গর্ভবস্থায় চিকেনপক্স অত্যন্ত ভয়ষ্কর হতে পারে
ডাঃ উজ্ঝল আচার্য
2019-05-07 12:18:30
জরায়ুর মধ্যে বাচ্চা কীভাবে বেড়ে ওঠে
১ম মাস—ভ্রূণের দৈর্ঘ হয় ১ ইঞ্চির কম। পোস্তদানার মতো সাইজ হয় হার্টের। ক্রমশ হার্টবিট শুরু হয়।
২য় মাস—ভ্রূণের দৈর্ঘ হয় ১ ইঞ্চি। হার্টবিট ভালো বোঝা যায়। হার্টের চেম্বার তৈরি হয়।
৩য় মাস—ভ্রূণ প্রায় ৩ ইঞ্চি লম্বা হয়, অঙ্গ সঞ্চালন শুরু করে।
৪র্থ মাস---ল্যানুগো হেয়ার বা লোম গজায়, হার্টবিট শোনা যায়।
৫ম মাস---বাচ্চার চামড়ায় ভার্নিক্সিকেসিয়সা নামক আচ্ছাদন তৈরি হয়। বাচ্চার দৈর্ঘ হয় ৮-১০ ইঞ্চি।
৬ষ্ঠ মাস—চোখের পাতা, ভ্রূ তৈরি হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে শুরু করে, মায়ের কথা বা গান শুনতে পায়।
৭ম মাস—দৈর্ঘ ১৫ ইঞ্চি, ওজন হয় ১ কেজির উপর। শরীরের অরেকটাই তৈরি হয়ে যায়। হাত-পায়ে নখও তৈরি হয়।
৮ম মাস—প্রতি সপ্তাহে ওজন বাড়ে আধ পাউন্ড করে। ওজন হয় আড়াই কেজির কাছাকাছি।
৯ম মাস---ওজন আড়াই কেজির উপর, দৈর্ঘ হয় ১৯-২২ ইঞ্চি।
গর্ভাবস্থায় স্তনে কীরকম পরিবর্তন আসে?
৬ থেকে ১২ সপ্তাহেই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। গর্ভাবস্থায় স্তনের আকার বড় হয়। পেশি এবং নালীর বৃদ্ধির জন্য এমনটা হয়। ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের জন্য এ সময় স্তনের মধ্যে পরিবর্তন আসে। রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। স্তনবৃন্ত বড় হয়, উঁচু হয় এবং কালো হয়। ১২ সপ্তাহের পর স্তনে চাপ দিলে কষ জাতীয় নিঃসরণ হয়। ১৬ সপ্তাহের পর ঘন হলদেটে কষ ক্ষরণ হয়। স্তন থেকে ক্ষরণ নিঃসৃত হওয়া একজন মহিলার গর্ভাবস্থায় লক্ষণ নির্দেশিত করে।
বাচ্চার নড়াচড়া কবে থেকে বুঝব?
প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে ১৮ সপ্তাহে এবং দ্বিতীয় বা বেশি বাচ্চার ক্ষেত্রে ১৬ সপ্তাহে বাচ্চার নড়াচড়া বোঝা যায়।
এপিসিওটমি কী?
বাচ্চার মাথা প্রসবদ্বারের তুলনায় বড় থাকলে প্রসবদ্বার সামান্য কেটে বাচ্চা বার করতে হয়। একে বলে এপিসিওটমি। নর্মাল ডেলেভারির সময় প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রায় সব মাকেই এই ছোট অপারেশন করতে হয়। ডেলিভারির পর লোকাল অ্যানাসথেশিয়া দিয়া সেলাই করে দেওয়া হয়। এতে বাচ্চা ডেলিভারির যেমন সুবিধা হয়, তেমনি মায়ের প্রসবদ্বারে আঘাত লাগে না।
ফরসেপ্স ডেলিভারি কী?
অনেক সময় মা প্রসববেদনা সঠিক দিতে না পারলে, শরীর দুর্বল হয়ে গেলে, মায়ের হার্টের রোগ, প্রেসার স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, বাচ্চার ওজন কম হলে, বাচ্চার জীবন সংশয় হলে বা বেশি দিনের গর্ভাবস্থা হলে সাঁড়াশির মতো যন্ত্র দিয়ে বাচ্চা প্রসব করানো হয়। একে বলে ফরসেম্স ডেলিভারি। তবে ইদানিং এভাবে প্রসবের সংখ্যা অনেক কম।
ডাক্তারবাবু বাচ্চার হৃদস্পন্দন কবে থেকে শুনতে পান স্টেথোস্কোপের সাহায্যে?
১৮-২০ সপ্তাহে ডাক্তারবাবুরা স্টেথোস্কোপের সাহায্যে বাচ্চার হৃদস্পন্দন শুনতে পান।
এ সময় বেশি করে লালা ঝরে কেন?
এই সময় লালার বেশি ক্ষরণ কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়। বেশি পরিমাণে স্টার্চ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ এ জন্য দায়ী। তবে সঠিক কারণ অজানা। নিজে থেকে এ সমস্যা দূরীভূত হয়। তবে কার্বহাইঙ্গেট জাতীয় খাদ্য কম খেলে সমস্যা খুব একটা থাকে না।
মিসক্যারেজের লক্ষণ বা উপসর্গ কী?
কয়েক মাস পিরিয়ড বন্ধ থাকার পর হঠাৎ সামান্য রক্তপাত এবং তলপেটে ব্যথা থ্রেটেন্ড অ্যাবরশনের লক্ষণ। প্রচন্ড রক্তপাত এবং তলপেটে ব্যথা, মাংসপিন্ড বা রক্তের দলা যোনিপথে বেরিয়ে আসা অন্যান্য গর্ভপাতের লক্ষণ। সেপটিক অ্যাবরশনে প্রচন্ড জ্বর হয় এবং দুর্গন্ধযুক্ত রক্তস্রাব হতে থাকে।
মিসক্যারেজের চিকিৎসা কী?
থ্রেটেন্ড অ্যাবরশন ছাড়া অন্য কোনও ক্ষেত্রেই বাচ্চা বাঁচানো যায় না। সম্পূর্ণ বিশ্রাম আর ওষুধ খাওয়াই এর চিকিৎসা। অন্যান্য ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু ডিসি করে জরায়ু পরিষ্কার করে দেন।
কীভাবে এভাবে মিসক্যারেজ?
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া চলবে না।
বাইরের খাবার, ভারী কাজ, জলের বালতি তোলা নিষিদ্ধ।
প্রথম দেড় মাস এবং শেষ দেড় মাস সহবাস নিষিদ্ধ।
স্নান করুন প্রতিদিন।
সুষম খাবার খাবেন।
বিশ্রাম ও ঘুম যথেষ্ট হওয়া চাই।
কুকুর বেড়াল ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না।
মিসক্যারেজ কেন হয়?
আমাদের দেশে শতকরা ১০ ভাগ মহিলার গর্ভপাত আপনা-আপনি হয়ে যায়। ভ্রূণের কারণে অর্থাৎ ভ্রূণের অস্বাভাবিকতা, ক্রোমোজোমের ক্রুটি, প্লাসেন্টা নীচে থাকলে বা যমজ বাচ্চার কারণে গর্ভপাত হয়ে যেত পারে। মায়ের শরীরে সংক্রমণ, আঘাত লাগা, অপুষ্টি, জরায়ুর সমস্যা ইত্যাদি কারণেও মিসক্যারেজ হয়।
আগে দু’বার মিসক্যারেজ হয়েছে, এবারে বাচ্চা ভালো থাকবে তো?
ডাক্তারবাবুর পরামর্শে সঠিক ওষুধ এবং সঠিক নিয়ম মেনে চললে আগে দু’বার মিসক্যারেজ হয়ে থাকলেও এবারে সুস্থ সবল বাচ্চার জন্ম দিতে কোনও অসুবিধে নেই।
মোলার প্রেগন্যান্সি কী?
প্লাসেন্টার অস্বাভাবিক অবস্থা। এক্ষেত্রে বাচ্চা জরায়ুতে না এসে তার পরিবর্তে ছোট ছোট সিস্ট বা আঙ্গুরের মতো পদার্থ তৈরি হতে দেখা যায়। এর প্রকৃত কারণ অজানা। কমবয়সী মেয়েদের এবং বেশি বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা হতে দেখা যায়। তলপেটে ব্যথা এবং রক্তস্রাব এ রোগের উপসর্গ।
গর্ভাবস্থায় আমার পেটে নাকি বেশি জল আছে, ব্যাপারটা কী??
সাধারণত অ্যামিনিওটিক ফ্লুইডের মাত্রা ২০০০মিলি-র বেশি হলে তাকে পলিহাইঙ্গামনিয়োস বলে। অ্যানেনকেফালি, স্পাইনাবিফিডা, ডুওডেনাল অ্যাস্ট্রেসিয়া, হাইঙ্গপস ফিটালিস হলে এমনটি হতে পারে।
আমার পেটে জল নাকি কম আছে, কেন হয়?
অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের মাত্রা ২০০ মিলি-র কম হলে তাকে ওলিগোহাইঙ্গামনিয়োস বলে। বাচ্চার গঠনগত বা জিনগত ক্রটি, রেনাল অ্যাজেনেসিস, সংক্রমণ, আই.ইউ.জি.আর., অজানা কারণে এমনটি হতে পারে।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া কী?
যদি প্লাসেন্টা সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকাভাবে জরায়ুর নীচে প্রোথিত হয়, জরায়ুর মুখের কাছে বা ওপরে থাকে, তখন তাকে বলে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া।
বেশি সংখ্যাক সন্তানগ্রহণ, বেশি বয়সে গর্ভবতী হওয়া, আগে সিজার হয়ে থাকলে, ধূমপানের কারণে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হতে পারে। হঠাৎ করে ব্যথথা ছাড়াই এবং কোনও কারণ ছাড়াই রক্তক্ষরণ এই রোগের উপসর্গ।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসে কী ক্ষতি হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় অ্যাবরশন, প্রিটার্ম লেবার, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, পলিহাইঙ্গামনিয়োস, সংক্রমণ হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, দীর্ঘমেয়াদি প্রসব, বাচ্চার বিকলাঙ্গতা দেখা যায়।
গর্ভাবস্থায় থাইরয়েডের সমস্যা কী কী হতে পারে?
হাইপারথাইরয়েড হলে—অ্যাবরশন, সময়ের আগে প্রসব, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, হার্ট ফেলিওর, সংক্রমণ প্রভৃতি হতে পারে। বাচ্চার বৃদ্ধি ব্যাহত ও মৃত সন্তান প্রসব, বাচ্চা থাইরয়েড সমস্যা হতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডে—অ্যানিমিয়া, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, অ্যাবরশন, স্টিলবার্থ, প্রি-ম্যাচুরিটি হতে পারে এবং বাচ্চার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
গর্ভাবস্থায় চিকেন পক্স কী ক্ষতি হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে চিকেন পক্স হলে বাচ্চার চূড়ান্ত ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি হয় ১৩-২০ সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত হলে। বাচ্চার হাত-পা ছোট হয়ে যাওয়া, বৃদ্ধি এবং বুদ্ধি ব্যাহত হওয়া, ছানি পড়া, মস্তিষ্ক ছোট হওয়া, কোরিওরেটিনাইটিস হতে পারে। গর্ভাবস্থায় চিকেন পক্সের ভ্যাকসিন নেওয়া নিষেধ। অ্যাসাইক্লোভির জাতীয় ওষুধ এ সময় নিরাপদ এবং সময়সীমা কমিয়ে দেয়।
গর্ভাবস্থায় মৃগী হলে কী ক্ষীত হতে পারে?
বাচ্চার বিকলাঙ্গতা, বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে, ওলিগো হাইঙ্গামনিয়োস, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, অ্যাবরশন, স্টিলবার্থ, প্রি-ম্যাচুরিটি এবং বাচ্চার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
গর্ভাবস্থায় হাঁপানিতে কী সমস্যা হতে পারে?
সময়ের আগে প্রসব, আগে জলের পর্দা ফেটে যেতে পারে, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, কম ওজনের বাচ্চার জন্ম হতে পারে। মায়ের মারাত্মক নিউমোথোরাক্স, করপালমোনেল বা রেসপিরেটরি ফেলিওর হতে পারে।
গলব্লাডারে পাথর হলে গর্ভাবস্থায় কী করণীয়?
গর্ভাবস্থায় ২০০০ জনের মধ্যে ১ জনের গলব্লাডার পাথরের সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমদিকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারে অপারশেন, অবশ্যই ল্যাপরোস্কোপিক সার্জারি করলে গর্ভাবস্থায় কোনও প্রভাব পড়ে না।
গর্ভাবস্থায় ফাইব্রয়েড হলে কী করণীয়?
গর্ভাবস্থায় ১০০ জনের মধ্যে ১ জনের এ সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় ফাইব্রয়েডে পায়খানা শক্ত হতে পারে, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে, হতে পারে মিসক্যারেজ, বাচ্চার পজিশন ঠিক না-ও হতে পারে. সময়ের আগে প্রসব, রক্তক্ষরণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় অপারেশন করা হয় না। স্বাভাবিক প্রাক-প্রসব পরিচর্যা চালিয়ে যেতে হয়।
গর্ভাবস্থায় ওভারিয়ান টিউমারে কী করণীয়?
প্রতি ২০০০জনে ১ জনের ওভারিয়ান টিউমার দেখা যায়। প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় গর্ভবতীয়। বাচ্চার পজিশন অস্বাভাবিক হয়, শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। ১৪-১৮ সপ্তাহের অপারেশন করা যেতে পারে। অন্যথায় প্রসবের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন দরকার হয়।
গর্ভাবস্থায় জরায়ু পুরো বেরিয়ে এলে কী করণীয়?
গর্ভাবস্থায় ২৫০ জনের মধ্যে ১ জনের এ সম্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে গর্ভপাত, সময়ের আগে জল ভেঙে যেতে পারে, সংক্রমণ হতে পারে। সারভিক্সকে ডাক্তারবাবুরা যোনির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ১৮-২০ সপ্তাহ পর্যন্ত রিং পেশারি দিয়ে আটকে রাখেন।
পোস্টটার্ম প্রেগন্যান্সি কী?
সম্ভাব্য প্রসবের দিন থেকে দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে তাকে বলে পোস্টটার্ম প্রেগন্যান্সি। এক্ষেত্রে বাচ্চার হাইপক্সিয়া, মেকোনিয়াম খেয়ে ফেলা, বাচ্চার হাইপোগ্লাইসেমিয়া, বাচ্চার মৃত্যওে ঘটতে পারে। প্রসব-বেদনা তোলার জন্য ডাক্তারবাবুরা ইঞ্জেকশন দেন। জটিলতা দেখলে সিজার করাই বাঞ্ছনীয়।
গর্ভাবস্থায় পেটে বাচ্চা মারা যায় কেন?
মায়ের প্রেসার বেশি থাকলে, ডায়াবেটিস থাকলে, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টক্সোপ্লাজমা সংক্রমণ ঘটলে, বাধাপ্রাপ্ত লেবার বা দীর্ঘমেয়াদি প্রসব হলে, বাচ্চার জিনগত ক্রটির কারণে প্রাকপ্রসব রক্তক্ষরণে গর্ভাবস্থায় পেটে বাচ্চা মারা যেতে পারে। আল্টাট্রাসোনোগ্রাফি করে এ অবস্থা নির্ণীত হয়।
বেশি বয়সে মা হলে কী সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত
৩০ থেকে ৩৫-এর বেশি বয়সে গর্ভবতী হলে নানারকম সমস্যা হতে পারে। যেমন---অ্যাবরশন, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, রক্তক্ষরণ, ফাইব্রয়েড, ডায়াবেটিস, বৃদ্ধি ব্যাহত, পোস্টম্যাচুরিটি, বাচ্চার ডাউন্স সিনঙ্গোম ইত্যাদি। নিয়মিত প্রাক-প্রসব পরিচর্যায় অংশগ্রহণ জরুরি। সময়ে প্রসববেদনা না উঠলে সিজার করার প্রয়োজন হয়। প্রাকসব পরিচর্যায় নানারকম পরীক্ষা করে বাচ্চার কোনও বিকলাঙ্গতা আছে কি না দেখা দরকার।
প্রেকন্যান্সির পর এক্সারসাইজ কী করব ?
প্রথমেই ভারী কোনও এক্সারসাইজ করতে যাবেন না। প্রথমে শুধুমাত্র হাঁটা ভালো। সকাল বা সন্ধাবেলা হাঁটা দরকার। প্রেগন্যান্সির পর ওজন কমাতে সূর্যনমস্কর দারুণ উপযোগী। এছাড়া বীরভদ্রাসন, পশ্চিমমোথানাসন, ধনুরাসন করলে ওজন কমতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মাথাব্যথা হলে কী করণীয়?
শরীরে রক্তের পরিমাণ এবং হরমোন বেড়ে যাবার ফলে মাথাব্যথা হতে পারে। তার ওপরে মানসিক চাপ, ভঙ্গিমার পরিবর্তন, দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তনের মাথাব্যথা হয়। এছাড়া ঘুম কম হলে, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাপ, জলীয় পদার্থের ভাগ কমে গেলে মাথাব্যথা হতে পারে। শরীরের সঠিক পজিশন বজায় রাখা, উপযুক্ত বিশ্রাম, বেশি চিন্তাভাবনা না করা, মালিশ, ঈষদুষ্ণ জলে স্মান করা যেতে পারে।
বাচ্চা কম নড়লে কী করণীয়?
শেষের দিকে গর্ভে শিশু কেমন আছে তা জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হল বাচ্চার নড়াচড়া কাউন্ট করা---দিনে ১২ ঘন্টায় ১০ বার নাড়ছে মানে ঠিক আছে। আর সকাল, দুপুর ও রাতে ১ ঘন্টায় তিনবার নড়লেও ঠিক আছে। শিশুর নড়াচড়া কম হলে বুঝতে হবে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। মায়েল ইউএসজি এবং কালার ডপলার স্টাডি করে পরিস্থিতি দেখে প্রয়োজনে ইমার্জেন্সি সিজার করে বাচ্চাকে বাঁচানো হয়।
আই.ইউ.জি.আর কী?
যদি কোনও বাচ্চার ওজন গর্ভাবস্থা অনুযায়ী ১০ পারসেন্টাইল কম হয়, তখন তাকে বলে আই.ইউ.জি.আর। ৩-১০ ভাগ ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দেয়। মায়ের রক্তাল্পতা, ওজন কম, প্রেসার বেশি, অপুষ্টি, হার্ট বা কিডনির রোগ থাকলে এ সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের পূর্ণ বিশ্রাম, অ্যাসপিরিন, জিষ্ক প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টার অবস্থান বুঝব কী করে?
আল্টট্রাসোনোগ্রাফি দ্বারা বোঝা যায় প্লাসেন্টার অবস্থান।
অনেক সময় গর্ভাবস্থায় ডাক্তারবাবুরা স্টেরয়েড ব্যবহার করেন শুনেছি, কেন?
গর্ভাবস্থায় ২৮-৩৪ সপ্তাহের মধ্যে সময়ের আগে প্রসবের ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে স্টেরয়েড ব্যবহারের ফলে বাচ্চার ফুসফুস পরিণত হয়, শ্বাসকষ্ট কমে (RDS), ব্রেনে রক্তক্ষরণ কম হয় এবং নেক্রোটাইজিং এন্টেরোকোলাইটিস প্রতিরোধ হয়।
অ্যানেনকেফালি কী?
এটা বাচ্চার গঠনগত সমস্যা অর্থাৎ নিউরাল টিউব ডিফেক্টের উদাহরণ। ১০০০ জনের মধ্যে ১ জন বাচ্চার এ সমস্যা দেখা দেয়। বাচ্চার মাথার খুলি ব্রেনের একাংশ তৈরি হয় না এক্ষেত্রে। আল্টাট্রাসোনোগ্রাফি করে এ সমস্যা ধরা পড়ে। আল্টাট্রাসোনোগ্রাফিতে ২০ সপ্তাহের আগে এ রোগ ধরা পড়লে অ্যাবরশন করিয়ে নেওয়া ভালো।
বাচ্চার ডাউনস সিনঙ্গোম আছে কি না তা কীভাবে বোঝা যাবে?
ট্রিপল টেস্ট-ম্যাটারনাল আলফাটিটোপ্রোটিন, এইচসিজি এবং আন-কনজুগেটেড ইস্ট্রোওল-এর মাত্রা নির্ণয় করে ডাউসন সিনন্ড্রোম বোঝা যায়। ১৫-২২ সপ্তাহে এই টেস্ট করা হয়।
অ্যান্টিপার্টাম হেমারেজ কী?
২৪ সপ্তাহের পর গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণকে বলে অ্যান্টিপার্টাম হেমারেজ। প্রসবের আগে প্লাসেন্টার কারণে রক্তপাত হয় ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে। ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে কোনও কারণ ছাড়াই রক্তপাতহতে পারে। মূল কারণ অবশ্য প্লাসেন্টা প্রিভিয়া। এক্ষেত্রে প্লাসেনন্টা জরায়ুর ওপরের অংশে প্রোথিত না হয়ে অধিকাংশ বা সম্পূর্ণভাবে নীচের অংশে অবস্থান করে। আল্টাট্রাসোনোগ্রাফি করে রোগ নির্ণয় করে রোগীকে হাসপাতাল বা নাসিংহোমে রেখে চিকিৎসা করা হয়। প্রয়োজনে রক্তও দিতে হতে পারে। এ সময় সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিজার করে বাচ্চা প্রসব করানো হয়। তবে প্লাসেন্টা জরায়ুর মুখ থেকে ২-৩ সে.মি ওপরে থাকলে স্বাভাবিক প্রসবও সম্ভব।
পোস্টপার্টাম হেমারেজ কী
প্রসেবের পর থেকে দেড় মাস পর্যন্ত রক্তপাতকে বলে পোস্টপার্টাম হেমারেজ। জরায়ুর শিথিলতা, আঘাত, প্লাসেন্টার কিছু অংশ থেকে যাওয়া এবং রক্তের কোয়াগুলোপ্যাথির কারণে এ ধরনের রক্তপাত হতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রয়োজন না হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।
গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক ওষুধগুলি কী কী?
এ.সি.ই ইনহিবিটর, অ্যানঙ্গোজেন, ফেনিটয়েন, ভ্যালপ্রোয়িক অ্যাসিড, বেনজোডায়াজিপিন, সাইক্লোফসমাইড, ডায়াজোক্সাইড, ইথাইল স্টিলবেস্ট্রল, ইসট্রোজেন, গ্রিসিওফালভিন, মেথোট্রিক্সেড, মিসোপ্রোস্টল, ব্রুফেন, ওপিয়ড, রেসারপিন, সালফোনামাইড, টেট্রাসাইক্লিন, ট্রাইমিথোপ্রিম, ওয়ারফেরিন ইত্যাদি।
গর্ভাবস্থায় প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে কী করব?
গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া খুব সাধারণ সমস্যা। জরায়ু ওল্টানো থাকলে, ফাইব্রয়েড বা ওভারিয়ান টিউমারের কারণে বা অবস্ট্রাকটেড লেবারে প্রস্রাব বন্থ হতে পারে। ক্যাথেটার পরিয়ে প্রস্রাব করানো হয় এসব ক্ষেত্রে।
গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হলে কী ক্ষতি হতে পারে? করণীয় কী?
ডেঙ্গুর উপসর্গ জ্বর. হাত-পা ব্যথা, চোখের পিছন দিকে ব্যথা, চামড়ায় র্যাশ এবং খুব কম ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুর কারণে মিসক্যারেজ, সময়ের আগে প্রসব, গর্ভে সন্তান মারা যাওয়া এবং মৃত সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা থাকে।
স্বাভাবিক চিকিৎসায় শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখা, প্রেসার ফলোআপ করা, প্যারাসিটামল ও রিভাভেরিন জাতীয় ওষুধে উপকার মেলে।
হাইরিস্ক প্রেগন্যান্সি কী? কারা পড়েন হাইরিস্ক প্রেগন্যান্সিতে?
গর্ভাবস্থায় যে-সব ক্ষেত্রে মা এবং গর্ভস্থ শিশুর বা নবজাতকের শারীরিক বা মানসিক অসুবিধা থাকে বা প্রাণহানির সম্ভাবনা থাকে, সেই সব গর্ভাবস্থাকে বলে হাইরিস্ক প্রেগন্যান্সি। শতকরা ৩০ ভাগ মহিলারই গর্ভাবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
কারা পড়েন---
গর্ভবতী বয়ষ ২০-এর কম এবং ৩০-এর বেশি হলে, উচ্চতা ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি বা তার কম হলে, অনেকদিন পর গর্ভবতী হলে, আগে মৃত সন্তান প্রসব হয়ে থাকলে, গর্ভাবস্থায় শেষের দিকে রক্তক্ষরণ হলে, রক্তাল্পতা থাকলে, প্রি-একল্যাম্পসিয়া বা একল্যাম্পসিয়া, যমজ বাচ্চা দু-তিনবার মিসক্যারেজ হলে, আগে সিজার বা ফরসেপস হয়ে থাকলে, হার্টের রোগ, ডায়াবেটিসের প্রবণতা থাকলে।
গর্ভাবস্থায় প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হলে কী
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীতে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটলে, মূত্রানালীর শিরা ফেটে গেলে, ওল্টানো জরায়ুর কারণে, আগের সিজারের জায়গা ফেটে গেলে, বাধাপ্রাপ্ত গর্ভাবস্থায় বা আঘাতের কারণে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হতে পারে। এ সময় জল খেতে হবে প্রচুর। ওষুধ খেতে হবে ডাক্তারবাবুর পরামর্শে। খুব কম জায়গায় অপারেশনের প্রয়োজন হয়।
গর্ভাবস্থায় হার্টের অসুখে কী করব?
গর্ভাবস্থায় হার্টের রোগ থাকলে মহিলাতের শ্বাকষ্ট, হঠাৎ মুর্চ্ছা যাওয়া বা বুকে ব্যথা হতে পারে। বাচ্চা সময়েরে আগে প্রসব হয়ে যেতে পারে, অপরিণত বাচ্চার জন্ম হতে পারে, বাচ্চার বৃদ্ধি বা বুদ্ধি ব্যাহত হতে পারে, হতে পারে বাচ্চার জন্মগত হার্টের রোগ। মারাত্মক হার্টের রোগ থাকলে বাচ্চা না নেওয়াই ভালো। সেক্ষেত্রে অ্যাবরশন করিয়ে নেওয়াই ভালো।
আর প্রসব সব সময় হাসপাতালে বা নাসিং হোমে করানোই ভালো। সাধারণত নর্মাল ডেলিভারিই হয় এই সব মহিলাদের। নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে সিজার করা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জন্ডিস কেন হয়? হলে কী করব?
ইস্ট্রোজেন হরমোন বৃদ্ধির কারণে অনেক সময় পিত্তের সঞ্চালন ব্যাহত হয়ে রক্তের বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস হতে পারে। গর্ভাবস্থায় শেষ দিকে এই রোগ দেখা যায়। দুর্বলতা, বমি ভাব বা বমি, চুলকানি এই রোগের উপসর্গ। সময়ের আগে প্রসব, কম ওজনের বাচ্চার জন্ম বা গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু যেমন ঘটতে পারে, হতে পারে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণও। এ সময় সস্পূর্ণ বিশ্রাম, আলাদা ঘরে রোগীকে রাখা, কার্বহাইঙ্গেট জাতীয় খাবার খাওয়ানো দরকার, মূল কারণ যেহেতু ভাইরাল হেপাইটিস।
টক্সোপ্লাজমা সংক্রমণে কী করব?
গর্ভাবস্থায় কাঁচা মাংস বা বিড়ালের মলের মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন মহিলা। এই সংক্রমণে বাচ্চার বৃদ্ধিব্যাহত হয়। গর্ভপাত ঘটতে পারে, প্রসব হতে পারে মৃত সন্তান। এছাড়া শিশুর হাইঙ্গোকেফালস, কোরিওরেটিনাইটিস, মস্তিষ্ক ছোট হওয়া, বৃদ্ধি হ্রাস হতে পারে। রক্তে টর্চ-পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। এই রোগ ধরা পড়লে ডাক্তারবাবুর পরামর্শে স্পাইরামাইসিন জাতীয় ওষুধ খেতে হয়।
শিরদাঁড়ার ব্যথায় কী করব?
জরায়ুর ক্রমাগত আকার বেড়ে যাওয়ার পিঠে ও কোমরে ব্যথা হয়। হিল-তোলা জুতো না পরে ছোট হিলের জুতো বা চপ্পল পরলে খানিকটা আরাম মেলে। এ সময় হাঁটা-চলা-বসা-শোওয়ায় সঠিখ ভঙ্গিমা প্রয়োগ করা দরকার। সামান্য ব্যায়ামও করা গেলে ভালো উপকার মেলে।
ভেরিকোজ ভেন দেখা দেয় কেন?
জরায়ুর আকৃতি বাড়ার ফলে পেটের শিরাগুলির ওপর চাপ পড়ার কারণে পায়ের রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় ও ভেনগুলি ফুলে ওঠে। এ ছাড়া হরমোনও দায়ী এ সমস্যায়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয় এ সময়। ব্যান্ডেজ বা স্টকিন্স ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায়। তবে বাচ্চা প্রসবের পর এ সমস্যা চলে যায়।
গর্ভাবস্থায় বায়োফিজিকাল প্রোফাইল পরীক্ষা করতে বলেন কেন?
এটা বাচ্চার স্ক্রিনিং টেস্ট। জরায়ু ও প্লাসেন্টার মধ্যে রক্ত সঞ্চালন এবং অক্সিজেন পরিবহণ স্বাভাবিক আছে কি না এই পরীক্ষায় বোঝা যায়। এক্ষেত্রে নন-স্ট্রেস টেস্ট, বাচ্চার মুভমেন্ট, শ্বাস-প্রশ্বাস, পেশির ক্ষমতা এবং অ্যামনিওটিক ফ্লুইড ওপরে স্কোর করা হয়। টোটাল স্কোর১০। ৮-১০ স্কোর স্বাভাবিক, ৬ বা তার কম হলে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাচ্চার মুভমেন্ট কীভাবে কাউন্ট করব?
সাধারণত সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় ১ ঘন্টায় কতবার নড়াচড়া করে, সেটাকে ৪ দিয়ে গুণ করে মুভমেন্ট সংখ্যা বলা হয়। ১২ ঘন্টায় ১০ বার বাচ্চার মুভমেন্ট হলে কোনও সমস্যা থাকে না।
গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্টের কারণ কী?
প্রচন্ড রক্তাল্পতা এবং পালমোনারি ইডিমার কারণে খুব শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ ছাড়া প্রি-একল্যাম্পসিয়া, অ্যাবরাপসিও প্লাসেন্টা এবং ফুসফুস ও হার্টের কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় গা অতিরিক্ত চুলকায় কেন?
গর্ভাবস্থায় এক অতি সাধারণ সমস্যা গা চুলকানো। ইস্ট্রোজেন হরমোনের আধিক্যের কারণে কোলেস্ট্যাটিস হতে পারে, যার কারণে বাইল অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সারা গা চুলকায় এবং জন্ডিসও দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে প্রি-টার্ম ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্যালামিন লোশন, অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় বড়ি বা ডাক্তারবাবুর পরামর্শে কোলেস্টাইরামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন