স্বল্প মাত্রায় অ্যাসপিরিন রুখে দিতে পারে স্ট্রোক
ডাঃ মধুসুদন ভৌমিক
2019-05-21 12:24:58
অ্যান্টিকোয়াগুলেশন
রক্তনালীর মধ্যে রক্ত তরল অবস্থায় থাকে। তরল থাকে বলেই রক্ত প্রবাহিত হতে পারে। রক্ত তঞ্চনের ক্রটির কারণেই সাধারণত রক্তনালীর দেওয়ালে রক্ত তঞ্চিত হয়ে আটকা পড়ে। এমনকি রক্তনালীর মধ্যে রক্ত তঞ্চিত হওয়ার কথা নয়। কারণ সুস্থ দেহে রক্ত তঞ্চনকারি ও তঞ্চনবিরোধী বিষয়গুলোর সাম্যতা রক্তকে তরল রাখে। অমসৃণ ধমনীগাত্রে রক্তকণিকা একবার আটকা পড়তে শুরু করলে স্রোতহারা নদীর মতো আরও রক্ত উপাদান সেখানে স্ত্তপীকৃত হয়ে প্রবাহের গতি রুদ্ধ করে দেয়। এমনাবস্থায় তঞ্চনবিরোধী ওষুধ তথা অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট প্রয়োগের চিন্তা খুবই সঙ্গত। যুগ যুগ ধরে অনেক ট্রায়ালও হয়েছে। হিপারিন দিয়ে শুরু করে অ্যাসপিরিন ও ওয়ারফেরিনের ট্রায়াল আজও চলছে। হিপারিনের ব্যবহার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা অনেকটাই ব্যবহার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। সে কারণে সুপার স্পেশালাইজড সেন্টার ছাড়া হিপারিনকে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাছাড়া যদিও হিপারিন তঞ্চিত রক্ত থেকে বারে বারে অ্যামবোলাস তৈরিতে বাধা দিয়ে অ্যামবোলিজমের সম্ভাবনা কমায় তবুও অ্যাসপিরিনের কার্যকারিতা অনেক বেশি ও নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রোক ট্রায়াল (আই.এস.টি) এবং চাইনিজ অ্যাকিউট স্ট্রোক ট্রায়াল (সি.এ.এস.টি) যৌথভাবে পরীক্ষা চালিয়ে অ্যাসপিরিনের ভূমিকা অনেক বেশি ফলপ্রসূ ও নিরাপদ বলে প্রমাণ করেছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কার্যকারিতার কথা মাথায় রেখে মাথা দু’-পাঁচ দিনের জন্য হিপারিনের প্রয়োগ সীমাবদ্ধ রেখে দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়ার জন্য আজকাল ওয়ারফেরিন ব্যবহৃত হচ্ছে।
অ্যান্টিপ্লেটলেট এজেন্টের ব্যবহার
অনেক অনুচক্রিকা বিরোধী ওষুধের মধ্যে একমাত্র অ্যাসপিরিনই স্ট্রোক রোগের চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও স্ট্রোক পরবর্তী জটিলতা এড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। আই.এস.টি ও সি.এ.এস.টি স্ট্রোক রোগে মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব কমানোর ক্ষেত্রে অ্যাসপিরিনের কার্যকারিতা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা ইস্কেমিক স্ট্রোক থেকে বেঁচে ফেরা রোগীদের দৈনিক ৭৫-৩২৫ এম.জি অ্যাসপিরিন খেয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেকেই শুধু ক্লোপিডোগ্রেলের ব্যবহারে সন্তুষ্ট না থেকে দৈনিক ৭৫ এম.জি ক্লোপিডোগ্রেলের সঙ্গে অ্যাসপিরিনের কম্বিনেশন ব্যবহার করছেন। এই ওষুধগুলো ধমনীর অমসৃণ দেওয়ালে অনুচক্রিকাদের ঘর বাঁধা রুখে দিতে পারে। অ্যাসপিরিন স্বল্প মাত্রায় শুধু ব্রেন স্ট্রোক নয় হার্ট স্ট্রোককেও দূরে রাখতে সাহায্য করে।
নিউরোপ্রোটেকশন
মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহের গতি কমতে শুরু করলেই ব্রেন কোষেদের ভোগান্তি শুরু হয়ে যায়। যে যেমন ধকল সহ্য করতে পারে সে ততক্ষণ বেঁচে থাকে। যদি ব্রেন কোষেদের গ্লুকোজ ও অক্সিজেন ঘাটতি সহ্য করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া যায় তবে মন্দ কি? অন্তত বেশিক্ষণ লড়াইয়ের ময়দানে টিকে থাকতে পারলে রোগীকে এক্সপার্টদের সামনে পেশ করার সুযোগ তো থাকবে। দুর্ভাগ্য, শুধু কৃত্রিমভাবে হাইপোথার্মিয়া সৃষ্টি করে, প্রচন্ড ঠান্ডায় কোষের নড়ন-চড়ন কমিয়ে তাদের সামান্য জ্বালানিতে দীর্ঘকাল টিকিয়ে চেষ্টা সবসময় সফল হয় না।
এছাড়াও যাদের রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি আছে, সার্টিন গ্রুপের লিপিড লোয়ারিং এজেন্ট দিয়ে চিকিৎসা করিয়েও স্ট্রোকের প্রোটেকশন দেওয়া হয়। ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার কমিয়ে স্ট্রোক রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। স্ট্রোকের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার পাশাপাশি নেজোগ্যাসট্রিক নলের মাধ্যমে বা স্যালাইন চালিয়ে কোষের হাইড্রেশন, খাদ্য পাঠিয়ে নিউট্রিশন ও অক্সিজেনেশনের মাধ্যমে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হাত থেকে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করতেই হয়।
যারা ইতিমধ্যে এই রোগের ছোবল খেয়ে কর্মক্ষমতা খুইয়েছেন তাদের জন্য ফিজিওথেরাপি, স্পিস থেরাপি ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রোগীকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে সাহায্য করে।
স্ট্রোক রোগীদের ভবিষ্যৎ কী
স্ট্রোক রোগীদের লাক স্টাডি করা বেশ কষ্টকর ব্যাপার। বহুযোগ আগে পৃথিবীতে ঘাঁটি গেড়ে বসা অসুখটি নিয়ে বিস্তর স্টাডি হয়েছে ও হচ্ছে। ক্লিয়ার কাট কোনো সমাধান উঠে আসেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘ডিসচার্জ ইন স্টেবল কন্ডিশন’ লিখে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য কয়েক ঘন্টার মধ্যে আবারও তাকে আনস্টেবল হয়ে
‘ইন’ করতে হতে পারে।
‘কাউন্টডাউন শুরু,
যা পারেন খাইয়ে দিন’ বলে যে রোগীকে খরচের খাতায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে, সেই রোগীও অনেক সময়ে সুস্থ হয়ে স্বমহিমায় ও সশরীরে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারছেন। একটা নয়, এমন নজির একাধিক আছে। আবার দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর কোমাতে থাকার পর ফিরে আসার স্ট্রোক রোগীর ভবিষ্যৎ আনপ্রেডিকটেবল।
তবে একথা প্রমাণিত যে কোন রোগী কত দ্রুত প্রকৃত চিকিৎসকের দরবারে হাজির হয়েছেন, কোনও রোগী কেমন ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন, কোন রোগীর কী ধরনের স্ট্রোক হয়েছে, কোন দশাতে চিকিৎসা শুরু হয়েছে, স্ট্রোক পরবর্তী ফলো আপ তিনি ঠিকমতো করিয়েছিলেন কি না এমন বহু বিষয়ের ওপর স্ট্রোক রোগীর বাঁচা-মরা ও অক্ষমতার মাত্রা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মোটামুটিভাবে বলা হয় মোট স্ট্রোকের প্রায় চল্লিশ ভাগই ইস্কেমিক ও পনেরো ভাগ হিমোরেজিক এবং পাঁচ ভাগ অজানা কারণে হয়ে থাকে। মোট হিমোরেজিক স্ট্রোকের ঠিকমতো চিকিৎসা হয়ে চল্লিশ ভাগেরও বেশি ক্ষেত্রে প্রাণ ফেরানো সম্ভব হয়। কথায় কথায় বলা হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত স্ট্রোকে বাঁচার চান্স ৫০-৫০। কোনোরকম চিকিৎসা না করালেও তিরিশ ভাগের বেশি রোগী প্রাণে বাঁচতে পারেন। না করালে বেঁচে ফেরা রোগীদের অক্ষমতার সংখ্যা ও মাত্রা চিকিৎসা করানো রোগীদের থেকে ষাট ভাগ বেশি। ক্লট রিমুভ্যাল, কোল্যাটারল নেটিং, ক্যারোটিড অ্যান্ড আর্টেরেক্টমি, স্টেন্টিং, বেলুন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির মতো মেজর ও জটিল অপারেশন করিয়ে প্রাণ ফেরানোর চেষ্টাতে সফলতার হার ক্রমশই বাড়ছে। ভবিষ্যতে প্রতিটি স্ট্রোক রোগীর প্রাণের গ্যারান্টি দেওয়া ও একশো ভাগ অক্ষমতা দূরীকরণ হয়তো সম্ভব হবে—স্ট্রোক রোগীদের নিয়ে গবেষণার ফলাফল এমন ভবিষ্যৎবাণীই শোনাচ্ছে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন