ধর্ষণ এখন সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত
হ্যালো ডাক্তার ব্লগ টিম
2019-01-25 15:09:10
ইদানিং আমাদের সমাজ জীবনে ‘ধর্ষণ ও নারী লাঞ্চ্ছনা’ এক সংক্রামক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে শহর, শহরতলী এমনকী গ্রাম-গঞ্জেও ধর্ষণ ও যৌন লাঞ্চ্ছনার ঘটনা ঘটেই চলেছে। সমাজের সর্বত্র, সর্বস্তরের মানুষ এই ধরনের পৈশাচিক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু করে বাসের খালাসি, পাড়ার মস্তান থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তি, হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বড়লোকের দুর্বিনীত সন্তান।–যৌন নির্যতনের বা ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। স্কুলের মধ্যে, বাসের মধ্যে, রাস্তাঘাটে-সর্বত্র ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় দলবদ্ধভাবে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কখনো কখনো এই জঘন্য অপরাধের পর নির্মমভাবে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে মনোবিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য অনেক কারণের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কিন্তু ঘটনা প্রবাহ কোনো বিরতি নেই।
ধর্ষণ আগেও ছিল
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ষণ আগেও ছিল। পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েরা সম্পত্তি----পুরুষের ভোগের সামগ্রী। দেশ জয়ের পর বিজয়ী রাজা পরাজিত মহিলাদের সম্ভোগের অধিকারী ছিলেন। সৈন্য সামন্তরাও নারী সম্ভোগে লিপ্ত হত। নারী শরীর দখল করে যৌনলালসা মেটানো এক চিরন্তন প্রথা। নারীর শরীর আছে, আর তার জন্ম পুরুষের যৌনতাড়না মেটানোর জন্য—এই ধারণাই কার্যত চলে আসছে এখনও।
নারীকে ‘মা’ বা দেবী বলে পূজা করা হলেও পুরুষের মনে সুপ্ত কামনা বাসনা চিরদিনই থেকে গেছে। সুযোগসুবিধা মতো নারীকে অবলা পেয়ে পুরুষ শক্তি ধর্ষণের উদ্যদ হয়।
পুরুষের সঙ্গে নারীর অবাধ যৌনমিলনকে নিয়ন্ত্রণ ও সমাজ শাসনের জন্যেই নানারকম সামাজিক বিধান, বিবাহ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে। অবাধ যৌনাচার রুখতে আইন হয়েছে। নারীর সম্মতি ছাড়া যৌনমিলন ‘ধর্ষণ’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। যা আইনত অপরাধ। বিভিন্ন দেশে ধর্ষনের শাস্তিও ভিন্ন।
কেন ধর্ষণ
ধর্ষণের অনেক সম্ভাব্য কারণ আছে। মনোবিজ্ঞান ও অপরাথ বিজ্ঞানে ধর্ষণকে যৌন অপরাধ বলা হলেও একে ঠিক বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ বলে মনে করা হয় না। যারা ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত, তারা অপরাধী। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় চেনাজানার মর্ধেই ধর্ষণের ঘটনা বেশি হয়। অর্থাৎ ধর্ষক ও ধর্ষিতা পূর্ব পরিচিত। যৌন তাড়নার বশে যেমন যৌনমিলন ঘটে থাকে, তেমনি অনেক সময় ধর্ষক ‘ইঙ্গিত’ বুঝতেও ভুল করে তাকে। যে ধর্ষণ করে বা ধর্ষণের জন্য অভিযৃক্ত হয় সে মনে করে ধর্ষিতার যৌন মিলনে সম্মতি আছে। কিন্তু পরে ধর্ষিতা ধর্ষকের বিরুদ্ধে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলনের অভিযোগ আনে।
অনেক সময় ধর্ষিতা নারীর প্রাথমিক সম্মতি থাকলেও পরে সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলন ঘটেছে বলে অভিযোগ করে। ধর্ষনের সংজ্ঞা ও কখন যৌনমিলনকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে তা নিয়ে আইনের বিশদ ব্যাখ্যা আছে। বিবাহিতা মহিলা ছাড়া আঠারো বছর বয়সের কম কোনো মহিলা যৌনমিলানে রাজি হলেও সেই যৌনমিলনকে ধর্ষণ বলে মনে করা হয়। তেমনি ভুল বুঝিয়ে বা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অথবা মাদক দ্রব্য বা ওষুধের নেশা করিয়ে কোনো মহিলা যদি যৌনমিলনে সম্মতি দেয়, তাহলেও সেই ঘটনাকে ‘ধর্ষণ’ বলে মনে করা হয় এবং সেটা আইনত দন্ডনীয়।
অনকে সময় যে ধর্ষণ করে সে কোনো রাগ বা আক্রোশের শিকার হয়ে যৌন নিপীড়ন বা লাঞ্চ্ছনার মধ্যে দিয়ে কোনো মহিলাকে শাস্তি দিতে চায়। যৌন নিপীড়স ও যৌনমিলনের মাধ্যমে যৌনসঙ্গীকে যন্ত্রণা দিয়ে বা পীড়ন করে অনেক তৃপ্তি অনুভব করে। একে ‘ধর্ষকাম’ বা ‘স্যাডিজম’ বলা হয়।
কেন ধর্ষণ সংক্রামক ব্যাধি হয়ে উঠেছে
ধর্ষণের ঘটনা ও ঘটনার অভিনবত্ব অনেক বেড়ে গেছে। তার সম্ভাব্য কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল—
- এখনকার ছোট পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কাজ করছেন। মেয়েরা আর ঘরে বসে নেই। তারা সপ্রতিষ্ঠিত ও কাজের অন্বেষণে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। পথে ঘাটে অনেক লম্পট বা অসভ্য মানুষ সুযোগ বুঝে মহিলাদের সঙ্গে অশালীণ আচরণ, যৌন নির্যাতন করে থাকে। অবশ্য দেশের সরকার তথা পুলিশের আইনশৃঙ্খলা দেখার কথা। যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো অপরাধের দ্রুত বিচার ও কঠিন শাস্তির প্রয়োজন।
- কলেজের ছাত্রছাত্রী বা কর্মরত মেয়েরা হোটলে বা বারে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া বা খাওয়া-দাওয়া-মজলিসে অনকে সময় মেতে ওঠা। পশ্চিমী কালচার আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও রপ্ত করেছে, তার প্রতিফলিত তাদের কথাবার্তা, সাজপোশাকে প্রতিফলিত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ইত্যাদি খোলামেলা নারী শরীর দেখানো হয়। এ সবের মধ্যে দিয়ে অনেক মানুষ নিজেদের সংযম ও সততা বা সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ হারিয়ে অবাধ যৌনচারে মেতে উঠতে চায় ও ধর্ষণ বা নারী নিগ্রহরে মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে।
- মদ, ক্যানাবিশ (গাঁজা, ভাঙ, চরস) প্রভৃতির নেশা কম বয়সেরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেক বেড়ে গেছে। নেহতই আনন্দের জন্য, ফুর্তি করার তাগিদে অনেক যুবক-যুবতী নেশা করে ও তার ফলে তাদের যৌন উত্তেজনা ইত্যাদি বেড়ে যায়।নেশা করার জন্য আত্মসংযমের ক্ষমতা কমে এবং সামাজিকে উত্তেজনার বশে তারা অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়। হিতাহিত জ্ঞানর্শন্য হয়ে তারা ‘ধর্ষণের’ মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
- মেয়েদের উপযুক্ত সম্মান করা, মান্য করা ইত্যাদি ছোট থেকে পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে দিয়েই অর্জিত হয়। ছোট বয়স থেকে বাবা-মা বা অভিভাবকদের যদি মেয়েদের সম্বন্ধে হীন মন্তব্য বা কুরুচিকর কথাবার্তা বলতে দেখে, তবে ছোট ছেলেমেয়েরা কী শিখবে? অনেক তথাকথিত বড় মাপের মানুষদেরও মহিলাদের সম্বন্ধে অসম্মানজনক মন্তব্য করতে দেখা যায়। শারীরিক নির্যাতন এমনকী ধর্ষণের মাধ্যমেও মহিলাদের ‘শাস্তি’ দেওয়া যেতে পারে—এইরকম ভাবনাচিন্তা অনেকেরই থাকে। এই ধারণা বা ভাবনা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে বলে আশষ্কা করা হয়।
- ‘রাজনৈতিক’ ও ‘মাংসপেশির’ ক্ষমতা লিপ্সা একদল মানুষকে উম্মত্ত, বর্বরে পরিণত করে। তারা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’করে। যেকোনো মেয়েকেই দখল করা বা ভোগ করা যেন তাদের ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা বলে মনে করা হয়। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান বা মনঃস্তত্ত্বের কথা যতই বলা হোক না কেন, শাস্তির ভয় কিন্তু সাধারণত যেকোনো মানুষকেই অসমাজিক বা অপরাধমূলক কাজকর্ম থেকে বিরত করে। ক্ষমতাশালী দুবৃর্ত্ত বা সমাজবিরোধীরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে তারা আইন ও আইনরক্ষকদের ভয় পায় না। একটি সমাজবিরোধী বা ধর্ষককে পুলিশ জেরা করবা সময় ‘জামাই আদর’ করবে, আর নিরাপরাধ অবলা নিষ্পাপ কিশোরী যে লাঞ্চ্ছিতা বা ধর্ষিতা হচ্ছে তার কোনো মানব অধিকার থাকবে না? অপরাধীরা শাস্তি বা লজ্জার ভয় পায় না। তাদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে—অর্থ ও প্রতিপত্তির জোরে তারা অনেক সময় শাস্তির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। ধর্ষক ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ার এসবও অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
-
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন