা রোগটি হয়ে থাকে। যার মধ্যে চোখের অভ্যন্তরে আকৃতিগত গঠন একটি প্রধান কারণ। চোখের ভিতরে কোনো প্রদাহ ঘটলে বা পরবর্তীকালে সেই চোখে গ্লুকোমার (চোখের তারা অর্থাৎ কর্নিয়ার কোণেও আঘাতজনিত ঘায়ের সৃষ্টি হলে) আক্রমণ ঘটে। ডায়াবেটিক রোগীদের বা রক্তের উচ্চচাপের জন্য রোগীদের চোখে রেটিনার পর্দায় অনেক সময় রক্তক্ষরণ হয় এবং যেসব ক্ষেত্রে কিছুকাল পরে (তিনমাস বা তারও বেশি কিছু সময় পরে) সেই চোখে গ্লুকোমার আক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। চোখে গ্লুকোমার আক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। চোখে ছানি দীঘর্দিন ধরে বেশি পরিমাণে পাকা অবস্থায় থাকলে অনেক ক্ষেত্রে তার থেকেও গ্লুকোমার সৃষ্টি হয় যা চোখের পক্ষে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। চোখের মধ্যে কোনো টিউমার হলে তার জন্য গ্লুকোমার আক্রমণ ঘটে। তাছাড়াও খাদ্যে ভেজাল মেশানোর জন্য চোখে এক ধরনের গ্লুকোমা হয়। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের দেশে সর্ষের তেলে শিয়ালকাঁটার বীজ মেশানোর ফলে উদ্ভূত ‘এপিডেমিক ড্রপসি গ্লুকোমার কথা স্মরণে আছে নিশ্চয়ই। চোখে গ্লুকোমার আক্রমণ ঘটলে তার লক্ষণগুলো বুঝে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা ভীষণ জরুরি। এই রোগে আক্রান্ত রোগী তার চোখের সামনে কোনো বৈদ্যুতিক বাল্বের দিকে তাকালে যেমন রামধনু রঙের নানা বর্ণের ছটার মতো দেখেন। রোগীর মাথায় যন্ত্রণা হয়, চশমার পাওয়ারের দ্রুত পরিবর্তন আসে, চোখের স্বাভাবিক প্রসারিত দৃষ্টিপথে ব্যাঘাত ঘটে। অনেক সময় রোগীর বমি পর্যন্ত হতে দেখা যায়। বুফথ্যালমসে আক্রান্ত শিশুর চোকের তারাটি স্বাভাবিকের থেকে বড় হয়, সে আলোর দিকে তাকাতে পারে না। এবং তার চোখ থেকে সারাক্ষণ জল পড়তে থাকে। চক্ষু চিকিৎসকেরা যন্ত্রের সাহায্যে অক্ষিগোলকের অভ্যন্তরীণ তরলের চাপ সঠিকভাবে মেপে এবং চোখের ভেতর অপটিক নার্ভ, শিরা-উপশিরা ও অন্যান্য টিস্যুর আকৃতিগত গঠন ও অবস্থা লক্ষ্য করে এই রোগের আক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।
গ্লুকোমা রোগের চিকিৎসা দু’রকম। নিয়মিত ওষুধ প্রয়োগ ও শল্য চিকিৎসা। ওষুধের মধ্যে দৈনিক নিয়মিতভাবে চোখে পাইলোকারপিন নাইট্রেট ড্রপ (দু’বার চার শতাংশ) বা টিমোলন ম্যালিয়েট ড্রপ (০.২৫ আ .০৫ শতাংশ) অথবা বিট্যাবেসলিন-হাইড্রোক্লোরাইড ড্রপ (০.৫০ শতাংশ) দেওয়া দরকার। এছাড়া অ্যাসিটাজোলাইড ট্যাবলেটও প্রয়োজনে রোগীকে খাওয়ানো যেতে পারে। এই ওষুধগুলো যথেষ্ট কার্যকরী। রোগীর ক্ষেত্রে এই ওষুধগুলোর সঠিক উপকারিতা উপলব্ধি করার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর তার চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ মাপা এবং তার দৃষ্টিশক্তি সঠিকভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। ওষুধ প্রয়োগ করেও যদি আশানুরূপ ফল না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার একান্তই প্রয়োজন। গ্লুকোমার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সন্দেহ নিরসনে রোগীর উচিত দ্রুত চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন