রং মেশানো খাবার আর কত বিষ খাবেন??
প্রফেসর কৃষ্ণজ্যোতি গোস্বামী
2019-01-24 16:44:25
সপ্তাহ ভর বাড়ির একঘেয়ে খাবার খেয়ে জিভে চড়া।ছুটির দিন তাই পাড়ার দোকান থেকে গরম গরম বিরিয়ানি।মনমাতানো গন্ধ. প্রাণকাড়া স্বাদ।আর দেখতেও কি অপূর্ব! বাড়িসুদ্ধ সকলে খুশ।
রসনা নাহয় তৃপ্ত হল।কিন্তু স্বাস্থ্য।
সেটা খতিয়ে ভাবলে খুশির আমেজ উধাও হতে পারে।কারণ বহুক্ষেত্রে বিরিয়ানির রং ধরাচ্ছে মেটানিলইয়েলোনামের এক রাসায়নিক, যা কিনা মানবদেহের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।আজকাল বিভিন্ন ধরনের চকোলেট ও বিস্কুটেও ক্ষতিকরক রং মেশানো হচ্ছে।চপ-কাটালেটে দেওয়া বিস্কুটের গুঁড়োতেও তা-ই।
বাজারে হরেক ফল-সবজিতেও নানা রকম নিষিদ্ধ রাসায়নিক মিশেল।সেগুলো পেটে গেলে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
পুরনো ডাল চকচকে করতে একধরনের রাসায়নিক দিয়ে পালিশ করা হচ্ছে।আপেল, কুলের মতো ফল যাতে পুরনো হলেও তাজা দেখায়, তাই ধোয়া হচ্ছে পোড়া ডিজেল।বেগুন, করলা ইত্যাদি এমন সব কেমিক্যালে ভিজিয়ে রাখা হচ্ছে, যা শরীরে ঢোকা মানেই বিপদ।
বর্তমানে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার লক্ষে প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তার অন্যতম ভেজাল।খাদ্য থেকে শুরু করে প্রসাধনী, ওষুধ, রং, সবজি সবকিছুতেই ভেজালের রমরমা।রাসায়নিক ভেজালের কথাই যদি শুধু বলি, তবে নিয়মিত ভাবে আমাদের শরীরে বিষ ঢুকে যাচ্ছে।ফলে শুধু অসুখ-বিসুখই বাড়ছেনা, সামগ্রিকভাবে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আঘাত হানছে।
স্বাধীনতার আগে পন্ডিত নেহেরু বলেছিলেন, ভেজালদারদের ফাঁসি দেওয়া হবে।
এখন মানুষের হাতে সময় খুব কম।সবাই ব্যস্ত।ফাস্টফুড বা দোকানে তৈরি খাবারের প্রতি সবার ঝোঁক এখন অনেক বেশি।তাই খাবার কে মনোগ্রাহী করে তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।ফলস্বরূপ খাবারে মেশানো হচ্ছে নানা রকমের রং।ক্রেতাদের মধ্যে ইদানিং রঙিন খাবারের প্রতি আকর্ষণও বেড়ে গেছে।
খাবারের রং মেশানো শুরু হয়েছিল মিশরীয় সভ্যতার সময় থেকে।তবে সে সময় সাধারণত প্রাকৃতিক রং ই ব্যবহার করা হত।১৮৫৬ সালে ডাঃপার্কিন প্রথম কৃত্রিমরং (নৌভাইন) আবিষ্কার করেন।এর পরই ক্রমশ সারা পৃথিবীতে ব্যাপক হারে রং-এর ব্যবহার শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল ক্রেতাদের মন জয় করা।কৃত্রিমভাবে এই রং তৈরি করা যেমন সহজ দামেও অনেক কম।এইসব কৃত্রিম রঙে যেসব রাসায়নিক পদার্থ থাকে, তা মোটেই শরীরের পক্ষে হিতকর নয়।আর এই রঙিন খাবার খেয়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
খাবারের জন্য সরকার কতকগুলো রং- কে স্বীকৃতি দিয়েছে।তা আইন হিসাবে এসেছে ১৯৫৪সালে ‘প্রিভেনশন অফ ফুড অ্যাডালটারেশন অ্যাক্ট’ তৈরি হওয়ার পর।১৯৫৫ সালে আইনটি কার্যকর হয়েছে।এই স্বীকৃত রং গুলোকে বলা হয়‘ফুড ডাই’ বা খাদ্য রং’।
বর্তমানে আমাদের দেশে মোট এগারোটি রং কে খাবারে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।এগুলো হল লাল রং আনতে পনকিউফোরআর, কারমোসিন, এরিথ্রোসিন, আমারস্থ ও ফাস্টরেডই ব্যবহার করা যেতে পারে।হলুদের জন্য স্বীকৃত রং হল টারট্রাজিন কিংবা সান সেটইয়োলো।নীলের জন্য ইন্ডিগো কারমাইন ও ব্রিলিয়ান্ট ব্লু এবং সবুজের জন্য ফাস্টগ্রিন ওউলগ্রিন ব্যবহার করা যেতে পারে।আইসক্রিম, বিস্কুট, পেস্ট্রি, কোল্ডড্রিঙ্কস ইত্যাদিতে রং –এর ব্যবহার প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ একশো মিলিগ্রাম এবং ফ্রুপ সিরাপ, স্কোয়াশ, জ্যাম, জেলির মতো খাবারে প্রতি কেজিতে দু’শোমিলিগ্রাম রং দেওয়া যেতে পারে।এই পরিমাণের বেশি হলে কিন্তু বিষ ক্রিয়া হওয়ার সম্ভবনা যথেষ্ট।
অনেক দোকানে বেশি কিছু মিষ্টি রঙিন হয়।এসব দোকানে মিহিদানা, রোঁদে, জিলিপি, অমৃতি প্রায়শই টকটকে হলুদ।এই ধরনের খাবারে থাকে ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ কেশরী বা মেটানিলইয়েলো।কেশরী দেওয়া খাবার থেকে ব্রেস্টটিউমার,কিডনি বা ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ হতে পারে।এমনকী শুক্রাণু তৈরিতেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।এই নিষিদ্ধ রং টি বিরিয়ানি বা পোলাওতেও মেশানোর রীতি আছে।আমাদের খাদ্যাভ্যাসে এসবের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে।
আপনার খাবারে কেশরী বা মেটানিলইয়েলো আছে কিনা জানতে খাবারের টুকরোটি একটি পাত্রে রেখে কয়েক ফোঁটা বাথরুম পরিষ্কার করার অ্যাসিড মেশান।দেখবেন মিশ্রণটি গোলাপি হয়ে যাবে অর্থাৎ জানবেন কেশরী রং খাদ্যে মেশানো আছে।
এইরকম নিষিদ্ধ রংগুলোর মধ্যে কোঙ্গোডে ও রোডমিনবি লাল রঙের জন্য, নীলের জন্য ব্লভিআরএস; মেটানিণইয়েলো, লেডক্রোমেট, সুদামথ্রি হলুদ রং- এর জন্য ও সবুজের জন্য ম্যালাকাইটগ্রিন ও কপারসালফেট; অরেঞ্জ টু কমলা রং-এর জন্য আর কার্বন ব্ল্যাক কালোরং-এর জন্য।বহুল প্রচলিত এই রং গুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
খাবারের সুগন্ধ আনার জন্য, পচন রোধের জন্য বা জীবাণু বৃদ্ধি রোধ করার জন্য খাদ্যে নানারকম রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়।এই সব রাসায়নিক ও আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।
পচন রোধে কাঁচা মাংসে লেডনাইট্রেট ব্যবহার করা হয়, যা থেকে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা হয়।পাকস্থলির ক্যানসার ও কিডনির সমস্যাও হতে পারে।
জ্যাম, জেলি, মাখন ও চিজ ইত্যাদি জীবাণু বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য বেঞ্জোয়েট ব্যবহার করা হয়, যা থেকে মাথা ও বুকে ব্যথা এবং ঘাড়ের যন্ত্রণা হতে পারে।
কাটা ফল ও সবজি কে দীর্ঘসময় তাজা দেখানোর জন্য লেডসালফাইড ব্যবহার করা হয়, তা খেলে অ্যালার্জি ও কিডনির সমস্যা হতে পারে।
আইসক্রিম, ঠান্ডাপানীয়, স্কোয়াশ, চকোলেট ইত্যাদি মিষ্টি জাতীয় খাবারে স্যাকারিন ও অ্যাসপারটেম ব্যবহার করা হয়।স্যাকারিন দাঁতের পক্ষে ক্ষতিকারক।আর অ্যাপারটেম-এর জন্য ক্র্যাম্প হতেপা রে।
শহর ও শহরতলি থেকে প্রতিদিন যে টন টন ছানা বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে মিষ্টি তৈরির জন্য, বহুক্ষেত্রে এগুলো সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়ে কাটানো দুধ থেকে তৈরি।এতে ছানা বেশি বেশি হয় ঠিক থাকে।ফলে মিষ্টির মাধ্যমে সালফিউরিক অ্যাসিড, সীসা, নিকেল ও ক্রোমিয়াম জাতীয় বিষ্কাক্ত ধাতু চলে যাচ্ছে আমাদের পেটে।
সরষের তেলে শিয়াল কাঁটার তেল, রেড়িরতেল, ধুতুরার তেল ভেজাল দেওয়া হয়।
মুড়ি ধব ধবে সাদা এবং আকারেবড় করার জন্য অনেক সময়ই ইউরিয়া মেশানো হয়।এমনিতে আমাদের শরীরের বর্জ্য পদার্থ ইউরিয়া প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়।কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া শরীরে গেলে নানা প্রকার অসুবিধে তৈরি হতে পারে।এমনকী বন্ধ্যাত্ব, কিডনির সমস্যাওক্যানসারও হতে পারে।
এবারে বলি চা-এর কথা।একটা ভেজা সাদা কাগজের ওপর বাজার থেকে আনা চা- পাতা ছড়িয়ে দিন।কিছুক্ষণের মধ্যেই কাগজের ওপর গোলাপি বা লাল রং-এর ছোপ ফুটে উঠলে বুঝবেন চা-এ ভেজাল আছে।চা-এঅনেক সময় কোলটারডাই মেশানো হয়।এগুলোও শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক।
ট্রেনে-বাসে যে আমলকির প্যাকেট বিক্রি হয়, তাতে আমলকির রং দেখা যায় কালো কুচকুচে।আসলে একটা ডুমুর কে চার ফালি করে কেটে বীট লবণ ও সাইট্রিক অ্যাসিডে ভিজিয়ে রেখে, পরে শুকিয়ে আমলকি বলে বিক্রি করা হয়।সুতরাং আমলকির নামে আমরা ডুমুর খাই।
বাজারের লাল টকটকে চেরি।অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচা করমচা চিনির রসে ও রোচামিন-বি-এর দ্রবণে মিশিয়ে লাল চেরি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।ফলে, রোডামিন-বি থাকায় যা ক্ষতি হবার তাই হচ্ছে।
শুকনো লঙ্কা, রাঙাআলু, জেলি, সস, জ্যাম, লজেন্স, চকোলেটে লাল রং আনতে নিষিদ্ধ কঙ্গোরেড ব্যবহার করা হয়।কঙ্গোরেড-এর জন্য মস্তিষ্ক, মূত্রাশয় ও চোখে ক্ষত তৈরি হতে পারে।
জেলি,সস বা জ্যামে ব্যবহৃত লাল রং কঙ্গোবেড কিনা তা বুঝতে সামান্য সস বা জেলি জলে গুলে তার মধ্যে বাথরুম পরিষ্কার করার মিউরেটিক অ্যাসিড যোগ করূন।কঙ্গোরেড থাকলে রং লাল থেকে নীল হয়ে যাবে।মাছের কানকোতেও এই নিষিদ্ধ রং-এর ব্যবহারের রীতি আছে।দেখে মনে হয় যেন রক্ত।রক্ত হলে বারবার জলে দিয়ে ধুয়ে চলে যায়।কিন্তু কঙ্গো রেড হলে ধোয়ার পরও চলে যাওয়ার সম্ভবনা নেই।
সিরাপ, জেলি, সস, জ্যাম, করমচা, আইসক্রিম, লজেন্স, শুকনো লঙ্কা বা রাঙা আলুতে লাল রং আনতে আরেকটি নিষিদ্ধ রং রোডামিন-বি-এর ব্যবহার চালু আছে।রোডামিন-বি-এর কারণে মূত্রাশয়, প্লীহা ও যকৃতে ক্ষত তৈরি হতে পারে।এমনকী ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চকচকে বেগুণে পোড়া মোবিল মাখিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়।সবুজ শাক সবজি বা সবুজ সবজি পটল, ঢেঁড়শ, উচ্ছে, বিন ইত্যাদি সবুজ করতে ক্ষতিকারক ম্যালাকাইটগ্রীন ব্যবহার করা হয়।যা শুক্রাশয়, মূত্রাশয়, প্লীহা, কিডনি, যকৃতে বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
এখন প্রশ্ন হল, এইধরনের সবজি চিনবেন কী করে?সবজির বোঁটার দিকটা, ভালো করে লক্ষ করুন।এমনিতে বোঁটা হওয়া উচিত ধূসর বর্ণের।কিন্তু রঙে ডোবানো সবজির বোঁটাটাও হবে রঙিন।আসুন, ভেজাল প্রতিরোধে আমরা সবাই এগিয়ে আসি এবং সুস্থ থাকি।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন