খেয়ে খেয়ে হার্টের অসুখ
ডাঃ সৌমিত্র রায়
2019-05-18 14:12:22
বাঙলি জীবনের প্রথম বিনোদন হচ্ছে খাওয়া। তার সারাদিন আবর্তিত হয় খাওয়ার চিন্তায়। একটা খাওয়া শেষ হবার আগেই শুরু হয় পরের খাওয়ার চিন্তা। রবীন্দ্রনাথ অবধি এই পালে হাওয়া দিয়ে গেছেন ‘জেনো বাসনার সেরা বাসা রসনায়’। বাঙালি রান্না এবং খাওয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কিছুদিন আগে অবধিও নিমন্ত্রণ বাড়িতে রসগোল্লা বা মাংস খাবার প্রতিযোগিতা হত। জয়ীকে বীরের সম্মান দেওয়া হত। এখনো শিশুপ্রদর্শনীতে গাবলুগুবলু গালফোলা বাচ্চার কদর, মা-বাবার গর্ব মোটাসোটা বাচ্চা। আর যার বাচ্চার ওজন স্বাভাবিক তাকে শুনতে হয় ‘বাচ্চাকে ঠিকমতো খেতে দাও না’। এই যেখানে আমাদের মাইন্ডসেট, সেখানে আজকের বিষয় নিয়ে কিছু লিখতে গেলে এই গৌরচন্দ্রিকা একান্ত জরুরি।
তাহলে কি আমরা খাব না? আলবাৎ খাব। ‘না খেলে নাই কোনো সুখ’! কিন্তু কী খাব আর কতটা খাব সেটা জেনে নেব। সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নিদান ছিল ওষুধপথ্য। অর্থাৎ শুধু ওষুধে অসুখ সারবে না, পথ্য অর্থাৎ খাবারও সমান জরুরি। এবং এখানো রোগীর প্রথম এবং শেষ প্রশ্ন ডাক্তারকে ‘ডাক্তারবাবু, কী খাব?’ বলতে ইচ্ছে হয় হার্ট অ্যাটাকটা হবার আগে যদি এই প্রশ্ন করতেন তাহলে হয়তো আরও বেশিদিন খাবার জন্য বেঁচে থাকতেন।
হার্টের অসুখে খাবারের অবদান অসীম। শরীরের ওজন হচ্ছে সবথেকে জরুরি। উচ্চতা অনুযায়ী ওজনের মাপ আছে। তাকে বলে বি.এম.আই। আদর্শ বি.এম.আই রক্ষা করাই খাওয়া-দাওয়ার মূল কথা। সারাদিনে কত ক্যালোরি খাবার আপনি খাচ্ছেন আর কত ক্যালরি ব্যয় করছেন কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তার ফলাফলই আপনার বি.এম.আই-এর নিয়ন্ত্রক। তাহলে জেনে নিতে হবে অতিরিক্ত ক্যালোরি কিসে আছে। যেকোনো ফ্যাট জাতীয় খাবারে ক্যালোরি থাকে সবথেকে বেশি। অর্থাৎ তেল, ঘি, চর্বিযুক্ত মাংস। এগুলোর ব্যবহার হবে যথাসম্ভব কম। মাঝারি ক্যালোরি থাকে শর্করা এবং প্রোটিন। অর্থাৎ ভাত, রুটি, দুধ, ডাল, মাছ ইত্যাদি খেতে হবে মাত্রা রেখে। আর যত ইচ্ছে খাওয়া যাবে শাকসবজি (মাটির তলার সবজি বাদ), ফল (আম, কলা, কাঁঠাল বাদে), টকদই।
তেলের মধ্যে ব্যবহার করবেন (যথাসম্ভব কম করে) সান ফ্লাওয়ার, রাইস ব্র্যান আর সরষের তেল। বর্জন করবেন নারকেল, রেড পাম তেল, ডালডা। যে তেলই ব্যবহার করুন বেশি ভাজবেন না। অলিভ তেলে রান্না করা ভালো। তবে বাঙালির রান্নায় বোধহয় ব্যবহার করা কঠিন।
মাছের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ খান, যেমন ইলিশ, ভেটকি, পমফ্রেট। যত কম ভাজবেন ততই ভালো। পাকা পোনা এড়িয়ে চলুন। আর আড়, বোয়াল। মুরগি বা কচি পাঁঠা চলবে। রেওয়াজি খাসির মাংস তোলা থাক বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য। ডিম চলবে, সাদা হলুদ সব।
কাঁচা নুন বর্জন করুন। রান্নায় স্বাভাবিক নুন খাবেন। আর এড়িয়ে চলুন চিনি আর মিষ্টি। স্বাস্থ্যের জন্য মিষ্টির থেকে আর খারাপ কিছু হয় না।
শর্করা জাতীয় খাবারে চলে যান সাদা থেকে খয়েরির দিকে। অর্থাৎ ময়দা থেকে আটা, সাদা চাল থেকে লাল চাল, সাদা পাউরুটি থেকে ব্রাউন ব্রেড, সাদা কর্নফ্লেক্স থেকে খয়েরি কর্নফ্লেক্স। একবার প্রাপ্তবয়স্ক হলে দুধ খাবার প্রয়োজন বিশেষ নেই, যদি খানও, স্কীমড মিল্ক বা ডাবল টোনড দুধ। বরং খান বাড়িতে পাতা টক দই, চিনি দিয়ে নয়।
বাইরের খাবার মাঝেমাঝে শখ করে খাওয়া যায়। কিন্তু নিয়মিত বার্গার, ভাজা মুরগি, চাউমিন, চিজ-পিৎজা একেবারেই নয়। অফিসে, স্কুলে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যান। একান্ত না পারলে খান গোটা ফল, ডিম সেদ্ধ, টোস্ট।
আর এই খাদ্যাভ্যাস শুরু করান বাচ্চা বয়স থেকে। মোটাসোটা বাচ্চা চটকাতে ভালো, কিন্তু আপনি তার ভবিষ্যৎটাও সেই সঙ্গে চটকে দিচ্ছেন। ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার, হার্ট অ্যাটাক দাঁড়িয়ে আছে পথের বাঁকে।
গর্বিত বোধ করতে দিন সেই মাকে যার বাচ্চার ওজন আদর্শ, যা কিনা আমাদের চোখে ‘বড্ড রোগা’। আর যারা প্রাপ্তবয়স্ক, ওজন ঠিক রেখেছেন, তাদেরকে বলা ছাড়ুন, ‘আপনি কেমন শুকিয়ে যাচ্ছেন, ডাক্তার দেখান।’
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা করুন। দেখার দৃষ্টি বদলান। সঠিক খাবার সঠিক পরিমাণে খান। আর বহুদিন ধরে উপভোগ করুন দেবতার দেওয়া উপহার ----জীবন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন