পারকিনসন্স কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে পারে হোমওিপ্যাথি
হ্যালো ডাক্তার ব্লগ টিম
2018-11-23 14:58:28
প্রখ্যাত ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী জেমস্ পার্কিনসন্স ‘শেকিং পালসি’ নাম দিয়ে ১৮১৭ সালে যে রোগটির নাম লিপিবদ্ধ করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর নামেই রোগটির নামকরণ করা হয়—‘পারকিনসন্স ডিজিজ’ বা কম্পনযুক্ত পক্ষাঘাত। নানান বিভ্রান্তিকর তথ্য, অর্ধসত্য ও কাল্পনিক গল্পের সমাহার নার্ভের এই রোগটি আপামর জনসাধারণের কছে আজও যেন সাক্ষাৎ যমদূত। কিন্তু আধুনিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যানে এই রোগে আক্রান্ত অনেক মানুষ যথাসময়ে ও সঠিক চিকিৎসায় দীর্ঘকাল ধরেই সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবনযাপন করছেন। পার্কিনসন্স ডিজিজ আসলে কী এটা আমাদের ব্রেনের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের এক জটিল রোগ। যাতে রোগীর চলাফেরার গতিতে অস্বাভাবিক মন্থরতা দেখা দেয়। টলমল চলনভঙ্গী, মাংসপেশির কাঠিন্য ও সঙ্গে থাকে কম্পনযুক্ত পক্ষাঘাতের ইতিহাস। মস্তিস্কের বেসাল গ্যাংলিয়ন আক্রান্ত হবার ফলে উদ্ভুত এই রোগ থাবা বসায় মূলত মধ্যবয়সে ও বার্ধক্যে। এতে রোগীল কাজ করার গতি ধীর হয়ে আসে, জড়তা ভাব দেখা দেয় এবং সঙ্গে থাকে এক ধরনের কাঁপুনি। হাঁটা-চলার অসুবিধা ও হাত-পা কাঁপা এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই রোগের অন্যান্য লক্ষণ রোগী মুখমন্ডলের প্রকাশভঙ্গী পরিবর্তনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, স্বতঃস্ফর্তভাবে কথাবার্তা বলতে অসুবিধা হয়, চোখের পাতা সময়ে সময়ে স্থির হয়ে থাকে। হাঁটা-চলার সময় হাত-পায়ের মুভমেন্ট সামঞ্জস্য থাকে না। কেউ কেউ ছোট ছোট পা ফেলে সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটেন। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথম এক হাত কাঁপতে শুরু করেও সেই দিকের পায়ে ছড়িয়ে যায়। কালক্রমে অন্যদিকের হাত-পায়ে কম্পনের লক্ষণ প্রকট হয়। অনেকের হাঁটতে-হাঁটতে সামনের দিকে ঝুঁকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। হাতে কোনো বস্তু ধরে রোগী স্থির রাখতে পারে না। জলের গ্লাস বা চায়ের কাপ ইত্যাদি হাতে ধরে তার পক্ষে সামলানো অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। ভাত-রুটি খাবার সময় মুখে খাবারের গ্রাস তুলতে গেলে তা মুখের এপাশ-ওপাশ চলে যায়। কোনো কোনো রোগী বারংবার শব্দ বা বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে, লেখার সময় হাত নড়ে গিয়ে অক্ষরগুলো এবড়ো-খেবড়ো হয়ে যায়। রোগের প্রকোপ বাড়লে ধীরে ধীরে চোয়াল, জিভ, চোখের পাতা ও মুখমন্ডল আক্রান্ত হয়ে কম্পিত হতে থাকে। রোগী নড়বড়ে ভঙ্গেীতে হাঁটে, এমনকী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতেও দেখা যায়। এক সময় রোগীর সর্বাঙ্গে কাঁপুনি দেখা দেয়। পার্কিনসন্স রোগের কারণ কম্পনযুক্ত পক্ষাঘাত একটি নিউরো-ডিজেনারেটিভ ডিজিজ। স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে নিউরোনের কাজগুলিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে ব্রেনের বায়োজেনিক অ্যামাইনস। যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ডোপামিন ও সেরেটোনিন। ব্রেন-স্টেমের ডোপামিনার্জিক কোষগুলির পিগমেন্ট নিউরোনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সাবস্ট্যানসিয়া নাইগ্রা, ফোর্থ ভেনট্রিকলের লোকাস সেরু লিয়াস ইত্যাদি অংশে ডোপামিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয় এবং মানুষ তখন পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়।এই রোগের সম্ভব্য কারণ হিসাব ডোপামিনের বৈকল্য বা ঘাটতিকে উল্লেখ করা হলেও, এর প্রকৃত কারণ আজও অজ্ঞাত ও অনাবিস্কৃত। এই রোগ কত ধরনের হয় ও কীভাবে হয়
- প্রাইমারি পার্কিনসনিজম বা প্যারালিসিস অ্যজিট্যনস-ডোপামিনের ঘাটতি ছাড়াও জেনেটিক ফ্যাক্টরকে এই রোগের কারণ হিসাবে সন্দেহ করা হয়।
- পোস্ট-এনসেফেলাইটিক পার্কিনসনিজম-এনসেফেলাইটিস রোগের জটিলতা থেকে এই রোগ হতে পারে।
- জুভেনাইল পার্কিনসসিজম-কপার মেটাবলিজমের সমস্যা থেকে কার্পাস স্ট্র্যাটামের ক্ষয়, ব্রেণের সামনের দিকের গ্যাংলিয়নগুলির কোষগুলোর ক্ষয় বা মস্তিস্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স শুকিয়ে যাওয়ার কারণে জুভেনাই ল পার্কিনসনিজম দেখা দেয়।
- টক্সিন পার্কিনসনিজম –ম্যাঙ্গানিজ, মার্কারি বা কার্বন মনো অক্সাইডের বিষক্রিয়া থেকে হতে পারে।
- সেকেন্ডারি পার্কিনসনিজম—মস্তিস্কের তীব্র আঘাত, বেসাল গ্যাংলিয়ার রক্ত জমাট বাঁধা, ব্রেনের সাবস্ট্যানসিয়া নাইগ্রাতে রক্তক্ষরণ, নিউরো-সিফিলিস ইত্যাদি কারণে সেকেন্ডারি পার্কিনসনিজম হতে পারে। ধমনী সরু হয়ে যাওয়া ও ব্রেন টিউমারকেও অনেকে কারণ হিসাব গণ্য করেন।
- সাধারণভাবে রোগীকে পুষ্টিকর খাদ্য, ফলমূল, দুধ-ছানা ইত্যাদি এবং বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, বায়োটিন, ফলিক অ্যাসিড, মিনারেলযুক্ত খাবার খেতে দিতে হবে।
- শরীরের নিউরো-ট্রান্সমিশন সিস্টেমকে চাঙ্গা রাখতে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ খাবার যেমন –ফুলকপি, টমেটো, বিন, খেজুর, আমলকি, রসুন, আঙুর ইত্যাদি রোগীকে খাওয়াতে হবে।
- ব্রেনের নার্ভের বিকাশ ঘটাতে এবং মস্তিস্কের গ্লুকোজ মেটাবলিজমের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে জিস্কো বাইলোবা, জিনসেং ও লিসিথিন আমাদের মেন্টালি অ্যালার্ট রাখতে সাহায্য করে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ জিনসেং মাদার টিংচার পার্কিনসন্স রোগে কার্যকরী। আর সোয়াবিন ও ডিমের কুসুম থেকে প্রচুর পরিমাণে লিসিথিন পাওয়া যায়।
- রোগীর মস্তিস্কের হায়ার কগনিটিভ ফাংশসগুলোকে বাড়াতে টোকোফেরল, টোকোট্রিয়েনল ও পাইরিডক্সাল ফসফেট সমৃদ্ধ ভিটামিন এবং ব্রেনে অক্সিজেন সরবরাহকারী সেলিনিয়াম ইত্যাদি মিনারেলের সাথে রোগীকে খাওয়ান যেতে পারে।
- রোগীকে দৈহিক পরিশ্রমে উৎসাহিত করতে হবে।
- প্রতিদিন ভোরে সূর্যোদয়ের আগে অন্তত ১ ঘন্টা করে রোগীকে একজন সঙ্গী নিয়ে হাঁটাচলা করতে হবে।
- রোগীকে সংযমী জীবনযাপন করতে হবে।
- রোগীকে আত্মীয় পরিজন, সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে হবে এবং মানসিক ভাবে ইতিবাচক ও প্রফুল্ল থাকতে হবে।
- রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য বা ঘুমের সমস্যা হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিতে হবে।
- নিউরো-সাইকিয়াট্রিতে বিশেষজ্ঞ হোমিওপ্যাথের তত্ত্বাবধানে সময়োচিত ও সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় পার্কিনসন্স রোগী দীর্ঘদিন যাবৎ সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবনযাপন করতে পারেন।