স্মৃতিপ্রখরতা বাড়াতে সক্ষম হলেও ক্যানসার সৃষ্টিতে সিদ্ধহস্ত
ডাঃ মধুসুদন ভৌমিক
2019-01-28 11:31:38
মারিজুয়ানাও স্মৃতিপ্রখরতা বাড়ায়
- মারিজুয়ানা: মারিজুয়ানা মানেই শুধু মাদকতা নয়। ইতিহাস অন্য অনেক কথা বলে। যে বস্তু মন নিয়ে মাতলামি করে, যে বস্তু পঙ্গুকে পাহাড় জয়ের হাতছানি দেয়, যে বস্তু ছেঁড়া কাঁথায় ঘুমোনো ভিখারিকে রাজার চেয়ারে বসে রাজসিকতার অনুভব এনে দেয়, যে বস্তুকে নিয়ে দেবদেবীরা হইচই করেন এবং যে বস্তুর কারসাজিতে মানুষ মাটি ছেড়ে স্বর্গে ভেসে বেড়াতে পারে, সে বস্তু মননে, চিন্তনে ও স্মরণে সমান প্রভাব ফেলবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ইতিহাসের প্রথম সারির পাতাগুলোতে মারিজুয়ানার ফল, ফুল, পাতা ও আঁঠা নিয়ে অনেক ইতিবাচক কথা লেখা আছে। আজ যাকে পৃথিবীছাড়া করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেই বস্তু কয়েক যুগ ধরে মেডিসিন হিসেবেই ব্যবহৃত হত। পাতার ধোঁয়ায় শ্বাসরোগ সারত, কোষ্ঠ পরিষ্কার হত। বেদশাস্ত্রেও মারিজুয়ানা নিয়ে বহু মারাত্মক, রোমাহর্ষক ও বিস্ফোরক তথ্য আছে। বিভিন্ন নামে লোকে বস্তুটিকে চেনে। বিশ্বাবাসি চেনে ক্যানবিস নামে। এটি সবুজ পাতাওয়ালা ছোট্ট গাছ। গাছ না বলে ঘাস বলাই ভালো। ঘাসটির পাতা, কুঁড়ি, ডাঁটা, ফুল, ফল, আঁঠা—এক কথায় সবকিছুই কাজে লাগে। প্রতিটি অংশ ও তাদের উপাদান অনুযায়ী লোকে গাঁজা, ভাঙ, চরস, হাসিস, হেম ইত্যাদি নামে বস্তুটিকে চেনে। কেউ সিগারেটের তামাক ফেলে গাঁজার গুড়ো ভরে তাতে সুখটান দেয়। কেউ কলকেতে গাঁজার পাতায় আগুন দিয়ে ‘ব্যোম ভোলে’ হাঁক ছাড়ে। কেউ পাতার সরবতে কিস্তি মাত করে। মানুষ তো কোন ছার, স্বর্গের দেবমহলেও বস্তুটির কদর আছে। এমনকী বনমানুষ, পশুপাখি, ইটভাটার শ্রমিক, মালিক, রাজা, উজির, সেনা, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরাও বস্তুটিকে নিয়ে সমান আগ্রহ দেখায়। সাধুসন্তেরা তো এটিকে ট্রেডমার্ক করে ছেড়েছেন।
কথিত আছে, সংসারের ঝুট-ঝামেলায় জড়িয়ে, মেজাজ হারিয়ে, স্বয়ং শিব নাকি বিবাগী হয়ে একসময় নন্দি-ভৃঙ্গীদের মতো চেলার দল সঙ্গে নিয়ে বনে-বাদাড়ে, পাহাড়-পর্বতেও শ্মশানে ছাইভস্ম মেখে বাঘছাল পরে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন ক্লান্ত হয়ে ক্যানবিসের ঘাসের গদিতে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। পরদিন সকালে তিনি অদ্ভুত মানসিক অনুভূতি ও শারীরিক উত্তেজনা অনুভব করেন ও বস্তুটিকে খাদ্য-পানীয় বানিয়ে ছাড়েন। স্বর্গ-মর্ত্য ও পাতালে বিদ্যুৎ গতিতে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। গুরুর সেই শুভ বা অশুভ লগ্ন থেকে আজও এর ব্যবহার চলছে। নিশ্চয়ই যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে। যুগের আদালতে সুগুণও বদগুণ অনুযায়ী বস্তুটি কখনও পুরস্কৃত ও কখনও তিরস্কৃত হচ্ছে।
কয়েক যুগ ধরে মারিজুয়ানা, হাসিস ও গাঁজা-ভাঙের শক্তির উৎস ও রোগযন্ত্রণা উপশমে ভেষজগুণসম্পন্ন ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হত। দেবাদিদেব মহাদেব গাঁজার সেবন করে নতুন নতুন সৃষ্টি নেশায় উদ্ধুদ্ধ হতেন। ভারতীয় সাধুরা মারিজুয়ানার মায়ায় দেহ থেকে আত্মা বের করে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দিব্যাদেশ পেতেন। জঙ্গলের গাছগুল্ম চিনে জড়িবুটি বানিয়ে আর্তের সেবা করতেন। রাজারা এই দৈব বস্তুটির সরবত খাইয়ে যোদ্ধাদের যুদ্ধে পাঠাতেন ও বাজিমাত করতেন। ক্যানাবিন সেবনে সেনাদের ভয়ভীতি ভেগে যেত ও দেহে সহস্রঘোড়া শক্তি সঞ্চারিত হত। তাদের রণমূর্তি বিপক্ষকে নিমেষে কোণঠাসা করে ছাড়ত।
ভারতবাসীকে গাঁজা গিলিয়ে নেশায় চুর করে রেখে তাদের দেশকে লুটেপুটে শোষণ করার জন্য সাহেবরা সর্বত্র গাঁজা চাষে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। কিছুদিন পর গাঁজার কারসাজিতে ভারতীয়দের সাহেবভীতি চলে গেল। তারা বেপরোয়া হয়ে সাদা চামবালা সাহেবদের গোলাগুলি তুচ্ছ করে যখন তাদের খুলি ওড়াতে শুরু করল তখন লাটের বাটের গাঁজা চাষকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করণ। এমনই গাঁজার মাহাত্ম্য!
এমন মাটি কাঁপানো বস্তু বিজ্ঞানীদেরও চুম্বকের মতো আকর্ষণ করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। বিজ্ঞানীরা তাদের আতস কাঁচের তলায় মারিজুয়ানা তথা ক্যানবিসের মধ্যে আবিষ্কার করলেন সি.এইচ.ডি নামক যাদু উপাদান। মারিজুয়ানা আদি মাদকবস্তু সমূহের এই সি.এইচ.ডি, মস্তিষ্কের আনন্দমাইড নামক ন্যাচারাল গ্রাহককে স্থানচ্যুত করে নিজে চালকের আসনে বসে পড়ে। এই সুরাসুরের বিক্রিয়ায় মস্তিষ্কের মনন মহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ঘটে যায় মানসিক বিকৃতি। ভিখারি নিজেকে রাজা মনে করে ঘোড়া ভেবে কুকুরের পিঠে সওয়ারি হওয়ার কসরত শুরু করে। গাঁজা ফুঁকে মাতালেরা অদ্ভত মানসিক প্রশস্তি অনুভব করে। জাগতিক কোনো কিছুই তাদের ভাবনাকে ছুঁতে পারে না। তারা হঠাৎ অনেক সাহসি হয়ে ওঠে। মশা ভেবে হাতির পাছায় চড় মারতে ছোটে। কোবরার ঠোঁটে হামি দেওয়ার কথা ভাবে।
স্বল্প মাত্রায় মারিজুয়ানা স্নায়বিক সুস্থতা বজায় রাখে। মনকে সৃষ্টিনেশায় উদ্ধুদ্ধ করে। টেনশনকে পেনসন নিতে পাঠায়। তীব্র যন্ত্রণারও উপশম হয়। মুড খুশ থাকে। তকে মেমোরি তলানিতে ঠেকে। বাবার নামও মনে নাও থাকতে পারে। মারিজুয়ানা ক্রনিক পেইন ও পেশি প্রদাহ কমায়। এইচ.আই.ভি বা এইডস রোগীদেরর খিদে বাড়ায়, স্বল্প মাত্রায় ভালো ঘুম হয়।
তবে সাবধান! মারিজুয়ানার মারাত্মক সাইড এফেক্টের কথা মাথায় রেখে আমেরিকান সোসাইট অফ অ্যাডিকশন মেডিসিন, দি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস মারিজুয়ানার মেডিসিনাল ব্যবহার সমর্থন করে না। দি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজ (এন.আই.ডি.এ) মারিজুয়ানাদের চিকিৎসায় ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। গবেষণা করে নতুন কিছু আবিষ্কার করে পি.এইচ.ডি হাতাতে চাইলে অন লাইন থেকে কয়েক মাত্রা চড়িয়ে দেখতে পারেন। তবে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে মাত্র পাঁচটি মারিজুয়ানার সিগারেট পান করলে দেহে পাঁচ হাজার সুস্থ কোষ ক্যানসারের কেরামতি দেখাতে শুরু করে। তেনারা এমনও প্রমাণ করেছেন যে মারিজুয়ানার ব্যবহার স্বল্প মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকে না। ক্রমশ পারদ চড়তে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারি ছোট গর্ত থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে বদ্ধপাগল তথা উম্মাদের মতো বিশাল গর্তে গিয়ে পড়ে। সাময়িক ফুর্তি পাকাপাকিভাবে জীবনের ইতি টেনে দেয়। ড্রাগের নেশা সর্বনাশা। এবার ভাবুন পরখ করবেন কি না।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন