বক্ষ ব্যাধি - ইনহেলারেও শ্বাসকষ্ট যাচ্ছে না?
ডাঃ অজয় সরকার
2019-05-07 12:30:02
বক্ষ ব্যাধি বা ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজ আমরা সেই গ্রুপকেই বলে থাকি যেখানে দুটো লাঙ-ই ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সব ক্ষেত্রেই বা টোটাল সেগমেন্টেই এটা হয়। এর আরও একটা নাম আছে ডিফিউজ লাঙ ডিজিজ। লাঙ বা ফুসফুসের গঠন অনুযায়ী একে তিন ভঅগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলোই ইংরেজিতে বললেই সুবিধা হয়। ভাগগুলো হল—প্যারেনকাইমা স্টেক্টর, ভাসকুলার সেক্টর ও এয়ারওয়েজ। যখন এয়ারওয়েজ ডিজিজ হয় তখন সেগুলোকে আমরা অ্যাজমা, সিওপিডি ইত্যাদি বলি। যখন ব্লাড ভেসেলসে সমস্যা হয় তখন প্রাইমারি পালমোনারি আর লাঙের প্যারেনকাইমা বা সম্পূর্ণ অংশটাই আক্রান্ত হলে তখন তাকে ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজ বলা হয়। এই বিষয়টি বেশ জটিল।
দেখা গেল এইসব রোগীর অনেকদিন ধরে কাশি হচ্ছে এবং সেটা খুব শুকনো কাশি সেরকম কিছু বেরোচ্ছে না অর্থাৎ কাশির সঙ্গে কোনো কফ উঠছে না অথচ একটু চলাফেরা করলেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজে ফুসফুসে কফের সঞ্চার হয় এবং তা কাশির সঙ্গে ওঠে। সঙ্গে রক্তও উঠতে পারে, তবে এটা খুবই ব্যত্যিক্রমী দৃষ্টান্ত। সাধারণত শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং লাঙে কিছু ফাইন্ডিংস থাকে যেগুলোকে আমরা বলি ক্রেপিটেশানস এবং এগুলো ঠিক নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে যেগুলো ডাক্তারবাবু দেখলেই বুঝতে পারেন। এতক্ষণ যা বললাম সেগুলো হল উপসর্গ।
চেষ্টা এক্স-রে কোনো কোনো সময় স্বাভাবিকও হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রিপোর্টে যা সমস্যার কথা থাকে সেগুলো দেখেই এই রোগটিকে সন্দেহ করা হয়। এই রোগটিকে নিশ্চিত করার জন্য আগে বায়োপসি করা হত। এখন HRTC (হাই রেজোলিউশন সিটি থোরাক্স) করে এই রোগের একটা বিশেষ প্যাটার্ন বা ধরন চিহ্নিত করা হয়। আসলে এই রোগের গ্রুপটা একটা বিশাল গ্রুপ এবং এর প্যার্টানগুলোও বিভিন্ন ধরনের হয়। এই বিভিন্ন ধরনের প্যাটার্নের দ্বারা আক্রান্ত রোগের প্রকৃতিগত বিভিন্নতা থাকে। রোগীরা সাধারণত অ্যাকিউট অবস্থায় আসেন। এই অ্যাকিউট অবস্থা হল যখন রোগটা কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বেড়ে যায়। আবার সাব-অ্যাকিউট একটা গ্রুপ আছে, যেখানে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসে রোগটা বেড়ে যায়। আর একটি গ্রুপের কথা বলব যেটাকে ক্রনিক গ্রুপ বলা হয়, সেটা তিন থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগে রোগটা বাড়তে।
এবার বলি বক্ষ ব্যাধি বা ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজ ঠিক কী ধরনের হয়। সাধারণত এতে লাঙসের মধ্যে ফাইব্রোসিস হয় এবং লাঙসে গ্যাস এক্সচেঞ্জটা অ্যাফেক্ট করে। HRTC-তে ফাইব্রোসিস দেখা যায়। এই রোগে ফাইব্রোসিসটাই মূল সমস্যা। এছাড়া এর সঙ্গে নডিউলস, হানিকুম্বিং ইত্যাদি প্যাটার্নগুলো দেখে আমরা এগুলোর শ্রেণীবিভাগ করি। ডাক্তারি পরিভাষা অনুযায়ী আমরা এটাকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করি। একটা গ্রুপ যারা চিকিৎসায় সাড়া দেন, আরেকটা গ্রুপ আছে যাদের ক্ষেত্রে রোগটা চিকিৎসায় সাড়া দিতেও পারে বা না দিতেও পারে এবং সর্বশেষ গ্রুপটি হল চিকিৎসা সেভাবেই হোক না কেন একেবারেই সাড়া মেলে না এবং ক্রমাগত পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যায়। সেই কারণে এই শেষ গ্রুপেরে মানুষদের জীবনের গন্ডিটা ছোট হয়ে আসে এবং সাধারণত দেড় থেকে দু’বছরের বেশি বাঁচবে না।
আরেকটা গ্রুপ আছে তাদের সেকেন্ডারি কারণ থাকে। যেমন—টক্সিন, কিউমাস, নানারকম ইনফেকশন। অথবা কিছু কোলাজেন ডিজিজের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে। এই ধরনের গ্রুপগুলোর চিকিৎসা করলে অনেকদিন পর্যন্ত রোগী ভালো থাকে।
এছাড়া আরেকটা গ্রুপ যাদের কোনো ইনফেকশন থেকে সমস্যা হলে তাদেরকে স্টেরয়েড দেওয়ার পর শারীরিক উন্নতি লক্ষ করা যায় এবং বেশ কিছুদিন তারা ভালো থাকে।
সাধারণ মানুষকে আমার যে কথা বলা দরকার তা হল, যাদের অনেকদিন ধরে ক্রনিক কাশি থাকে ও সঙ্গে শ্বাসকষ্ট থাকে যা ইনহেলার দিয়েও কমছে না, সেক্ষেত্রে তাদেরকে ভালো একজন চেষ্ট ফিজিশিয়ানকে দেখিয়ে নিতে হবে। আমি কিছু্ক্ষেত্রে দেখেছি যে আই.এল.ডি রোগীর দুটো, তিনটে ইনহেলার নিচ্ছেন কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। বরং তাদের ক্ষতি হচ্ছে। সেজন্য যেক্ষেত্রে কাশি, শ্বাসকষ্ট কোনো কিছুতেই কমার লক্ষণ থাকে না, তখন ভালো চেষ্টা ফিজিশিয়ানকে দেখালে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দিতে পারবেন যে রোগীর বক্ষ ব্যাধি বা ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজ রয়েছে কি না। এক্ষেত্রে আমি আমার নিজস্ব চিন্তাভাবনার পরিপ্রেক্ষিত, অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখেছি যে লিভারে যখন ফাইব্রোসিস হয় তখন তাকে সিরোসিস অফ লিভার বলা হয়। ঠিক তেমনই লাঙের ফাইব্রোসিসটাও সিরোসিস অফ লাঙ হতে পারে। এটা হয়তো বইয়ে লেখা নেই, কিন্তু দীর্ঘ ডাক্তারি অভিজ্ঞতায় আমি এই রোগটিকে সিরোসিসের মতোই মনে করি। অনেকেই লিভারের সিরোসিস সম্পর্কে জানেন, কিন্তু লাঙের ক্ষতিকর রূপটা ঠিক এরই মতো—এটা অনেকেই জানেন না। আমি অন্তত আমার রোগীদের কাছে এভাবেই বলি।
বক্ষ ব্যাধি বা ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজ এক অর্থে ক্ষতিকর, কিন্তু সেটা মেনে নিয়েও বলব প্রথম অবস্থাতেই ইন্টারস্টিসিয়াল নির্ধারণ হওয়ার পর ভেঙে পড়ার কিছু নেই। এটি জটিল রোগ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই রোগের প্রচুর শাখা-প্রশাখা বা ডিফারেন্ট প্যাটার্ন এবং প্রত্যেকটির ধরণ-ধারণে কিছু পার্থক্য আছে। সবগুলোই কিন্তু খারাপ ধরনের হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েখটি উন্নত চিকিৎসায় রোগী অনকদিন পর্যন্ত ভালো থাকেন। তবে প্রথমেই আই.এল.ডি রোগটি আছে কিনা সেটি চিহ্নিত করতে হবে। এরপর এটি আই.এল.ডি-র কোনো প্যাটার্নের মধ্যে পড়ছে তা নির্ধারণ করতে হবে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রেই চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে ভালো রাখা সম্ভব হয়। যাদের রোগের ধরনটা খারাপ ধরনের তাদেরও কাউন্সেলিং করা হয়। আবার এইসব রোগীদের যদি সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয় এবং লাঙ ফাংশন খারাপ থাকে তখন কিন্তু রোগীর অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যায়। এমনও হয় রোগী এই রোগটির জন্য হয়তো মারা গেলেন না, তার মৃত্যু হল সংক্রমণের কারণে। এক্ষেত্রে কোনো সুযোগ পাওয়া যায় না।
এই আই.এল.ডি রোগীদের ক্ষেত্রে আরেকটা কথা বলি, এই ধরনের রোগীদের আমরা ভেন্টিলেট করতে ভয় পাই। তার কারণ হল এদেরকে যদি টিউব পরিয়ে ভেন্টিলেট করা হয় সেক্ষেত্রে তাদেরকে সেখান থেকে বের করা খুবই বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। তাই আমরা চাই এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে বাই প্যাপ মানে মাস্ক ভেন্টিলেশন করে একটু সাপোর্ট বাড়িয়ে যাতে তাকে ঠিকভাবে বের করা যায়। সেজন্য এই ধরনের রোগীদের যখন শারীরিক অবস্থা একটু খারাপ মনে হয় তখনই সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। কারণটা আগেই বলেছি যে প্রাথমিক অবস্থাতেই বাই প্যাপ মাস্ক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে এবং কোনোভাবেই দেরী করে ভেন্টিলেশনে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি যেন না হয়।
বক্ষ ব্যাধি বা ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজ নিয়ে অনেক কিছুই বলা আছে। তবে খুব সহজে যাতে মানুষ বুঝবেন সেভাবেই আবারও বলছি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট যখন কিছুতেই ভালো হচ্ছে না, এমনকী ইনহেলার ব্যবহার করেও সুফল পাচ্ছেন না তখন বুঝতে হবে এটা অন্যকিছু। এক্ষেত্রে এক্স-রে কোনো কোনো সময় স্বাভাবিক মনে হলেও তা স্বাভাবিক নয় এবং এটা ডাক্তারবাবুরাই বুঝবেন। এক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান করে আমরা এই রোগটাকে নির্ধারণ করতে পারি। স্বাভাবিকভাবে বলা যায় যে আমাদের দেশে এই রোগে আক্রান্তর সংখ্যা যথেষ্ট। আসলে যতদিন যাচ্ছে মানুষ সচেতন হচ্ছেন। সিটি স্ক্যানের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে এবং রোগ নির্ধারণ করতে সুবিধা হচ্ছে। রোগটা অনেকদিন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু নির্ধারণ করার সুযোগ যেমন সিটি স্ক্যান ইত্যাদি আগে না থাকাতে রোগটাকে ধরা যেত না। ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজের কিছু গ্রুপ আছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ যা বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ রোগের জেনেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আবার পারিপার্শ্বিক দূষণ এই রোগকে বৃদ্ধি করে। এছাড়া ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজের অনেক শ্রেণীবিভাগের মধ্যে এমন কিছু শ্রেণী আছে যেগুলো কোলাজেন ডিজিজের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। এরা লাঙসে ফাইব্রোসিস সৃষ্টি করতে পারে। আরেকটা বিরাট গ্রুপ আছে যেগুলোতে কিছু কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার লাঙসে ফাইব্রোসিস সৃষ্টি হয়। কার্ডিয়াক পেশেন্টরা অ্যামিওডোরন খুব খান। এটা থেকেও হতে পারে। আবার নাইট্রোফুরালটয়েন নামের অ্যান্টিবায়োটিক ফাইব্রোসিস সৃষ্টি করতে পারে।
আরেকটা গ্রুপ আছে, অ্যাকিউট হয় যাকে ফারমারস লাঙ বলি। আবার যারা পাখি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাদেরগুলোকে আমরা পিজিয়নস লাঙ বলি। তাদেরও আই.এল.ডি-র মতো উপসর্গ থাকে। এটাও একটু গ্রুপ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক দূষণ যেমন শিল্পাঞ্চলেও লাঙ ফাইব্রোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আমি বার বার যে বিষয়টায় জোর দিচ্ছি তা হল প্রথম থেকেই সচেতন হতে হবে। দীর্ঘদিনের শুকনো কাশি, চলাফেরায় শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গেই চেষ্ট স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে বলি, আমরা প্রথমেই এটা কার্ডিয়াল সমস্যা কিনা সেটা দেখে নিই। তা যদি না হয় তারপর লাঙসের বিভিন্ন টেস্ট করে এটা কী ধরনের লাঙ ডিজিজ তা নির্ধারণের চেষ্টা করি। তবে এতে খুব ভয় পাওয়ার কারণ নেই। এই রোগের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ সম্পর্ক নেই। তবে এই আই.এল.ডি-র ভ্যাকসিন এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়া উচিত যাতে সংক্রমণ না হয়। এছাড়া সিজন্যাল চেঞ্জের সময় একটা ভাইরাল ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং তাতে লাঙসের কাজকর্মের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে, শ্বাসকষ্ট হয়। আই.এল.ডি-তে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়। ফলে রোগী সর্বক্ষণ দিয়ে রাখতে হয়। এটাই মূল চিকিৎসা। তাছাড়া স্টেরয়েড দিতে হয়। আজকাল অনেক সময় বেরিয়েছে সেগুলো আমরা ব্যবহার করি। তবে যেটাকে আমরা ম্যাজিক ট্রিটমেন্ট বলি সে ধরনের কিছু এখনো বেরোয়নি। তবে এর ক্ষতির মাত্রাকে কিছুমাত্রায় কমিয়ে দেওয়া যায়। মারাত্মক ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তার ওপর এখন লাঙ ট্রান্সপ্ল্যান্ট হচ্ছে। যদিও এর দাতা পাওয়া খুব মুশকিল, তবুও সম্প্রতি জলপাইগুড়ির একজন মাদ্রাজ থেকে এই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করিয়ে ভালো আছেন। আশার কথা, অন্যান্য অসুখের তুলনায় এই রোগের প্রাদুর্ভব কিছুটা কম। সচেতন হোন, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করুন---- ভালো থাকবেন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন