জরায়ু-মুখের ক্যানসার অবহেলা করলে চড়া দাম দিতে হ
ডাঃ সবুজ সেনগুপ্ত
2019-04-28 12:25:21
যদিও ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুগম্ভীর এবং মারাত্মাক। তবে কোনো গুরুগম্ভীর শব্দ বা খটোমটো ডাক্তারি শব্দ ব্যবহার না করে বরং একটা গল্প শোনাই। না ভুল বললাম, এটা গল্প নয়, আমার জীবন-খাতা থেকে নেওয়া।
বেশ কয়েকদিন আগেকার কথা। আউটডোরে বসে রোগী দেখছি। এক ভদ্রমহিলার আগমন। একটু ভয়ে ভয়ে এবং অত্যন্ত ধীর স্বরে ভেতরে আসার অনুমতি চাইলেন। এসে বসলেন, কিন্তু কেন এসেছেন সেটা বলতে পারছিলেন না। মাত্রা ৩৭ বছর বয়স, দুটি বাচ্চার মা। অনেক বুঝিয়ে অনেক কথা বলার পর বোঝা গেল তার সমস্যা হচ্ছে শ্বেতস্রাব। সারা মাস ধরে জলের মতো। এতটাই বেশি যে ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হয়। পরীক্ষাতে দেখা গেল জরায়ু মুখে যেটা আমরা বলি ‘সারভাইক্যাল ইরোসন’—তাই আছে। খুবই দগদগে এবং টকটকে লাল—একটু ছুলেই রক্তস্রাব হচ্ছে। বাকি সব পরীক্ষার পর এসব ক্ষেত্রে যা বলে থাকি তাই বললাম। যেমন প্যাপন্মিয়ার, আলট্রাসনোগ্রাফি এবং এগুলোর রিপোর্ট পাবার পর সারভাইক্যাল বায়োপসি। পাংশু মুখে ভদ্রমহিলা বিদায় নিলেন। বেশিরভাগ বাঙালি ভদ্রমহিলার মতো ‘বায়োপসি’ শব্দটা শুনেই মুখ শুকিয়ে গেছে।
না, ভদ্রমহিলা আর এলেন না। এলেন প্রায় একবছর পর। সাথে স্বামী। প্রায় জোর করেই ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। এবারে শুনলাম—মাসিক বলে নিয়মিত কোনো ব্যাপার নেই। মাঝে মাঝেই রক্তস্রাব হচ্ছে। দুর্গন্ধও আছে। স্বামীর সঙ্গে গেলেই রক্তস্রাব শুরু হয়ে যায়। যেটা আমাদের ভাষায় বলে কনট্যাক্ট ব্লিডিং। অনেক বকুনি দেবার পর স্বীকার করলেন—আশপাশের গিন্নীরা তাদের আলোচনায় নাকি জানিয়েছেন, ‘এরকমটা অনেক সময়েই হয়---চেপে বসে থাক। ডাক্তারের কাছে গেলেই এসব বায়োপসি-টায়োপসি বলে বড় অপারেশনের কথা বলবে। (এখানে খুব ভয়ে ভয়ে একটা কথা জানিয়ে রাখি, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের কথা জানি না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই গিন্নীরা হচ্ছেন মারাত্মক প্রজাতি। প্রায় সবারই বাড়িতে মামা, কাকা, জ্যাঠা বিরাট ডাক্তার। তাদের ছায়ায় বড় হবার সাথে সাথে এরাও অনেক ডাক্তারি ব্যাপার স্যাপার জেনে গেছেন। প্রায়শই এরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় অনেক সুচিন্তিত অভিমত দিয়ে থাকেন। আর এভাবে অনেককেই যমালয়ের দ্বারের দিকে ঠেলে দেন।)
যাই হোক গল্পে ফিরে আসি। স্বামীর জোরাজুরিতে এবার রাজি হলেন সব টেস্ট করাতে। প্যাপস্মিয়ারের রিপোর্ট এল ‘হাইগ্রেড ডিসপ্রেসিয়া’। আর বায়োপসি রিপোর্ট বয়ে নিয়ে এল সেই অমোঘ সংবাদ---‘কার্সিনোমা’।
ততদিন অনকে ছড়িয়ে গেছে অসুখ। অপারেশনের প্রশ্নই নেই। পাঠাতে হল রেডিওথেরাপির জন্য কলকাতায়।
এখানেই শেষ নয়। প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং এর ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে এবং স্ত্রীকে সঙ্গে ভদ্রলোক রওয়ানা হলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে দুর্গাপুর থেকে তিন ঘন্টার সফর। অসাধু এবং দুরাত্মারা মনে হয় সর্বত্রই থাকে। রাস্তায় এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ। তিনি ঠিকানা দিলেন এক জবরদস্ত হোমিপ্যাথের। যার দর্শনী আটশো টাকা। তখনকার দিনে যখন দুর্গাপুরের ডাক্তাররা এমনকী উচ্চশিক্ষিত বিলেত ফেরত ডাক্তারবাবুরাও দুশো টাকার বেশি দর্শনীয় কথা ভাবতে পারতেন না। ওরা ব্যান্ডেলে নেমে ফিরে চলে এলেন সেই হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
এর পরের অংশটুকু অনেক পরে সেই স্বামী ভদ্রলোকের মুখে শোনা। এক ভাগ্নির ডেলিভারির সময় তাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। শুনলাম সেই হোমিওপ্যাথ প্রায় ছ’মাস টানা চিকিৎসা করেছিলেন। ভালো হওয়ার বদলে যখন প্রচন্ড রক্তস্রাব এবং দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব শুরু হয় বাড়ির কেউ তার কাছে যেতে চায় না। একসময় টাকা সব শেষ, ভদ্রলোক সর্বস্বান্ত। উপায়ান্ত না দেখে দুর্গাপুরেরই এক নার্সিংহোমে ভর্তি করার কিছুদিন পরেই ভদ্রমহিলা নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করলেন। যেখান থেকে আর কেউ কখনো ফেরে না।
এই গল্পটার একটা অংশও বানানো নয়। লিখলাম এই জন্য যে, অবৈজ্ঞানিক ধারণা নিয়ে আর অসাধু হাতুড়েদের কবলে পড়ে সাধারণ মানুষ কীরকম নাজেহাল হচ্ছে, তা বোঝাতে। সুতরাং সাবধান, সবসময়েই কোনোরকম কিছু শারীরিক অসুবিধা হল শিক্ষিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। আমাদের দেশে ক্যানসার জনিত অসুখের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার সবচাইতে বেশি প্রাণঘাতী। তার পরেই হচ্ছে স্তন ক্যানসারের স্থান। সচেতন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। সঠিক সময়ে এল আর সঠিক উপদেশে শুনলে এই ভদ্রমহিলাকেও অসময়ে সব ছেড়ে ছবি হয়ে যেতে হত না।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন