যে সমস্ত রোগ সারে না
ডাঃ স্বপন কুমার জানা
2019-05-21 12:19:53
মানব শরীরের এমন কিছু রোগ আছে যেগুলি পুরোপুরি সারে না। এইসব রোগজনিত যন্ত্রণা বা কষ্টের তীব্রতাকে সাময়িকভাবে কমানো যায় মাত্র। অথচ এক শ্রেণীর অসাধু্ ব্যক্তি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এইসব রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হবে, এই প্রতিশ্রতি দিয়ে চিকিৎসার জন্য ওষুধ প্রয়োগ করে মানুষকে প্রতারিত করে চলেছেন। আসলে মানুষের রোগ হওয়া মানেই তা কষ্ট, যন্ত্রণা, অস্বস্তি, অশান্তি ইত্যাদিরই অভিব্যক্তি। এই সমস্ত সমস্যার বিরুদ্ধে প্রথমে জীবন নিজে লড়াই চালায়। অর্থাৎ মানুষের শরীর প্রথম প্রতিরোধ গড়ে।
প্রকৃতিতে যেকোনো জীবনের (মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, জীবাণু প্রভৃতি) রোগের বিরুদ্ধে লড়াই প্রাকৃতিক ও সামাজিকভাবেই ঘটে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীবনের সামাজিক অবস্থান নেই। ফলে তাদের রোগের বিরুদ্ধে লড়াই প্রধানত প্রাকৃতিক। এই প্রাকৃতিক লড়াইয়ে সমাজের প্রভাব পরোক্ষভাবে রয়েছে। যেমন গৃহপালিত পশু, সামাজিক বনসৃজন, মাছ চাষ বা চিড়িয়াখানার জন্ত্তু জানোয়ারেরা সামাজিক সুরক্ষা পেয়ে থাকে।
জীবন সবসময় মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে চলেছে। মৃত্যু ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। জীবন শুধু মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করে না, সে মৃত্যুর সাথে বন্ধুত্বও করে। মৃত্যুকে স্থায়ী বন্ধু করে জীবন তার জয়যাত্রার পতাকা ওড়ায়। জীবন-মৃত্যুর বিরোধ এবং বন্ধুত্বের মধ্যে বিরোধ অপ্রধান হলে আমরা বলি ‘আমরা বেঁচে আছি’। আর বন্ধুত্ব অপ্রধান হলে আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি।
মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষ বা প্রকৃতির যেকোনো বড় জীবের সব কোষের মৃত্যু হয় না। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি কোষ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে। আর প্রতি মুহূর্তে যারা মরছে তারা নিজেদের মৃত্যুর বিনিময়ে জীবনকে চলমান রাখে।
জন্ম যার হয়েছে, মৃত্যু তার অনিবার্য। জীবন সবসময় সমস্ত প্রাণী জগতের ক্ষেত্রে মৃত্যুকে স্বাগত জানায়। এ ঘটনা প্রকৃতির চিরস্তন সত্য। খেয়াল করলে দেখবেন জীবনের স্থায়ী বন্ধু হচ্ছে মৃত্যু। যদি আমাদের শরীরের অসংখ্য কোষের মৃত্যু না ঘটত তাহলে নতুন কোষদের জীবনের অগ্রগতি থেমে যেত।
এই জীবন এগিয়ে চলার পথে যখন আক্রান্ত হয় বা রোগের মুখোমুখি হয় তখন সে বাধা অতিক্রম করার মধ্যে দিয়ে এক ধরনের শান্তির পথে পা ফেলে। শান্তির পথে পা বাড়ানো মাত্র আবার নতুন ধরনের যন্ত্রণাকে (এক ধরনের আরাম ও কষ্টের মধ্যে বিরোধ ও ঐক্য) জীবন স্বাগত জানায়। বাধাগুলো জীবনের মধ্যেকার হলে তাকে বলি প্রাকৃতিক। আর সমাজের প্রভাবে হলে তাকে বলি সামাজিক। প্রকৃতি জগতে কেবল মানুষের জীবনই সামাজিক ও প্রাকৃতিক অনিবার্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়ে জীবনের জয়গান গায়।
কখনো জীবনের প্রাকৃতিক বা শারীরিক বিরোধগুলো (দ্বন্দ্ব ও ঐক্য) সারা জীবন ধরে চলমান থাকে। যখন দ্বন্দ্বের বিরোধগুলো প্রধানহয় তখন শরীর যন্ত্রণা পায়, কষ্টে পড়ে। আর অপ্রধান হলে মেলে আরাম। কিন্তু কখনোই দ্বন্দ্বগুলোর নিষ্পত্তি হয় না। বা কোনোভাবেই বিরোধ মেটানো যায় না।
মানুষের রোগ সমূহের মধ্যে হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বার্ধক্যজনিত সমস্যা ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন বিষয়ের দ্বন্দ্ব বা বিরোধ এবং বন্ধুত্ব বা ঐক্যের ফসল। এই সমস্ত দ্বন্দ্বগুলোর পুরোপুরি নিষ্পত্তি ঘটানো যায় না। দ্বন্দ্বের তীব্রতা কমানো যায় মাত্র।
মানুষ চাইবে এই সমস্ত রোগ থেকে পুরোপুরি মুক্তি। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। যেদিন প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে আরও ভালোভাবে বা গভীরভাবে জানা যাবে সেদিন হয়তো রোগীদের এই সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।
এই সমস্ত রোগে মুক্তি মেলে না বলেই মানুষ রোগ সারানোর আকাঙক্ষা করে। এরই সুযোগ নিয়ে অর্থাৎ রোগ সারানোর আশ্বাস বা প্রতিশ্রতি দিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি রোগীদের প্রতারিত করে।
এই প্রতারণা আটকানোর জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করে রোগী ও জনসাধারণকে সুরক্ষা দেয়। রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক চরিত্র অনুযায়ী জনগণ আইনের সুযোগ সুবিধা পান।
একটি আইন হচ্ছে ‘ওষুধ ও প্রসাধনী আইন—১৯৪০’। এরই ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে ‘ওষুধ ও প্রসাধনী আইনি-বিধি ১৯৪৫। এই আইনি বিধির শিডিউল-জে (Schedule-J) ধারায় কতকগুলি রোগের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে- কোনো ওষুধ দ্বারা রোগগুলির সম্পূর্ণ নিরাময়, প্রতিরোধ করা যাবে এমন প্রতিশ্রতি দিলে বা ব্যবহারকারীদের সেরে যাবার আশ্বাস দিলে তা হবে দন্ডনীয় অপরাধ।’ “Diseases which a drug may not purport to prevent or cure—(1) No drug may purport or claims to prevent or cure or may convey to the intending user there of any idea that it may prevent or cure one or more of the diseases or ailment specified in schedule-J (2) No Drug may purport or claim to procure or assist to procure, miscarriage in women.”
এই শিডিউলকে ১৯৯৬ সালে নতুনভাবে আবার সংশোধন করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত রোগগুলির নাম নীচে দেওয়া হল।
এইডস, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, অ্যাঞ্জাইনা পেকটরিস, আর্টারিওস্কেলরোসিস (রক্তনালীর শক্ত হওয়া), টাক পড়া, অন্ধত্ব, হাঁপানি, ক্যানসার বা সাধারণ আর, ছানি-পড়া, চুলের রঙ বদলানো ও নতুন চুল গজানো, গর্ভজাত শিশুর লিঙ্গ পরিবর্তন, জন্মগত বিকলাঙ্গতা, বধিরতা, ডায়াবেটিস, জরায়ুর রোগ সমূহ, মৃগী ও মানসিক রোগ সমূহ, এনসেফেলাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ), চামড়া সুন্দর করা, স্তনের আকৃতি ও গঠন বদলানো, গ্যাংগ্রিন, জিনগত সমস্যাবলী, গ্লুকোমা (চোখের চাপ), গলগন্ড, হার্নিয়া, উচ্চ ও কম রক্তচাপ, হাইড্রোসিল, উম্মত্ততা (ইনস্যানিটি), মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা, বুদ্ধি বাড়ানো, শিশু ও বয়স্কদের উচ্চতা বাড়ানো, যৌনঙ্গের আকৃতি, গঠন, দৈর্ঘের পরির্বতন আনা, যৌন কাজের সময় বাড়ানো, স্বাভাবিক দাঁতের ক্ষমতা বাড়ানো, দৃষ্টি শক্তি বাড়ানো, জনডিস/হেপাটাইটিস/ লিভারের সমস্যা, লিউকোমিয়া(রক্তের ক্যানসার), শ্বেতী, মানুষের যৌন আনন্দ ধরে রাখা ও বাড়ানো, জড়বুদ্ধি, মায়োকার্ডিয়াল ইনর্ফাকশন, স্থূলত্ব, পক্ষাঘাত (প্যারালিসিস), পারকিনসন্স, অর্শ ও ভগন্দর যৌবন আনা ও ধরে রাখা, অকাল বার্ধক্য আটকানো, অকাল চুল ধূসর হওয়া, রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ, যৌন অক্ষমতা, অকাল বীর্যপাত ও শুক্রণু বের হওয়া, স্পন্ডেলাইটিস, তোতলানো, পিত্তথলি, কিডনি ও মূত্রথলিতে পাথর হওয়া ও ভেরিকোজ ভেন (দলাপাকানো শিরা)
এই আইন ছাড়াও আরেকটি আইনে এই ধরনের রোগীদের রাষ্ট্র সুরক্ষা দিয়েছে। The Drugs and magic remedies (objectionable advertisement) Act-1945-এ এই সুরক্ষা কথা বলা হয়েছে। অনেকে আপত্তিকর বিজ্ঞাপন দিয়ে হাঁপানি, ডায়াবেটিস, ছানি পড়া, কিডনি বা পিত্তথলিতে পাথর ওষুধে সারানোর দাবি করেন। বা অনেকে ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করে, মন্ত্র দিয়ে, কবচ বা তাবিজ ব্যবহার করে রোগ সারানোর দাবি করে মানুষকে প্রতারিত করে। জনগণ এ ধরনের আইন থেকে যে নিজেদের আদৌ রক্ষা করতে পারেন না, এ ঘটনা আমাদের সমাজে জীবন্ত বাস্তবতা।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন