হাঁটুর বাতে কীভাবে রেহাই মিলবে
ডাঃ সুনীল ঠাকুর (বিশিষ্ট অস্থি বিশেষজ্ঞ)
2019-01-28 10:22:35
হাঁটুর ব্যথা মধ্যবয়স্ক মানুষের কাছে এক বিরাট সমস্যা। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষই হাঁটুর ব্যথার আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ৪৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ২৬৪৪১ জন পুরুষ এবং মহিলার প্রায় ১৬,৬৮৭ জন; ৭০ থেকে ৮০ বছরের পুরষরা ২২০০০ ও মহিলারা ১৯৬০০ জন এবং আশির ঊর্ধ্বে পুরুষরা ১০,২৫০ এবং মহিলারা ১৪২৯৬ জন হাঁটুর ব্যথায় ভোগেন।
হাঁটুর বাত কী
হাড়ের উপাদান হ্রাস, দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, বয়সের কারণে হাঁটুতে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে সেটিকে বাত হিসাবে ধরা যেতে পারে। হাঁটুর মধ্যে প্রদাহের অপেক্ষা অবক্ষয় বেশি হয়। অস্টিও মনে হাড় এবং আর্থ্রোসিস বলতে বোঝায় অবক্ষয়জনিত বাত। সন্ধির মধ্যে অবক্ষয় বা ডিজেনারেশনের ফলে বাতের সঞ্চার ঘটে। কারো কারো সন্ধিতে অবক্ষয় এতই প্রবল হয় যে হাঁটুর হাড়ে এবং অন্যান্য নরম ও শক্ত তন্ত্ততে বিশেষ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়।
হাঁটুর বাত ধরে কেন
হাঁটুর বাত ধরার নানান কারণ আছে। যেমন অস্টিও আর্থ্রোসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, গেঁটে বাত, সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমোটাসাস ইত্যাদি। এছাড়া হাঁটুতে বিকৃতি, অতিরিক্ত চাপ, আঘাত, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হাঁটুর ব্যবহার বা কাজ—এসব বেশি বয়সে বাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বংশগত ও জেনেটিক কারণেও হাঁটুতে বাত হয় বলে অনেকে মনে করেন। হাড়ের উপাদান হ্রাস ও ঘনত্ব কমে যাওয়ায় হাঁটুতে বাতের ব্যথা দেখা যায়।
যারা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, বিশেষ করে কনডাক্টর তাদের কিন্তু হাঁটুতে বাত বেশি ধরে। বর্তমানে যেসব অত্যাধুনিক মলগুলিতে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা আট-দশ ঘন্টা টানা ডিউটি করছে তাদের মধ্যেও হাঁটু ব্যথার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আসলে ওই ধরনের কাজকর্মে হাঁটুতে দীর্ঘক্ষণ চাপ পড়ায় হাঁটুর কার্টিলেজের রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। ফলে হাড়ের ওই অংশের স্বাভাবিক উপাদানের পরিমাণ কমে এবং বাতের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। যেসব বহুতল বাড়িতে লিফট নেই, সেইসব বাড়িতে বারবার ওঠানামার কারণে হাঁটুতে প্রচন্ড চাপ পড়ে অবক্ষয় ধরে। এই কারণে হাঁটুতে যাতে চাপ কম পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার।
সব সময় লক্ষ রাখতে হবে হাঁটুর সন্ধিতে যেন ঘর্ষণ না হয়। দেহের ওজন বাড়লে হাঁটুর ওপর চাপ বাড়ে। ফলে হাঁটুতে বাত ধরে। এই কারণে খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম-আসন করতে বলা হয়। কিন্তু কখনো হাঁটুতে জোরে মালিশ করবেন না।
হাঁটুর অবক্ষয় কাদের হতে পারে
- বড় আঘাত অথবা বারবার সামান্য আঘাত হাঁটুতে বাতের সৃষ্টি করে।
- যারা একনাগাড়ে বেশিক্ষণ ধরে হাঁটু মুড়ে অথবা ভেঙে কোনো কাজ করেন তাদের হাঁটুতে বাত বেশি হয়।
- যারা বারবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন তাদের হাঁটুতে অস্টিও আর্থ্রাইটিস বেশি দেখা যায়। হাঁটুর কার্টিলেজ ও নরম তন্ত্ততে চাপ পড়ে বাত ধরে।
- দেহের ওজন বৃদ্ধি বাতের সৃষ্টি করে। বাতের সমস্যা বাড়ায়।
- দেহে অন্য ধরনের বাত যেমন গাউট, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাংকাইলোজিং স্পন্ডেলাইটিসের জন্যও হাঁটুর বাত ধরে।
হাঁটুর বাতের সঞ্চার হচ্ছে বোঝার উপায়
- হাঁটুতে অল্প থেকে তীব্র ব্যথা শুরু হবে।
- সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধা হবে।
- হাঁটতে চলতে ব্যথা হবে এবং ব্যবস্থা না নিলে কষ্ট বেড়ে যাবে।
- হাঁটুর অভ্যন্তরে হাড়ের কুচি বা দানা জমার ফলে হাঁটু মুড়লে কড়কড় করবে।
- হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বা পায়খানায় বসতে বেশ অসুবিধা বোধ হবে।
- বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে রান্না বা অন্য কোনো কাজকর্ম করতে, বাসে-ট্রামে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হবে।
- হাঁটু অনেকসময় বেঁকে যেতে শুরু করে।
কী কী পরীক্ষা প্রয়োজন
হাঁটুর এক্স-রে করতে হবে। প্রয়োজন হলে এম.আর.আই অথবা সিটি স্ক্যান করতে হতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ
খাদ্যাভ্যাস ঠিক করতে হবে। ওজন যাতে না বাড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। হাঁটুতে সহ্যের অতিরিক্ত চাপ দেওয়া যাবে না। একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বা কোনো কাজ করা যাবে না। রান্না করার সময় পাশে একটা টুল রাখতে হবে বসার জন্য। হাঁটুমুড়ে বেশিক্ষণ বসা যাবে না। পায়খানা-বাথরুমের জন্য কমোড ব্যবহার করতে হবে। পুজো না নামাজ পড়ার জন্য মেঝেতে বসা যাবে না হাঁটু মুড়ে। রোজ নিয়ম করে হাঁটুর ব্যায়াম করতে হবে। এতে হাঁটুর চারপাশের মাংসপেশি, লিগামেন্ট ও অন্যান্য অংশে কর্মক্ষম ও সবল থাকবে এবং বাতের প্রকোপ কমবে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা বন্ধ করতে হবে। সাঁতার কাটতে পারলে হাঁটুর ব্যথা কমবে ও শরীর সুস্থ থাকবে। ঠান্ডা এবং ভ্যাপসা আবহাওয়া এড়িয়ে যেতে হবে।
চিকিৎসা
- দেরি না করে একজন অর্থোপেডিকের পরামর্শ নিন। হাঁটুর বাতের ব্যথার চিকিৎসাকে চারটি ভাগ ভাগ করা যেতে পারে। যেমন—মেডিকেল ট্রিটমেন্ট, ফিজিওথেরাপি, অপারেশন বা সার্জারি এবং অর্থোটিক্স অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের সাপোর্ট দেওয়া। মনে জোর রাখুন। মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চিকিৎসার সাহায্য নিন যাতে আপনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
- হাঁটুর ব্যথা কমতে মুখে খাওয়ার ওষুধ ছাড়াও প্রয়োজমতো ইঞ্জেকশন নিতে হতে পারে। বিমেষ ধরনের ইঞ্জেকশন মাংসপেশিতে নয়তো সন্ধির অভ্যন্তরে (ইন্ট্রা মাসকুলার অথবা ইন্ট্রা আর্টিকুলার) দিলে সুফল পাওয়া যায়। এই ধরনের ইঞ্জেকশন সন্ধির অভ্যন্তরস্থ নরম অস্থি ও তন্ত্তকে মসৃণ রাখে যার ফলে হাঁটুর হাড়ের প্রান্তভাগে ঘর্ষণ কম হয় এবং অবক্ষয়ও কমে।
- অনেক ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হয়। যেমন—নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ওষুধ ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে রোগ নিরাময় না হলে। হাঁটুতে অস্বাভাবিক বিকৃতি হলে, হাঁটুর ব্যথা সমস্যাকে বাড়িয়ে তুললে, হাঁটুর সাবলীলতা বা ফ্রেক্সিবিলিটি হ্রাস পেলে সার্জারি করতে হবে। এছাড়া হাঁটুর মধ্যে হাড়ের দানা জমলে এবং সেগুলি সমস্যাকে বাড়িয়ে তুললে বিশেষ করে হাঁটা-চলায় ব্যাঘাত ঘটালে অপারেশনের প্রয়োজন হয়। হাঁটা-চলা করতে অথবা উঠতে-বসতে অসহ্য ব্যথা বা কষ্ট হলে আর কালবিলম্ব না করে হাঁটুর প্রয়োজনীয় সার্জারির দরকার হতে পারে।
- টোটাল নী-রিপ্লেসমেন্ট : যদি হাঁটুর বিকৃতি খুব বেশি হয় যা কিনা অন্য কোনো সার্জারি বা ফিজিওথেরাপিতে ঠিক না করা যায়, হাঁটু যদি আলগা বা ঢিলে হয়ে যায় এবং হাঁটা-চলার বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়, সন্ধির অভ্যন্তর যদি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং রোগীর কাজকর্ম ও হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ হাঁটু শক্ত হয়ে যায়, রিউম্যাটয়েড ও অস্টিও আর্থ্রাইটিসে যদি রোগীর হাঁটু বিকল হয়ে পড়ে তখন টোটাল নী রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন পড়ে।
হাঁটুর বাতব্যাধি প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য ফিজিওথেরাপি
- বিশেষ ধরনের ব্যয়াম ও আসন।
- হিট থেরাপি।
- বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাহায্যে চিকিৎসা।
- সওনা বাথের সাহায্যে চিকিৎসা।
বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগীর রিহেবিলিটেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন