স্টেরয়েডের অপব্যবহারে জীবনহানিও অস্বাভাবিক নয়
ডাঃ সুকুমার মূখার্জি ও ডাঃ পম্পিতা চক্রবর্তী
2019-04-23 11:03:50
চিকিৎসা জগতে স্টেরয়েড একটি অতি পরিচিত শব্দ। বিভিন্ন রোগের উপশম করে এই স্টেরয়েড। তাই একে তাচ্ছিল্য করা যায় না। কিন্তু এর একটি অতি ভয়ষ্কর দিকও আছে। এর ব্যবহার যদি ঠিকঠাক না হয় তাহলে মানুষের জীবনের যবনিকা নেমে আসতে পারে। তেমনি এর প্রয়োগ, ধরন ও পরিমাণ যদি সঠিক হয় তাহলে রোগের কষ্ট থেকে দ্রুত মুক্তলাভ সম্ভব।
রাসায়নিক যৌগের একটি শ্রেণী থেকে এর উৎপত্তি। তিনটি স্টেরয়েড গ্রন্থি অ্যাড্রিনাল কর্টেক্স, টেস্টিস এবং ওভারি থেকে এটি নিঃসৃত হয়। গর্ভধারণের সময় প্ল্যাসেন্টা থেকে স্টেরয়েড নিঃসৃত হয়। সমস্ত স্টেরয়েড হরমোনের উৎস কোলেস্টেরল। স্টেরয়েড রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গের কোষসমূহে প্রবেশ করে। এই কোষসমূহে বিভিন্ন ধরনের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের নিয়ন্ত্রণে স্টেরয়েডের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই হরমো বিপাকক্রিয়া, প্রতিরোধ ক্রিয়া, লবণ ও জলের সাম্যতা রক্ষার পাশাপাশি যৌন বৈশিষ্ট্য রক্ষাতেও সহায়তা করে। স্টেরয়েড যেমন দেহের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় তেমনই কৃত্রিমভাবে ওষুধ হিসাবেও একে ব্যবহার করা যায়।
মানবদেহে স্টেরয়েডের ব্যবহার যদি সঠিক না হয় তাহলে কিন্তু ভয়ষ্কর এক অবস্থায় সৃষ্টি হয়। এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। এমনকী শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়।
স্টেরয়েড সাধারণত ট্যাবলেট, ক্রিম ও ইঞ্জেকশনের আকারে পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দিনে ১ থেকে ৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত স্টেরয়েড রোগীদের দিয়ে থাকেন। তবে স্টেরয়েড ব্যবহারকারীদের এ ব্যাপারে খুব সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্টেরয়েড গ্রহণ করা উচিত নয়। চারটি বিশেষ ধরনের অ্যানাবলিক স্টেরয়েডের ব্যবহার করা হয়। যেমন ওরাল পিলস. ইঞ্জেকটেবল স্টেরয়েড, ক্রিম অথবা জেল এবং স্কিন প্যাচেম। তবে গিলে খাবার ওষুধই সবচেয়ে সুবিধাজনক ও বহুল প্রচলিত।
স্টেরয়েড ব্যবহার ব্যাপক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যায়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- অ্যাকনি বা ব্রণ। স্টেরয়েড ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
- মস্তিষ্কের চুলে হালকা হয়ে যাওয়া বা একদম উঠে যাওয়া।
- মস্তিষ্ক ছাড়া দেহের অন্যান্য অংশের চুলের দৈর্ঘ বৃদ্ধি হওয়া। স্থূল হয়ে যাওয়া।
- দেহের চামড়ায় এক ধরনের ইরাপশন বা ইনফেকশন—যেমন অ্যাবসেস বা সিস্ট হতে পারে।
- খিদের একটা অসম্ভব পরিবর্তন হতে পারে। হয় প্রচন্ড খিদে পায় অথবা খিদে একদম চলে যায়।
- ঘুমেরও একই ধরনের পরিবর্তন আসে। হয় নিদ্রাহীনতা নয় প্রচন্ড ঘুম।
- শারীরিক অতিসক্রিয়তা নয়তো চরম অলসতা লক্ষ্য করা যায়।
মানবদেহে নিজে থেকেই শরীরে স্টেরয়েড তৈরি হয় যা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ যখন কয়েক সপ্তাহের জন্য ওরাল স্টেরয়েড গ্রহণ করে, তখন দেহে স্টেরয়েড তৈরি খুব কমে যায়, নয়তো বন্ধ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করে স্টেরয়েড গ্রহণ বন্ধ করে দিলে শরীরে আর কোনও স্টেরয়েড থাকে না। ফলে নানান রকমের উপসর্গ শুরু হয়ে যায়। কয়েক সপ্তাহ পরে অবস্থা খানিকটা স্বাভাবিক হয় যেহেতু শরীরে পুনরায় স্টেরয়েড সৃষ্টি হতে থাকে। হঠাৎ করে স্টেরয়েড গ্রহণ বন্ধ হওয়ার ফলে সৃষ্ট উপসর্গ ছাড়াও মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়া দুর্বলতা, ক্লান্তি, অসুস্থতা, বমি, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, রক্তচাপ, সুগার লেভেল কমে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যা হয়। এর ফলে মানুষ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তে পারে। এসব কারণেই স্টেরয়েড গ্রহণ হঠাৎ করে বন্ধ করা যায় না। ধীরে ধীরে এর মাত্রা কমাতে হয়। তাহলে শরীরের মধ্যে তৈরি হওয়া স্টেরয়েডও ধীরে ধীরে সমতায় ফিরে আসে।
টিনএজার বা যুবক-যুবতী যারা অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে যুক্ত তারা মাঝে মধ্যেই বিপদে পড়েন। এমনিতেই নিষিদ্ধ কিছু ড্রাগ গ্রহণ করে ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত ফিরে আসার বহু ঘটনা আছে। অল্প বয়সী খেলোয়াড়রা মাঝে মধ্যেই স্টেরয়েডের অপব্যবহার করে ফেলেন। তাদের বিশ্বাস, বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে তাদের পারফরম্যান্স অনেক ভালো হবে। এর ফলে বিশেষ করে টিনএজাররা ভয়ষ্কর বিপদের মুখোমুখি হয়। তাদের শরীরে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন পুরুষদের শরীরে মহিলাদের বৈশিষ্ট্য এবং মহিলাদের শরীরে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য।
- স্টেরয়েডের দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শরীরে ইনফেকশনের সম্ভাবনা বাড়ে। এই অবস্থায় সৃষ্টি হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
- অস্টিওপোরোসিস রোগের শিকার, স্টেরয়েড গ্রহণের একটা কারণ হতে পারে। দেহের হাড় সরু হতে থাকে। ফলে ফ্যাকচার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এইসব কারণে স্টেরয়েড নেওয়া রোগীদের ক্যালসিয়াম ও দুগ্ধজাতীয় খাবার খাওয়া দরকার।
- অনিয়ন্ত্রিত স্টেরয়েড গ্রহণের ফলে মানবদেহের বিপাকক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর ফলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হতে থাকে। বিশেষ করে পেটে। ফলে দেহের ওজন অম্বাভআবকভাবে বৃদ্ধি পায়।
- কর্টিসল স্টেরয়েড মানবদেহের জল, সোডিয়াম ও অন্যান্য ইলেকট্রোলাইটস পদার্থের সমতা রক্ষা করে। কিন্তু স্টেরয়েড ব্যবহার করলে শরীরে ওই সব পদার্থের সমতা রক্ষা করা যায় না। তাই কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার খেলে ভালো হয়। এর ফলে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে কর্টিসোনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড ব্যবহার করলে রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। এমনকী ডায়াবেটিস রোগেও আক্রান্ত হতে পারে রোগী। যদি এরকম দশা উপস্থিত তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- স্টেরয়েডের ব্যবহারে চোখের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চোখে ছানি অথবা গ্লুকোমা হতে পারে। কিংবা যদি এই রোগ আগে থেকেই হয়ে থাকে তাহলে তা আরও খারাপ অবস্থায় চলে যেতে পারে। তাই চক্ষুবিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করে তবেই স্টেরয়েডের মাত্রা ঠিক করা উচিত
অনেক অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত হন। স্টেরয়েড গ্রহণ করলে ধমনীর গাত্র স্থূল হয়। ফলে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তাই ডাক্তারি পরামর্শের পাশাপাশি নিয়মিত এক্সারসাইজ ও কম কোলেস্টেরল ও কম ফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন