বন্ধ্যাত্বের অবসানে নতুন দিশা
ডাঃ ঐন্দ্রী সান্যাল
2019-04-28 12:16:58
ইনফার্টিলিটির সমস্যা সমাধানে রিপ্রোপাক্টিভ মেডিসিন ক্রমাগত আধুনিক হচ্ছে। তা প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন ১৯৭৬-এ ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতিতে লুইব্রাউন জন্ম নিলেন, সেদিন থেকেই আধুনিকতার অগ্রগতি। আর সেই অগ্রগতির সূত্র ধরেই ১৯৯২-তে উদ্ভাবন হল ইন্ট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন বা ইকসি। তাতে বন্ধ্যত্বের নতুন দিক অর্থাৎ পুরুষ বন্ধ্যত্বও আলোচিত এবং সমাধানের তাগিদ দেখা দিল। আর এই উদ্ভাবনের সরণী ধরেই বহু দূরত্ব অতিক্রম করে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন আজ সাবালক। ফলে ইনফার্টিলিটির চিকিৎসায় ক্রমশই আই.ভি.এফ অন্যতম ভরসার স্থল হয়ে উঠেছে বিষেষজ্ঞ ও ইনফার্টিলিটির সমস্যায় ভোগা মানুষদের জন্য। আর এভাবেই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি।
একদা ইনফার্টিলিটির চিকিৎসা,যা ছিল শুধুই আই.ভি.এফ নির্ভর, তা আজ আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন বিভিন্ন পদ্ধতির সংযোজনে হয়ে উঠেছে আধুনিকতর। তাই ইনফার্টিলিটির মতো সমস্যায় শাপগ্রস্ত হয়ে মুখ লুকিয়ে থাকার দিন ফুরিয়েছে।
মহিলাদের ইনফার্টিলিটির সমস্যা নির্ণয়ে প্রায়ই উঠে আসে টিউবাল সমস্যা। জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের মাঝে সংযোগ রক্ষার মাধ্যমে ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রায়ই বাধা সৃষ্টি হয়, যার থেকে ইনফার্টিলিটি আসে। তাই টিউবাল প্যাথলজি ও বাধামুক্তি ঘটিয়ে কনসিভ করাতে অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি তো রয়েছেই। আবার যাদের ইনফার্টিলিটির কারণ সত্যিই অব্যাখ্যাত থাকে বা আনএক্সপ্লেইনড হয় তখন কিন্তু তিন বছর চেষ্টা চালিয়েও যারা সন্তান ধাণে ব্যর্থ হয়েছে, বয়সও পেরিয়ে গেছে ছত্রিশ বছর, তাদের ক্ষেত্রে সাফল্য নিশ্চিত করতে আই.ভি.এফ-এর কোনো বিকল্প নেই।
এন্ডোমেট্রিওসিস মহিলাদের জীবনে এক গভীর সমস্যা। জরায়ুর দেওয়ালে ক্যাভিটি যা মেনস্ট্রুয়েশনকে বিপর্যস্ত করে এবং ফার্টিলিটির পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তাই তখন এন্ডোমেট্রিওসিসকে এড়িয়ে গর্ভধারণ করানোর ক্ষেত্রে আই.ভি.এফ-এর জুড়ি মেলা ভার।
অনেকের আবার বেশ কিছু ঘাটতি থাকে। যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। ক্রোমোজোমাল ডিসঅর্ডার, ক্রোমোজোমের পুনঃবিন্যাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে আই.ভি.এফ যথেষ্ট কার্যকরী।
ইকসি যেমন পুরুষ বন্ধ্যত্বের সমস্যা নিবারণে প্রধান উপলব্ধি তেমনি তার সহযোগি পেসা ও টেসা পদ্ধতিও এই প্রক্রিয়াতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাছাড়া উন্নতমানের গবেষণাগার আর আধুনিক পরীক্ষার আজ স্পার্মের মোটিলিটির পাশাপাশি মর্ফোলজি নিয়েও বিশ্লেষণ হচ্ছে। তাছাড়া যাদের অ্যাজুস্পার্মিয়া রয়েছে তাদের টেস্টিস থেকে শুক্রাণু বের করে এনে আই.ভি.এফ সাহায্যে কনসিভ করানো হচ্ছে।
বয়স কিন্তু সন্তান ধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওভারির ক্ষমতা ও ওভ্যুলেশনের জটিলতা বয়স বাড়লে মহিলাদের মধ্যে বেশি রকম দেখা যায়। তখন আই.ভি.এফই হচ্ছে একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম যাতে সব জটিলতা কাটিয়ে সাফল্যের মুখ দেখা সম্ভব হয়।
অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজিতে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তির সহায়তা নিয়ে সন্তান ধারণ যথেষ্ট আলোচিত এক বিষয়। ডোনার ইনসেমিনেশন বা তৃতীয় ব্যক্তির থেকে স্পার্ম বা এগ ডোনেশনও আজকের দিনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শুধু তাই নয়, যাদের ইউটেরাস সন্তান ধারণের পক্ষে উপযুক্ত নয় বা কোনো কারণে ইউটেরাস দেহ থেকে বাদ দিতে হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে স্যারোগেট মাদারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজির সব চাইতে আধুনিক দিক বোধ হয় উসাইট প্রিজারভেশন। অর্থাৎ যারা পরবর্তীকালে সন্তান ধারণ করতে চান তারা ইচ্ছে করলে নিজের ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে পারেন। যার পরিচিত নাম এগ ফ্রিুজিং। বহুজাতিক সংস্থা অ্যাপল বা মাইক্রোসফট তাদের মহিলা কর্মীদের এগ ফ্রিজিং
--এ উৎসাহ দিচ্ছেন। যাতে তারা কেরিয়ারে মনোনিবেশ করতে পারেন এবং সন্তান ধারণের বয়স চলে যাচ্ছে—এই উৎকন্ঠায় না কাটান। তাছাড়া অনেক সময় ক্যানসার আক্রান্তরা ক্যানসার থেকে সেরে উঠে সন্তান ধারণ করতে চাইলে ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাটি শুরুর আগের ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখছেন। এভাবেই এগ ফ্রিজিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তাই অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজির আধুনিকতা সময়ের সঙ্গে ইনফার্টিলিটি নিরসনে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে উঠে এসেছে। অন্ধকারে এক আলোর দিশা। হিসাবেই ইনফার্টাইল দম্পতিদের ভবিষ্যতের পথ দেখাচ্ছে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন