রক্তদান যেন হৃদয়দান
নিতাই কোঙার
2019-01-28 11:40:01
একদা এক রক্তদান শিবিরের মঞ্চের একদিকে সাঁটা একটি বিজ্ঞাপনের ভাষা বেশ নজর কাড়ে---‘রক্ত দিলে লাগে, তারপরে ভালো লাগে।’ মনে হল ভালো লাগে বলেই বি এত যবক-যুবতী রক্তদান করার জন্য ব্যাকুল!
আর একটা ঘটনা বলি। হুগলি জেলার তারাকেশ্বর থানার অণ্তর্গত পূর্ব আস্তারার স্বামীজী সংঘ প্রতি বছর রক্তদান শিবির করে থাকে। আমি একবার ওদের শিবিরে অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে টেকনিশিয়ানরা এসেছিলেন রক্ত সংগ্রহের জন্য। ১৫১ জন যুবক-যুবতী রক্তদানের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু টেকনিশিয়ানরা মাত্র ১০০ জনের রক্ত নেবেন বলে জানালেন। দাতা-দাত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তারা মরিয়া হয়ে বলতে লাগল, ‘আমাদের সবার রক্ত নিতেই হবে, নইলে ছাড়ব না’। শেষ পর্যন্ত ওদের নাছোড় দাবির কাছে সংগ্রাহকদের হার মানতেই হল। তখন কে আগে রক্ত দান করবে, সে নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। দান শেষে দাতা-দাত্রীদের চোখেমুখে পরম তৃপ্তির হাসি দেখে কী ভালো যে লাগল তা কেমন করি বলি!
বিসর্জন নাটকের নায়ক নায়িকাকে বলেছিল—
‘বসে আছি ভরা প্রাণে
দিতে চাই নিতে কেহ নাই।’
বর্তমান প্রজন্ম রক্ত দান করার জন্য ভরা প্রাণে বসে আছেন, কিন্তু সংগ্রহকারীদের সে ব্যাকুলতা নেই, নেই উদ্যোগ। কথায় বলে ‘উদ্যমেন হি সিদ্ধন্তি কার্যানি না মনোরথৈঃ। উদ্যোগ নেই বলেই এ রাজ্যে রক্তের এত আকাল।
আমার গ্রামে অনেক বছর আগে একটি রক্তদান শিবির হয়েছিল। আমার তখন মাত্র আঠারো বছর বয়স। ওই শিবিরে রক্ত দেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু মা বাধ সাধলেন। বললেন, ‘তুই কী রোগা! তোকেই রক্ত দিতে পারলে ভালো হয়, তুই আবার রক্ত দিবি কী করে? খবরদার রক্ত দিবিনে।’ মার কথঅয় হতাশ হলাম। পাশের বাড়ির দাদুর কাছে আমার মনোকষ্টের কথা জানালাম। জানতে চাইলাম রক্ত দিলে কি শরীরের ক্ষতি হয়? দাদু বললেন, ‘কে বলেছে রক্ত দিলে ক্ষতি হয়। মাত্র ২৫০ সিসি রক্ত নেওয়া হয়। এতেশরীরের কোনো ক্ষতি হয় না, বরং ভালেঅ হয়। শরীরে নতুন রক্ত জন্মাবে, দেহে নতুন যৌবন আসবে, কারোর কথা শুনবিনে। নির্ভয়ে রক্ত দে। দেখবি তোর শুকনো ডালে ফুট ফুটবে। জানিস তো দাদুভাই, ধান ফলবার আগে ধান জমিতে নিড়ান দেওয়া হয়, নিড়ান দেওয়ার সময় ধান গাছের গোড়া আলগা করে দিতে হয়। তাতে ধান গাছের অনেক শিকড় ছিঁড়ে যায়। এতে ধান গাছের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং নতুন শিকড় গজায়, তাতে ধানের শিষে যৌবনের দোলা লাগে, শিষগুলি পুষ্ট হয়।
দাদুর কথায় উৎসাহিত হলাম। শিবিরে গিয়ে রক্ত দিলাম। প্রথমে একটু লাগল বটে, তারপরে কী ভালো যে লাগল কেমন করে বলি!
মনে পড়ছে কামিনী রায়ের কবিতার কয়েকটি লাইন---
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও।
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও’।
রক্তদান শিবিরে রক্তদান করে আমার দুরুন সুখ হল। মনে হল জীবনে এই প্রথম পরের জন্য সামান্য করতে পারলাম। পরার্থে আত্মনিবেদনের অনির্বচনীয় আনন্দে আমার অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হল, এ যেন আমার ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। কবির ভাষায় বলে উঠলাম—
‘না জানি কেনরে এতদিন পরে
জাগিয়ে উঠিল প্রাণ।
জাগিয়ে উঠেছে প্রাণ—
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।’
একদা আমার বাংলার মাস্টারমশাই আমাকে উপদেশ দেন, ‘জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা’-এই হোক তোমার জীবন বেদ, পরম সাধনা, সে কথা আজও ভুলিনি। তাই রক্তদানের মহৎ কর্ম সম্পাদনের সুযোগ পেলে, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দু’বার ভাবি না।
রক্তের প্রয়োজনীয়তা
- রক্তের জীবন। রক্তের অভঅবে রোগীর অকাল মৃত্যুবরণ। কৃত্রিম উপায়ে বিজ্ঞানীরা আজও রক্ত তৈরি করতে পারেননি, তাই রক্তের জন্য মুমূর্ষু রোগী মানুষের কাছেই কাতর প্রার্থনা জানায়।
- মানুষ খাদ্যগ্রহণ করে। সেই খাদ্যের সার দেহের হরমোনের সংশ্লেষে পরিণত হয় রক্তে। এই রক্ত সারা শরীরে সঞ্চালিত হয়। এতে মানুষের জীবনীশক্তি ও কর্মক্ষমতা অটুট থাকে। এই জন্যই বলা হয় ‘Good blood good health’।
- এই রক্ত যেন রোগীর ব্যথার বিশল্যকরণী। সুধাসঞ্জীবনী। রক্তের শক্তিতে বেঁচে যায়, নবজীবন পায় কত মুমূর্ষু প্রাণ।
- রক্ত জীবনকুলের জীবনীশক্তির ধারক ও বাহক। এই রক্তের কত কাজ। যেমন—
- রক্ত খাদ্যবস্তুকে দেহের নানা কোষে প্রেরণ করে।
- হরমোন, ভিটামিন ও খনিজ লবণকে দেহের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়।
- দেহ থেকে বর্জ্য পদার্থকে বের করে দেয়।
- দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখে।
- রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
দীর্ঘকালীন অসুস্থতা, রক্তাল্পতা, দুর্ঘটনায় রক্তপাত বা অস্ত্রোপচার প্রভৃতি কারণে জীবের দেহে রক্ত অস্বাভাবিক হারে কমে যায়। তারই ফলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখনই রক্তদাতা ও রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে রোগীকে রক্ত দেওয়া হয়। সমগ্রূপের হলে রক্ত সঞ্চালন সম্ভব হয়। অন্যথায় হিতে বিপরীত হয়।
রক্তের শ্রেণীবিভাগ
বিজ্ঞানী ল্যান্ড স্টেইনার মানবদেহের রক্তকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন ‘A’, ‘B’, ‘AB’, ‘O’। ‘O’ গ্রুপের রক্তকে যেকোনো মানুষের দেহে সঞ্চালিত করা যায়। ‘O’ গ্রুপের রক্তকে তাই বলা হয় সার্বিক দাতা।
রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বর্তমান সংকট
অর্থের বিনিময়ে রক্ত সংগ্রহের প্রথা এ দেশে একদা চালু ছিল। এই প্রথায় অনেক গরিব মানুষ অর্থের বিনিময়ে রক্ত বেচে সংসার নির্বাহ করতেন।
বর্তমানে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে রক্তদান শিবির করে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। সম্প্রতি সরকারি ব্যবস্থপনায় রক্তদান শিবির তেমনভাবে হচ্ছে না। কারণ কী? রক্তদান শিবির করার জন্য যত অভিজ্ঞ ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান প্রয়োজন তত নেই। তাই রাজ্য জুড়ে রক্তের আকাল চলছে। সরকারি হাসপাতালে ‘হোল ব্লাড’ যদিও মিলছে, কিন্তু নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত-উপাদান প্রয়োজন মতো মিলছে না।
হিমোফিলিয়া রোগীদের জন্য চাই প্লাজমা, আবার থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য প্রয়োজন প্যাকড সেল বা লোহিত কণিকা। লিউকোমিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। এদের জন্য নির্দিষ্ট গ্রুপের পর্যাপ্ত সঠিক উপাদানের রক্ত মিলছে না। না পাওয়ার কারণ কী?
এ রাজ্যে মোট সংগৃহীত রক্তের উপাদান পৃথকীকরণ করার হার মাত্র ৩৩ (শতাংশ)। রক্তের উপাদান পৃথক করার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ ডাক্তার বা টেকনিশিয়ান নিয়োগ করা হয়নি। তাই উপাদান পৃথকীকৃত রক্তের এত আকাল। তাই অনন্যোপায় হয়ে লিউকোমিয়া, থ্যালাসেমিয়া ও হিমোফিলিয়া রোগীদের ‘হোল ব্লাড’ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে মারাত্মক। স্বনামধন্য হেমাটোলজিস্ট আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘রক্তের মধ্যে এমন অনেক জীবাণু থেকে যায় যা থেকে সংক্রমণ ছড়াবার ভয় বেশি। প্লাজমার ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি। সাধারণতভাবে রক্ত এটা অনেক বেশি। সাধারণতভাবে রক্ত দেওয়ার আগে যে ধরনের পরীক্ষাগুলি করে দেওয়া হয়,তার বাইরেও বহু জীবাণু থাকে। ‘হোল ব্লাড’ দিলে জীবাণু সংক্রমণের ভয় বেড়ে যায়।
সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরের এখন রক্তের আকালের কারণ সন্ধানে বের হওয়া উচিত। রক্তের আকালের মূল কারণগুলি আবিষ্কার করে সেগুলি দূর করার জন্য বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্তের অভাবে যেসব মুমূর্ষু রোগী হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন,তাদের শ্মশান যাত্রা আর রোধ করা যাবে না।
রক্ত সংরক্ষণ
রক্ত সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা-আছে। যেমন—
- গ্রুপ অনুযায়ী রক্তকে পৃথক বোতলে রাখা হয়।
- প্রতিটি বোতলের গায়ে রক্তের ব্যবহারযোগ্য সময়সীমা উল্লেখ থাকে।
- ৪ ডিগ্রি থেকে ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা সমন্বিত ফ্রিজে রক্ত সংরক্ষণ করলে তিন মাস পর্যন্ত রক্ত বিশুদ্ধ থাকে।
উপসংহার ‘সাহেব’ চলচ্চিত্রে নায়ক কিডনি বিক্রি করে অগ্রজদের ভগ্নিদায়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।‘সেই পথ লক্ষ করে’ আপনারাও রক্তদান করে বিশ্ব পরিবারের অনেক মৃত্যু পথযাত্রী মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। রক্তদাতার রক্ত গ্রহীতার দেহে খেলা করে, তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়, রক্তদাতাও গ্রহীতার মধ্যে বেঁচে থাকেন। আপনার রক্তে উজ্জীবিত গ্রহীতার প্রসন্ন মুখ কল্পনা করে আপনিও প্রসন্ন থাকুন। রক্তদাতাদের ওপর পরম পরমেশ্বরের আশীর্বাদ ধারা বর্ষার জলধারার মতো বর্ষিত হোক—এই প্রার্থনা করি।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন