নবজাতকের খাদ্যের চাহিদা পূরণে বুকের দুধ কি যথেষ্ট
ডাঃ স্বপন বিশ্বাস
2019-05-07 11:56:33
এখন চার থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শিশুদের শুধুমাত্র বুকের দুধ খাইয়ে রাখা উচিত বলে শিশু বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে মাত্র ৩৫ শতাংশ মা তাদের শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাইয়ে রাখেন। ইউনিক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চাইছে বিশ্বের প্রতিটি মা-ই তাদের শিশুকে মাতৃদগ্ধ পান করান। কিন্তু কেন? কী আছে এই বুকের দুধে?
আজকের আলোচ্য বিষয় তাই শিশুর খাদ্য-খাবার । বুকের দুধ কেন উপকারি বা আদৌ উপকারি কি না জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে কী আমাদের খাদ্য-খাবার, কী আমাদের চাহিদা, বুকের দুধ তার কতটা পূরণ করতে পারে বা পারে না? এই আলোচনটা সুখপাঠ্য নাও হতে পারে, কিন্তু দরকারি।
আমাদের জানা প্রয়োজন, আমাদের বা শিশুর শরীরের জন্য কী দরকার হয়, কোন জাতীয় খাদ্য কতটা প্রয়োজন, তাদের কাজ কী, ইত্যাদি।
শিশুর খাদ্য-খাবার নিয়ে মায়েরা সব সময়ই চিন্তার থাকেন। বাচ্চাকে কী খাওয়াব, কতটা খাওয়াব, কেন খাওয়াব? আর যে সব শিশু মায়ের দুধ পায় না, তাদের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই মায়েদের খাওয়ানোটাই বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। ভ্রান্তিবশত অথবা পাশের বাড়ির কারও উপদেশ শুনে হয়তো এমন কিছু শিশুকে খেতে দেন, যা দেওয়া উচিত নয়। তাই শিশুর প্রয়োজন জানাটা আগে দরকার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন খাদ্যবস্ত্তুর কাজ এবং কতটা প্রয়োজন এবং বুকের দুধ সেই চাহিদা কতটা পূরণ করতে পারে তাই নিয়েই এই আলোচনা।
আমাদের খাদ্যবস্ত্তুকে কাজ এবং প্রকৃতি অনুসারে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়—
- প্রোটিন
- কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা।
- ফ্যাট বা লিপিড
- ভিটামিন
- মিনারেল বা খনিজ পদার্থ। এছাড়া আরও দুটো বিষয়ে আলোচনা করা হবে, তা হল জল এবং শক্তি বা ক্যালোরি। আমরা জানি, শক্ত বা এনার্জি ছাড়া সব কিছুই অচল। আমাদের হাঁটা, কথা বলা সব কিছুর মূলে এই শক্তি বা এনার্জি ছাড়া সব কিছুই অচল। আমাদের হাঁটা, কথা বলা সব কিছুর মূলে এই শক্তি। আর সব শক্তির উৎসই সূর্য। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট আমাদের শরীর গঠন করে, শক্তি সরবরাজ করে, আর ভিটামিন ও মিনারেল বা খনিজ পদার্থ শরীরকে রক্ষা করে। এর কোনোটার অভাব হলেই শিশুর বৃ্দ্ধির অভাব ঘটে।
আলাদা করে এদের প্রসঙ্গে আসা যাক।
জল
আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, জলই জীবন। আমাদের শরীরের একটা বড় অংশই জল। শিশুদের শরীরের ৭৫-৮০ শতাংশই জল, বড়দের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৫৫-৬৫ শতাংশ। শিশু তার ওজনের ১০-১৫ শতাংশ জল প্রতিদিন পান করে (বড়দের ক্ষেত্রে এটা ২-৪ শতাংশ)। এই জলের প্রধান কাজ—
- শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা
- পদার্থকে শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে আদান-প্রদান কর
- কোষের বিপাকীয় ক্রিয়া সম্পন্ন করা
- কিডনি বা বৃক্কের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের পক্ষে অপকারি বর্জ্য পদার্থ বাইরে বের করে দেওয়া। এছাড়া বর্জ্য পদার্থ ঘাম হয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গেও বাইরে বেরিয়ে যায়। কাজেই বেঁচে থাকতে গেলে জলের প্রয়োজন।
- জম্নের প্রথম তিন দিন মলমূত্র কম হয়, তাই জলের চাহিদাও কম। স্বাভাবিক সুস্থ শিশুর প্রথম তিন দিন প্রতিদিন জলের প্রয়োজন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৮০-১০০মিলিলিটার। ১০ দিন বয়সে এই চাহিদা বেড়ে হয় কিলো প্রতি ১২৫-১৫০ মিলিলিটার, তিন মাস বয়সের সময় এই চাহিদা আরও বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন ১৪০-১৬০ মিলিলিটার। অর্থাৎ তিন মাস বয়সে কোনো শিশুকে ওজন ৫ কেজি হলে প্রতিদিন ৮০০-১০০০মিলিলিটার জল তার প্রয়োজন। তারপর ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিলোপ্রতি জলের চাহিদা কমতে থাকে। দু;বছর বয়সে চাহিদা কমে হয় কিলোপ্রতি ১১৫-১২৫ মিলিলিটার, দশ বছর বয়সে ৭০-৮০ মিলিলিটার প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য। অর্থাৎ, ছোট বয়সে জলের প্রয়োজন তুলনামূলক ভাবে বেশি।
- জলেল সঙ্গে শরীরের বর্জ্যাপদার্থ পাতলা হয়ে প্রস্রাবের মাধ্যমে কিডনি দিয়ে বেরিয়ে যায়। জল খাওয়া কম হলে প্রস্রাব গাঢ় হয়। অর্থাৎ বর্জ্যপদার্থের ঘনত্ব বেশি থাকে, বা অল্প পরিমাণ প্রস্রাবে বেশি পরিমাণ বর্জ্যপদার্থ নির্গথ হয়। নবজাতকের কিডনি প্রস্রাবকে বেশি গাঢ় করতে পারে না, তাই প্রয়োজন মতো জল না খাওয়ালে শরীরের বর্জ্য পদার্থের ঠিকমতো নির্গমন হবে না। বেশি প্রোটিন জাতীয় খাদ্য খেলে জলের আরও বেশি প্রয়োজন হয়। দুধ কম খাওয়ালে বা গাঢ় করে বাইরের দুধ গুললে জল কম পড়ে। আবার বেশি জল খাওয়ানোও শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর। তাই সঠিক পরিমাণে জল দিতে হবে। শিশু যত জল গ্রহণ করে, তার ০.৫-৩ শতাংশ শরীরে থেকে যায়। ৪০-৫০ শতাংশ প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত হয়, ৪০-৫০ শতাংশ চামড়ার মাধ্যমে ঘাম হয় বেরিয়ে যায়, আরও ৩-১০ শতাংশ মলের সঙ্গে নির্গত হয়।
পরিণত বুকের দুধ জলের পরিমাণ কমবেশি ৯০ শতাংশ। তাই বুকের দুধে যথেষ্ট পরিমাণ জল থাকে।
ক্যালরি বা শক্তি
ক্যালরি হল আমাদের শক্তির হিসেব। খাদ্য আমাদের শক্তি জোগায়, আর সেই শক্তির বলে আমরা চলি, কথা বলি, বড় হই, বেঁচে থাকি।
শিশুর প্রতিদিন কতটা শক্তি লাগে তা নির্ভর করে তার ওজনের ওপর, শারীরিক গঠনের ওপর। এখানেও হিসাব সেই ওজনের ওপর নির্ভর করে। ছোট নবজাতক চলাফেরা করে না, ছোটে না, তার শক্তির প্রয়োজন তুলনায় কম। বড়দের ছোটাছুটি, কায়িক পরিশ্রম, এসবের ওপর শক্তির চাহিদা নির্ভর করে। শিশুর প্রথম বছর প্রতি কেজি ওজনের জন্য শক্তি লাগে ৮০-১১০ কিলো ক্যালরি। ক্যালরি হল শক্তি পরিমাপ করার একক। এই শক্তিকে ৯-১৫ শতাংশ আসা উচিত প্রোটিন জাতীয় খাদ্য থেকে, ৪৫-৫৫ শতাংশ শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য থেকে, আর বাকি ৩৫-৪৫ শতাংশ চর্বি বা ফ্যাট থেকে। আবার এক গ্রাম প্রোটিন থেকে পাওয়া যায় ৪ কিলোক্যালরি শক্তি, ১ গ্রাম ফ্যাট থেকে ৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ১ গ্রাম শর্করা থেকে ৪ কিলোক্যালরি শক্তি। শিশুর খাদ্যে তাই এই তিন প্রকার খাদ্যবস্তু সেই অনুপাতে থাকা প্রয়োজন, যাতে তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট প্রয়োজণীয় পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। শুধু বেশি করে একপ্রকার খাবার খাওয়ালে শিশু ক্যালরি হয়তো পাবে, কিন্তু তাদের শারীরিক গঠন ঠিক হবে না। অসুখও হতে পারে।
শিশু যত শক্তি গ্রহণ করে তার ৫০ শতাংশ ব্যয় করে নিজের দৈনন্দিন বিপাকীয় কাজকর্মের জন্য, ২৫ শতাংশ ব্যয় করে শারীরিক পরিশ্রমের জন্য, ৮ শতাংশ নির্গত হয় মলের সঙ্গে আর বাকি ১২ শকাংশ বৃদ্ধির কাজে লাগায়। প্রশ্ন আসতে পারে শারীরিক পরিশ্রম আবার কী? শিশুর হাত-পা ছোড়া, খেলা, কান্না—এ সবই শারীরিক পরিশ্রম।
শরীরে এক কিলোগ্রাম ওজন বাড়াতে গেলে কমবেশি ৮০০০ কিলোক্যালরি শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয়। ঠিকমতো শক্তি এবং পুষ্টিকর খাবার পেলে শিশুর ওজন ৬ মাসে তার জন্মের ওজনের দ্বিগুণ হয়, ১ বছরে তিনগুণ হয়। তাই শিশুকে এমন খাবার দিতে হবে, যেন শিশু সঠিক অনুপাতে সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার পায় এবং একই সঙ্গে তার শক্তির চাহিদাও পূরণ হয়। এক্ষেত্রে দুধই সেরা।
শক্তি এবংবুকের দুধ
১০০ মিলিলিটার কোলস্ট্রামে বা প্রাথমিক দুধে ৫৮ কিলোক্যালরি শক্তি থাকে, আর পরিণত দুধে থাকে ৭০ কিলোক্যালরি। একটা জিনিস লক্ষ করা প্রয়োজন, এই জল এবং শক্তির চাহিদার অনুপাত। বুকের দুধে জল আর শক্তির অনুপাত ঠিক থাকে, এতে শিশু জলের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় শক্তিও পায়। প্রকৃতি শিশুর ঠিক পুষ্টির জন্য, বেড়ে ওঠার জন্য মাতৃস্তনে মাতৃদগ্ধ সঞ্চিত করে রেখেছে সব কিছু দিয়ে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন