১০ ঘন্টায় মানুষকে শয্যাশায়ী করে দিতে পারে গেঁটে বাত
ডাঃ সুদর্শন চক্রবর্তী
2019-05-09 14:11:06
বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী ও কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়া লোকের সংখ্যা কম নয়। পেশি ও অস্থিসন্ধিতে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা হওয়াকে বাত বলে। গাউট বা গেঁটে বাত এমন একধরনের রোগ, যার উদ্ভব হয় মেটাবলিজমের বিশৃঙ্খলা থেকে।
আমাদের শরীরে মোট বাইশটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে চোদ্দটি তৈরি হয় দেহের মধ্যে। বাকি আটটি বিভিন্ন খাদ্য থেকে আহরণ করা হয়। এক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলোকে দেহের নানা প্রয়োজনের জন্য উপযুক্ত করে তোলা হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তী পর্যায়ে পিউরিন নামে এক ধরনের প্রোটিন পাওয়া যায় যা এক ধরনের এনজাইমের মাধ্যমে সংশ্লেষিত হয়ে তৈরি হয় ইউরিক অ্যাসিড। এই ইউরিক অ্যাসিড সাধারণত আমাদের প্রস্রাবের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যখন শরীরে খুব বেশি ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয় আর বেরোয় কম, তখনই মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।
ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ কীরকম
থাকা উচিত
শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক পরিমাণ মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬মিলিগ্রাম আর পুরুষদের ক্ষেত্রে সাধারণতভাবে ৭ মিলিগ্রাম। এই পরিমাণে থাকলে কোনো সমস্যা হয় না।
রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ
বেড়ে গেলে কী কী ক্ষতি হতে পারে
রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাবার কারণে নানা রোগ হতে পারে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় গাউট। অবশ্য গাউট কিছু ক্ষেত্রে নর্মাল মাত্রায় ইউরিক অ্যাসিড থাকলেও অনেকের হতে দেখা যায়।
আবার ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি আছে কিন্তু গাউট হয়নি এমনটাও দেখা যায়। এছাড়া ক্রনিক গাউটের কারণে জয়েন্ট, কানে, চোখে, চোখের পাতায়, স্পাইনাল কর্ডে সলিডনডিউলস দেখা যায়। স্পাইনাল কর্ডে গাউট হলে প্যারালিসিস পর্যন্ত হতে পারে। ইউরিক অ্যাসিড বেশি হবার কারণে কিডনিতে ইউরিক অ্যাসিড স্টোন হতে পারে।
কাদের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা
বেশি থাকে
কিছু কিছু রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলত্ব, বেশি কোলেস্টেরল, বেশি টাইগ্লিসারাইড বা রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে সেই রোগীর রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা সাধারণত বেশি হয়। হাইপারটেনশন থেকেও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ে।
ইউরিক অ্যাসিডের কারণে যে যে সমস্যা হয়
- গাউট : ইউরক অ্যাসিড থেকে সৃষ্ট পরিচিত সমস্যা হল গাউট। সাধারণভাবে দেখা যায় সন্ধিস্থূলগুলো ফুলে ওঠে, ব্যথা হয় প্রচন্ড। পায়ে হলে হাঁটা-চলার অসুবিধে দেখা যায়। ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল, জয়েন্টে, হাড়ে, টিস্যুতে, টেনডনে এমনভাবে জমা হয় যে তার ফলে জায়গাটা ফুলে ওঠে, ব্যথা হয়। পায়ের বুড়ো আঙুল হঠাৎ করে শুরু হয়, প্রচন্ড যন্ত্রণা, যন্ত্রণায় রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। একে গাউট আর্থ্রাইটিস বলে।
চিকিৎসা :
ব্যথা কমানোর ওষুধ দিয়ে ব্যথা কমাবার আপৎকালীন ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ব্যথা কমানোর ওষুধ থাকলেও সাধারণ ব্যথা কমানোর ওষুধ ব্যবহার করাই ভালো। যেক্ষেত্রে আলসার বা অন্য কারণে ব্যথার ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগস দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ব্যথা কমাবার পর রক্ত পরীক্ষা করে ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ব্যথা কমার পর রক্ত পরীক্ষা হয়। প্রাথমিকভাবে ব্যথা কমার পর রক্ত পরীক্ষঅ করে ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে রিপোর্টে রক্তে ইউরিক অ্যাসিড লেভেল বেশি থাকে।
ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ যদি খুব বেশি বাড়ে-কমে তাহলে গাউট হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অ্যাকিউট গাউট আট থেকে দশ ঘন্টার মধ্যে যেকোনো মানুষকে শয্যাশায়ী করে দিতে পারে। এর ফলে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়।
- হার্টের সমস্যা : ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকলে হার্টের নানা সমস্যা দেখা দেয়। এদের মেটাবলিক সিনড্রোমও দেখা যায়। যেমন ওবেসিটি, ব্লাডপ্রেসার, রক্তের লিপিড প্রোফাইল ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে বলে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ হবার প্রবণতা বাড়ে।
- কিডনি : ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলে কিডনিতে স্টোন হতে পারে। কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে রেনাল ফেলিওরও হতে পারে। তাই কিডনির সমস্যা থাকলে সাবধান হতে হবে যাতে কিডনি খারাপ না হয়ে যায়।
- কোমর ব্যথা : কোমর ব্যথা নানা কারণে হতে পারে কিন্তু ইউরিক অ্যাসিড থেকে কোমরে ব্যথা হওয়াটা অসম্ভব নয়।
পারিবারিক ইতিহাস থাকলে
কী পরবর্তী জেনারেশনে
সমস্যা হতে পারে
রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে পারিবারিক ইতিহাসকে রাখা যেতে পারে। এমনিতে নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে রোগটা ছেলেদেরই হয়। মেনোপজের পর মেয়েদেরওহদে দেখা যায়।
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা
কীভাবে নির্ণয় করা হয়
শুধুমাত্র রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেপটিক আর্থ্রাটিস আছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে জয়েন্ট থেকে ফ্লুইড নিয়ে ক্রিস্টালগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা হয়।
ইউরিক অ্যাসিড কম/বেশি থাকলে
কী ধরনের সমস্যা হয়
ইউরিক অ্যাসিড কম থাকলে সাধারণত কোনো সমস্যাই হয় না। তবে অন্তঃসত্বা মহিলাদের ইউরিক অ্যাসিড কম থাকলে এক্ল্যাম্পশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই মাত্রা কম থাকলে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ে যাবার আগে লাইফস্টাইল মডিফিকেশন জরুরি। যেমন নিয়মমতো শরীরচর্চা, সঠিক ডায়েট, তাজা ফল, সবজি বেশি করে খেতে হবে। ফ্যাট কম খেতে হবে। সঠিক ডায়েট ও শরীরচর্চার মাধ্যমে সেটাবলিক সিনড্রোম ও ওবেসিটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কারণ এরাই দায়ী থাকে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাবার জন্য।
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কোন
বয়সে বেশি হতে পারে
সাধারণভাবে দেখা যায় পুরুষদের ক্ষেত্রে চল্লিশ থেকে ষাট বছর বয়সের মধ্যে এবং মহিলাদের ষাট বছরের বেশি হলে এই সমস্যা বাড়ে।
খাবার কী ধরনের খাওয়া উচিত
ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাবার পিছনে কিছু কিছু খাবারের যথেষ্ট ভূমিকা থাকে। যেমন সি-ফুড, ইলিশ, পমফ্রেট, চিংড়ি, অ্যালকোহল, উচ্চমাত্রার পিউরিন যুক্ত খাবার, রেডমিট, লিভার ইত্যাদি খাওয়ার কারণে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যায়। রেডমিট, অ্যালকোহল এগুলোকে বাদ দেওয়া হলে ভালো হয়। অনেকে ঢেঁড়শ, বিনস, মুসুর ডাল বাদ দেয় কিন্তু একেবারে বাদ না দিয়ে একটু কম গ্রহণ করা যেতে পারে।
শূকরের মাংস অনেক সময় ইউরিক অ্যাসিড বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন ধরনের সফট পানীয় খেলেও ইউরিক অ্যাসিড বাড়তে পারে। সব ধরনের স্পিরিটই ইউরিক অ্যাসিড বাড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে বিয়ার। তবে ওয়াইন কিছুটা নিরাপদ। এছাড়া কিছু ওষুধ থেকেও ইউরিক অ্যাসিড বাড়তে পারে, যেমন রক্তচাপের ওষুধ। কম মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। চল্লিশ বছর বয়সের পরে বছরে একবার ইউরিক অ্যাসিড পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। কারণ অনেক সময় ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায় কোনোরকম লক্ষণ প্রকাশ না করেই। দরকারে ওষুধ ব্যবহার করুন।
অনলাইনে চিকিৎসা সেবা পেতে আজই ডাউনলোড করুন হ্যালো ডাক্তার এশিয়া অ্যাপ
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন