গর্ভাবস্থায় বেশি খাওয়া থেকে হজমের গোলমাল
ডাঃ সবুজ সেনগুপ্ত
2018-12-21 11:53:57
মহারানী ভিক্টোরিয়ার আমলে সব মাকে উৎসাহ দেওয়া হত ঠান্ডা খাবার খেতে। মানে যা খেলে শরীরে ঠান্ডা থাকবে। যেমন ফল, সবজি ইত্যাদি। তার মানে তখন ভাব হত যে, খাবারই শরীর গরম করে। যেমন মশলাদার খাবার, মাংস, ডিম, কফি ইত্যাদি খেতে বারণ করা হত। মাতৃত্বের শুরতেই যে গা গোলানো বা বমি ভাব হয়, সেটা ধরে নেওয়া হত গর্ভাবস্থায় সহবাস করার কারনে। পিপারমেন্ট চা খেতে বলা হত গা গোলানো কমানোর জন্য। কোষ্ঠবদ্ধতা, যেটা গর্ভাবস্থার একটা কষ্টকর অবস্থা, সেটার জন্য চায়ের কাপে এক চামচ মধু মিশিয়ে খেতে দেওয়া হত। সাবান আর কারাওয়ে তেল মিশিয়ে সাপসিটরি (পায়খানার দ্বারে দেবার জন্য) তৈরি করা হত। এমনকী বুক জ্বালা, পেটে গ্যাস হলেও ধরে নেওয়া হত তা আলসেমির জন্য (বাড়ির কাজ না করার জন্য)। এগুলো খোদ বিদেশীদের কথা বলছি সুতরাং আমাদের মায়েদের জন্য শুধু দুঃখ করে লাভ নেই। যত দিন বাড়তে থাকে বড় হতে থাকা জরায়ু, স্টমাক ও অন্যান্য অন্ত্রকে (ইনটেস্টাইন) ঠেলে ওপরে উঠিয়ে দেয়। প্রজেস্টেরন হরমোন, যেটা প্রেগন্যান্সিতে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় শরীরে থাকে তার একটা কাজই হচ্ছে শরীরের যত স্মুথ মাসল আছে তাদের ঢিলে করে দেওয়া। এটা দরকার জরায়ু যে সব মাসল দিয়ে তৈরি সেগুলো ঢিলে রাখার জন্য, মানে যাতে জরায়ুটা শান্ত হয়ে থাকে আর বাচ্চাকে সুন্দরভাবে বাড়তে দেয়। এখন এই কাজটা করতে গিয়ে খাদ্যনালীর মাসলগুলোও ঢিলে হয়ে যাওয়াতে খাবার খেলে খাদ্যনালীতে পৌঁছতে দেরি হয়, অনেকক্ষণ স্টমাকেই থেকে যায়। যার জন্য কোষ্ঠবদ্ধতাতে ভুগতে হয় কারণ হজম করা খাবার নীচের দিকে চালনা করার সেই ক্ষমতা তখন তো আর খাদ্যনালীর নেই, অনেকটাই কমে গেছে প্রজেস্টেরনের জন্য। এই কোষ্ঠবদ্ধতার থেকে রেহাই পাবার উপায় কী? পন্ডিতরা বলছেন, প্রচুর জল খেতে হবে, ফাইবারযুক্ত খাবার বা আটার রুটি খেতে হবে। এবং সঙ্গে অবশ্যই ফল ও সবজি। কোনো অসুবিধে না থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করলেও উপকার হবে। ওষুধের মধ্যে ইসবগুলের ভূষি রাত্রিবেলায় খাওয়া যেতে পারে। এটা যেহেতু অভ্যেস দাঁড়িয়ে যাওয়া ওষুধ নয় সুতরাং মাভৈ। নিশ্চিন্তে খাওয়া যেতে পারে। মাতৃত্বের শেষে আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। পেটে গ্যাস হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সেই মাসলগুলোর ঢিলে হয়ে যাওয়া। খাদ্যনালী বা ইসোফেগাস ও স্টমাকের মধ্যে যে ভালব থাকে সেটাও স্মুথ মাসলে তৈরি এবং প্রেগন্যান্সিতে ঢিলে হয়ে আধখোলা ছিপির মতো হয়ে থাকে। পাকস্থলি থেকে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ছলকে ছলকে ওপরে চলে আসার দারুন বুকজ্বালা করে। চিউংগাম চুষলে মুখের রসের আধিক্য হয় যা এই অ্যাসিডিটিকে কমাতে একটু সাহায্য করে। আমরা কিছু খাবার খেলে পাকস্থলিতে সেটা খুব বেশি হলে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা থাকে। কিন্তু প্রেগন্যান্সিতে তার থেকে অনেক বেশি সময় লাগে এবং খাদ্যনালীতেও পৌঁছতে দেরি হয়। যখন পৌঁছয় তখন প্রথমে পাচকরসগুলো চেষ্টা করে হজমে সাহায্য করতে (ক্ষুদ্রান্ত্রে), তারপর যখন বৃহদন্ত্রে পৌঁছয় সেখানে ব্যাক্টেরিয়ারা বসে থাকে হজম না হওয়া খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। এর ফলশ্রুতি হচ্ছে ফার্মেন্টেশন হয়ে পেটে গ্যাস হওয়া। কিছু মায়ের আবার ল্যাকটোস ইনটলারেন্স থাকে। তাদের দুধ বা দুধের তৈরি খাবারে গ্যাস হয়ে যায়। অতিরিক্ত খেয়ে ফেলা মোটেই উচিত নয়। সব সময় উচিত বারে বারে কম কম করে খাওয়া কিন্তু অনেক সময়েই লোভ বা আরো একটু খেয়ে নেবার ইচ্ছে হতে পারে। এই বেশি বেশি খেয়ে নেয়ার থেকেই হতে পারে অনেক ঝঞ্ঝাট। পেটের গোলমাল হতে পারে। কারণ অত খাবার হজম করার ক্ষমতা তো তখন থাকে না। সুতরাং পেট খারাপের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে দৌঁড়তে হয়। ডেকে নিয়ে আসা এই অশান্তির জন্য অনর্থক ওষুধ খেতে হতে পারে। যাইহোক, পেটের হজম সংক্রান্ত বেশির ভাগ সমস্যাই খুব সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছয় না যদি না অত্যধিক ডায়েরিয়া হয়ে শরীর থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে গিয়ে ডিহাইড্রেশন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে হাসপাতালের শরণাপন্ন হতেই হবে কারণ বেরিয়ে যাওয়া জলকে আবার শরীরে ফিরিয়ে দেবার জন্য স্যালাইন দেওয়া জরুরি। ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন