বারবার গর্ভনাশ, শেষ নয় সব আশা
ডাঃ সবুজ সেনগুপ্ত
2019-04-18 12:25:08
আশাপূর্ণা দেবীর সেই বিখ্যাত উপন্যাসের মেয়েটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। প্রথম গর্ভ নষ্ট হয়ে যেতে সেই কোমলপ্রাণা মেয়েটির কত কষ্ট হয়েছিল। হ্যাঁ, প্রত্যেক মা-ই চান তার গর্ভে যে এসেছে সে যেন পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হয়, অকালে তাকে যেন ঝরে যেতে না হয়। এমন হলে শুধু মায়ের মনেই নয়, সমগ্র পরিবারের মধ্যেই নেমে আসে একটা বিষাদের ছায়া।
বারবার গর্ভনাশ বা যেটাকে বলা হয় রেকারেন্ট প্রেগনেন্সি লস, সেটা তো আরও মর্মান্তিক। উপর্যুপরি এই আঘাতে মা-টির অবস্থা হয় অত্যন্ত করুন আর তেমনি তার বাড়ির লোকজনেরও।
বারবার গর্ভনাশ বা আর.পি.এল দু’রকমের হতে পারে---
- প্রাইমারি : যখন প্রত্যেকটি গর্ভই নষ্ট হয়েছে।
- সেকেন্ডারি : যখন একটি সার্থক জন্ম দেবার পর বাকিগুলো বিনষ্ট হয়েছে।
বারবার গর্ভনাশ বলতে আমরা কতবার বুঝব। প্রথাগত ভাবে তিন বা ততোধিক বার পরপর গর্ভনাশ (কুড়ি সপ্তাহের মধ্যে) হলে তবেই বারবার গর্ভনাশ বলা হয়।
এই গর্ভনাশের সঠিক সংখ্যা বলা খুব মুশকিল। তবুও মোটামুটি ২৫% (সমস্ত গর্ভ ধরলে) গর্ভনাশ হয়েই থাকে।
গর্ভনাশের কারণ
- এপিডেমিওলজিক্যাল
- গর্ভাশয়ের গঠনজিনত
- ইমিউনোলজিক্যাল
- হরমোনজনিত কারণ
- থ্রম্বোফিলিয়া
- সংক্রমণ জনিত
- সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক
- কোনো কারণ ছাড়াই
- এপিডেমিওলজিক্যাল
- বয়স: ৩৫ বছরের পর গর্ভনাশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ৩৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে প্রায় ২০% গর্ভনাশের সম্ভাবনা থাকে। ৪২ বছরের পর সেটা বেড়ে প্রায় ৪০% হতে পারে।
- প্রথম গর্ভ যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে পরপর গর্ভনাশের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে প্রথম গর্ভতে যদি গর্ভনাশের সম্ভাবনা ১০% হয় তো পরপর ১৫%, ২৪%,৪০%, ৫২% এমন হারে সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- জেনেটিক
গর্ভনাশের অন্তত ৫০% কারণ হচ্ছে ক্রোমোজমের কোনো অস্বাভাবিকতা। প্রথম তিনমাসের মধ্যে গর্ভপাত হলে তার অন্তত ৫০% হয় ক্রোমোজমের অস্বাভাবিকতার দরৃণ। আর ২০% হচ্ছে প্রথম ছ’মাসের মধ্যে হলে। ট্রাইসমি ১৬ হচ্ছে সবচাইতে বেশি পাওয়া ক্রোমোজমের অস্বাভাবিকতা।
স্বামী, স্ত্রী দু’জনের মধ্যে কারোর যদি ক্রোমোজমের অস্বাভাবিকতা থাকে তো বারবার গর্ভনাশের বিপদ আসতে পারে।
- গর্ভাশয়ের গঠনজনিত
বারবার গর্ভনাশের কারণ হিসেবে প্রায় ১২% দায়ী
গর্ভাশয়ের কোনো গঠনজনিত অস্বাভাবিকতা।
গর্ভাশয়ের মুখে যদি শিথিলতা থাকে তবে সাধারণত ২০ থেকে ২৫ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত হতে পারে। আজকাল আলট্রাসোনোগ্রাফি করে এই জরায়ুমুখের শিথিলতা নির্ণয় করা সম্ভব আর তার সুচিকিৎসাও সম্ভব। যাতে সুনিশ্চিতভাবে একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দেওয়া যায়।
জরায়ুতে মাঝামাঝি যদি কোনো দেওয়াল থাকে তা সে পুরোপুরি বা অর্ধেক হোক, তাতেও বারবার গর্ভনাশ হতে পারে। হিস্টেরোসালপিঙ্গোগ্রাফি বা হিস্টোরোস্কোপি বা থ্রি-ডি আলট্রাসোনোগ্রাফি করে সঠিক কারণ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা সম্ভব।
কিছু কিছু গর্ভাশয়ের অস্বাভাবিকতা জন্মগত নাও হতে পারে। যেমন সাবমিউকাস ফাইব্রয়েড (জরায়ুতে এক ধরনের টিউমার), এতেও হতে পারে বারবার গর্ভনাশ। আর হতে পারে অ্যাশরমেসিস সিনড্রোম যাতে জরায়ুর সামনের আর পেছনের দেওয়াল যায় সেঁটে।
- ইমিউনোলজিক্যাল
অ্যান্টি ফসফোলিপিড অ্যান্টিবডি (এর মধ্যে লিউপাস অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট আর অ্যান্টি কার্ডিওলিপিড অ্যান্টিবডি) যদি কারণ হয় তবে প্রায় ৮০% সম্ভাবনা থাকে গর্ভনাশ হয়ে যাবার।
- হরমোন সংক্রান্ত
ডায়াবেটিস যদি ভালোভাবে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে তবে ভয়ের সম্ভাবনা কম। কিন্তু যদি অবহেলা করা হয় তবে গর্ভনাশের সম্ভাবনা থেকেই যায়।
থাইরয়েড সংক্রান্ত গোলমালেও বারবার গর্ভপাতের সম্ভাবনা থেকে যায়।
- সংক্রমণ
টর্চ ইনফেকশন বা টক্সেপ্লাসমা, রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস বা হার্পিসের জন্য এক-আধ বার গর্ভপাত হতে পারে কিন্তু বার বার এই একই কারণে তা হবার সম্ভাবনা খুবই কম।
- মানসিক ও পারিপার্শ্বিক
শারীরিক মেদ বাহুল্য, অত্যধিক চা বা কফি পান, সুরাপান আর খুব ঘন ঘন ব্যথা নিরোধক বড়ি খাওয়া এগুলোও কারণ হতে পারে বারবার গর্ভপাতের। ধূমপান বার বার গর্ভনাশের কারণ হতে পারে কি না এ নিয়ে মতের অমিল আছে। খুব বেশি শারীরিক বা মানসিক চাপের জন্যও হতে পারে বারবার গর্ভনাশ।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
- খুব ভালো করে রোগীর বক্তব্য শোনা, আগের প্রেগন্যান্সি কতদিনের ছিল, কীভাবে নষ্ট হল ইত্যাদি জানা প্রয়োজন।
- মেদের আধিক্য, অবাঞ্ছিত লোমশতা, থাইরয়েডের গোলমালম, স্তন থেকে দুধের মতো বেরোর কি না, আর সর্বোপরি যোনি অভ্যন্তরের পরীক্ষা যা মোটামুটি বলে দেবে কোনো সংক্রমণ বা গঠনজনিত অসুবিধা আছে কি না।
- ক্যারিওটাইপিং (স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই) যা বলে দেবে ক্রোমোজোম ঘটিত কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না।
- নষ্ট হয়ে যাওয়া ভ্রুণের ক্যারওটাইপিং পরীক্ষা।
- আলট্রাসাউন্ড, হিস্টেরোস্কোপি দ্বারা জরায়ুতে কোনো গঠনমূলক অস্বাভাবিকতা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা।
- অ্যান্টি-ফসপোলিপিড অ্যান্টিবডি আছে কি না দেখে নেওয়া।
চিকিৎসা
প্রথমেই বলি, কাউন্সেলিংয়ের কথা। বারবার গর্ভনাশ হবার দরুণ যে মা’টি নিজেকে প্রায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে তাকে বলা প্রয়োজন যে পরপর তিনবার বাচ্চা নষ্ট হলেও একটা সুন্দর শিশু পাবার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় ৫৫ থেকে ৭৫ ভাগ থাকে।
সেপ্টেট বা সাবসেপ্টেট মানে জরায়ুর মাঝে যদি দেওয়াল থাকে তবে হিস্টেরোস্কোপি করে সেটা কেটে দেওয়া যায়। দ্বিধাবিভক্ত জরায়ু শল্যচিকিৎসার দ্বার জুড়ে দেওয়া যায়। জরায়ুমুখের শিথিলতা তো শক্ত করে বেঁধে দিলে নিশ্চিতভাবেই পূর্ণ মাসের সুন্দর শিশু পাওয়া সম্ভব।
অ্যাশরমেসিস সিনড্রোম, যাতে জরায়ুর সামনের ও পেছনের দেওয়াল সেঁটে গেছে, সেটা হিস্টেরোস্কোপি করে কেটে ও আই.ইউ.সি.ডি (কপার-টি) জরায়ুর মধ্যে রেখে আবার তাকে মাতৃত্বের স্বাদ দেওয়া সম্ভব।
সারমিউকাস মায়োমা (এক ধরনের জরায়ুর টিউমার) হিস্টেরোস্কোটি করে নিরাময় করা সম্ভব যাতে তার গর্ভনাশ আর না হয়।
অ্যান্টি ফসপোলিপিড অ্যান্টিবডির জন্য যদি বার বার গর্ভনাশ হয় তো খুব কম ডোজে অ্যাসপিরিন দিয়ে সুফল পাওয়া গেছে। অ্যাসপিরিন ও হেপারিন দ্বারা চিকিৎসাকরলে সুস্থ শিশু পাবার সম্ভাবনা শতকরা ৭০-৮০ ভাগ।
রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকলে (ডায়াবেটিস) তা সুচিকিৎসার দ্বার কমিয়ে আনা যা সাফল্যের হার বাড়িয়ে দেয়।
সর্বোপরি বলি, যখন কোনো কারণই পাওয়া যায় না তখন সুচিকিৎসকের সহৃদয় চিকিৎসা. মনোবল বাড়িয়ে দেবার জন্য প্রচুর উৎসাহ দান সত্যি সত্যিই কিন্তু একটি সুস্থ শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে সাহায্য করতে পারে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন