যোগ ও মুষ্টিযোগে ঠিক থাকবে প্রেসার
ডাঃ দিব্যসুন্দর দাস
2018-12-17 12:43:47
রক্ত হৃৎপিন্ড, শিরা, ধমনী প্রভৃতি আবেষ্টনীর ওপর যে চাপ সৃষ্টি করে তাকে ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ বলে। সাধারণত রক্তের চাপ একটি নির্দিষ্ট বয়সে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে। এই নির্দিষ্ট চাপ বৃদ্ধি পেলে তাকে বলা হয় হাই প্রেসার এবং কম হলে লো প্রেসার। সাধারণত রক্তচাপ দু’প্রকার। সিস্টোলিক প্রেসার এবং ডায়াস্টোলিক প্রেসার। যখন হৃৎপিন্ডের পাম্পের ফলে রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে তখন তার চাপ বেশি হয়। একে সিস্টোলিক প্রেসার বলে। আবার যখন রক্ত হৃৎপিন্ডে ফিরে আসে এবং হৃৎপিন্ড প্রসারিত হয় তখন চাপ কম থাকে, তাকে ডায়াস্টোলিক প্রেসার বলে। একজন পূর্ণবয়স্ক স্বাভাবিক সুস্থ লোকের রক্তচাপ হল সিস্টোলিক প্রেসার ১২০ এবং ডায়াস্টোলিক প্রেসার ৮০। বয়সানুসারে প্রেসার কমে এবং বাড়ে। যেকোনো বয়সী মহিলার রক্তচাপ পুরুষদের তুলনায় সাধারণত কম থাকে। রক্তচাপের কারণ নির্ণয় করার আগে আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, সিস্টোলিক রক্তচাপ প্রধানত হৃৎপিন্ডের ক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর হ্রাস-বৃদ্ধি সহজেই হতে পারে। কিন্তু ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ রক্তনালিকাগুলোর অবস্থার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর হ্রাস-বৃদ্ধি অত নয়। এইজন্য উচ্চ রক্তচাপ বা নিম্ন রক্তচাপের গুরুত্ব নির্ধারণে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ অধিকতর বিবেচ্য। তাই ডায়াস্টোলিক বা রিল্যাক্সিং প্রেসার বেড়ে যাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও চিন্তার কারণ হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণ
- বংশানুক্রমিক প্রবণতা। পিতা অথবা মাতার বংশে কারও উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকলে তাদের সন্তানদেরও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
- শারীরিক শ্রমের স্বল্পতা, অলস জীবনযাপন তৎসহ অতি ভোজন, ভাজাঝুজি ও তৈলাক্ত খাদ্য বেশি গ্রহণ।
- স্থূলতা, অতিরিক্ত মেদ বৃদ্ধি।
- মানসিক প্ররিশ্রম, ব্রেন ওয়ার্ক যারা বেশি করেন তাদের মধ্যেও এই রোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
- অতিরিক্ত উৎকন্ঠ, উদ্বেগ, দশ্চিন্তা ইত্যাদি কারণেও উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা দেখা যায়।
- এছাড়া দেহ গঠনের ওপর কিছুটা নির্ভর করে। ওজন খুব বেশি, উচ্চতা অনুযায়ী মেদ বেশি, মাঝে মাঝে ফ্যাকাশে রক্তশূন্য ব্যক্তিদেরও হঠাৎ বেশি রক্তচাপ দেখা যায়।
- কার্ডিয়াক বা করোনারি থ্রম্বোসিস রোগীর জীবন সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে।
- কখনো কখনো মস্তিষ্কে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। তার ফলে রোগীর সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হতে পারে। এমনকী পক্ষাঘাত বা প্যারালিসিস হবার সম্ভবনাও থাকে।
- উচ্চ রক্তচাপের ফলে ধমনী বা উপধমনীগুলোর ক্রিয়াগত সংকোচনে মূত্রগ্রন্থি আক্রান্ত হতে পারে।
- সামান্য কারণেই বিরক্ত হওয়া, ক্রোধের প্রবষতা বৃদ্ধি পাওয়া, অল্পতেই অকারণে রেগে যাওয়া সমস্যা বৃদ্ধি করে।
- ক্রমে স্মৃতিশক্তি ও মননশীলতায় দুর্বলতা দেখা যায়।
- নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়। দেরীতে ঘুম আসে, অকারণে বার বার ঘুম ভেঙে যায়।
- ঘন ঘন মাথা ধরে।
- কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস ও বহুমূত্রের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
- অতিরিক্ত লবণ, মদ্যপান, ধূমপান, চা, কফি নিষিদ্ধ। পাঁঠার মাংস, জর্দা বা ওই জাতীয় মশলা প্রভৃতি বর্জনীয়।
- অনিয়মিত আহার, অতিরিক্ত ভাজাভুজি, তেল ও চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ ক্ষতিকারক।
- অত্যধিক রাত্রি জাগরণ, চিন্তা, উৎকন্ঠ, রেগে যাওয়া, উদ্বিগ্ন থাকা বিপদ বাড়াতে পারে।
- সামনে ঝোঁকা, মাথা নীচু করা বা মাথা নীচুতে রাখবেন না।
- অতিরিক্ত জগিং, জাকিং, রানিং সামনে ঝুঁকে কোনো ব্যায়াম বা আসন, দমবন্ধ করে কোনো প্রাণায়াম না করাই বাঞ্ছনীয়।
- খাবার—হালকা স্যুপ, ছোট মাছের ঝোল।
- সময়মতো খাওয়া, লোভ সংবরণ করা।
- ফলাহার, সবজি বেশি খাওয়া।
- নির্দিষ্ট সময় ঘুমোতে যাওয়া, সকাল সকাল ওঠা।
- প্রাতঃভ্রমণ নিত্য ব্যায়াম ও যোগাসন।
- আনন্দে থাকা।
- ডিপ ব্রিদিং ফোল্ডিং হ্যান্ডস: দাঁড়িয়ে দু’হাত ধীরে ধীরে মাথার ওপর তোলা ও সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া। হাত ফিরিয়ে আনতে আনতে শ্বাস ছাড়া।
- যোগা ব্রিদিং: দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ধীরে ধীরে দেহের দু’পাশ থেকে দু’হাত ধীরে ধীরে মাথার ওপর তোলা ও সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া। হাত ফিরিয়ে আনতে আনতে শ্বাস ছাড়া।
- মার্চিং: এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লেফট-রাইট করা।
- ব্রজাসন: হাঁটু মুড়ে গোড়ালির ওপর বসাকে বজ্রাসন বলে। এতে হজমশক্তি ভালো হয়। বায়ুর প্রকোপ নষ্ট। বায়ুর চাপ ওপরে উছে হার্টে চাপ দিতে পারে না।
- প্রাণায়াম: এই প্রাণায়াম অনেক রকমের হয়ে থাকে। যথা শীতলী, সূর্যভেদ, ভ্রামরী ইত্যাদি। এই সকল প্রাণায়ামে দম বন্ধ করা বা কুম্ভের বিধি আছে। তাই সহজ প্রাণায়াম করাই শ্রেয়। শুধু শ্বাসের দিকে মন দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়া। ক্রমশ শ্বাস নেওয়া-ছাড়ার মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারলে ভালো হয়।
- ধ্যান বা মেডিটেশন: সুখাসনে বা বাবু হয়ে বা পদ্মাসনে বসে চোখ বুজে শ্বাসের চিন্তা করা। কোনো আলো বা জ্যোতির চিন্তা, কোনো দেব-দেবী বা প্রতিমূর্তি, শব্দ বা আনন্দদায়ক জিনিসের চিন্তা করতে পারলে মন স্থিত হয়্ চিন্তা নাশ ও শরীরে শিথিলতাপ্রপ্ত হয়।
- শবাসন: মৃত ব্যক্তির মতো শুয়ে থাকার নাম শবাসন। চিত হয়ে, উপুড় হয়ে বা পাশ ফিরে তির রকমের শবাসন করা যায়। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে উপুড় হয়ে শাসন না করাই ভালো। নিস্তেজভাবে শুয়ে থাকতে পারলে চিন্তামুক্ত হয়, টেনশন কমে।
- রিল্যাক্সেশন: শবাসনের সঙ্গে রিল্যাক্সেন করতে পারলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। শবাসনে শুয়ে মনে মনে ভাবতে হয় আমার হাত-পা, দেহ অবশ হয়ে গেছে। আমার আর শক্তি নেই। আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ব্যক্তির মতো হাত-পা শিথিল করে দিয়েছি। কপাল ও চোখ ছোট রুমাল বা টাওয়াল দিয়ে ঢেকে রাখলে সহজে রিল্যাক্স হওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের থেকে বেশি ভালো ফল পাওয়া যায় এভাবে। অনেকে একে ন্যাচারাল ট্রাঙ্কুইলিটি বলে অভিহিত করেন।