বৃহদন্ত্রে পলিপ পারিবারিক হলে ভয়টা বেশি
ডাঃ কালিদাস বিশ্বাস (গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট)
2019-02-01 10:57:19
আমাদের জীবনে অত্যন্ত পরিচিতি একটি সমস্যা হল বৃহদন্ত্রে পলিপ বা ছোট টিউমার। কোলন বা বৃহদন্ত্রে যে পলিপ দেখা যায়, সে পলিপের ক্লাসিফিকেশন দু’ভাবে করা যেতে পারে।
কিছু আছে বংশগত আর কিছু বংশগত নয়। যেগুলো বংশগত পলিপ সেগুলো আবার দু’ধরনের হয়।এক, প্যাথোলজিক্যালি যা কে বলা যায় অ্যাডেনোমেটাস পলিপ। পারিবারিক অ্যাডেনোমেটাসপলিপ সবচেয়ে কমন এবং ভয়ঙ্করও বটে।
এছাড়াও হেমাটোমেটাস-পলিপও খুব কমন। এছাড়া বিশেষত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পারিবারিক জুভেনাইল পলিপোসিস হামেশাই দেখা যায়। পলিপোসিস মানে যেখানে কম বয়সে একাধিক পলিপ দেখতে পাওয়া যায়।আর এক ধরনের খটোমটো নামের পলিপ পাওয়া যায়, পিউটজ-জেঘারস সিনড্রোম। পারিবারিক যেসব পলিপোসিস পাওয়া যায় তার মধ্যে এটা একটা।
কেস হিস্ট্রি : একটা ছোট বাচ্চা চিকিৎসার জন্য এসেছে পায়খানার দ্বারা দিয়ে রক্ত পড়ার সমস্যা নিয়ে।সম্পূর্ণ যন্ত্রণা বিহীন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফোঁটা ফোঁটা করে রক্ত পড়ে এবং সেই রক্ত পড়াটা নিয়মিত হয়।
এই ঘটনাটিকে পরীক্ষা করে দেখা যায় বাচ্চাটির এই অবস্থার জন্য দায়ী জুভেনাইল পলিপ। রেক্টামে পলিপটি হয়েছে এবং একটিই পলিপ সেখানে তৈরি হয়েছে যার কারণে পায়খানা করার সময় রক্ত পড়ে। অনেক সময় সিগময়েড বলে কোলনের যে অংশটা আছে সেখানেও পলিপ দেখতে পাওয়া যায়। এই পলিপগুলো সাধারণত ভয়ঙ্কর হয়না। চিকিৎসার মাধ্যমে এগুলো কে সারিয়ে তোলা যায়। এই পলিপটাকে জুভেনাইল রেক্টাল পলিপ বলা হয়। এই পলিপ গুলো যখন সংখ্যায় বেশি হয়ে যায় তখন তাকে বলে জুভেনাইল পলিপোসিস। এই পলিপের কারণে রক্তপড়া ছাড়াও অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সেই লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি হল অবস্ট্রাকশন তৈরি হয়। যদি পলিপ টা বড় হয় এবং একাধিক পলিপ হয় তাহলে অবস্ট্রাকশন তৈরি করে। পায়খানার রাস্তায় ব্যাঘাত হতে পারে এবং নাড়ি জড়িয়ে যেতে পারে। ইনট্রা-সাসেপশন নিয়েও রোগী আসতে পারে।
একটি মাত্র পলিপ থাকলে কেটে বাদ দেওয়া হয়। বেশি কোনো ইনভেস্টিগেশন করার কোনো দরকার পড়েনা এক্ষেত্রে। শুধুমাত্র কোলোনোস্কোপি করা উচিত। কেননা রেক্টামে যেখানে পলিপ আছে তার আগের অংশে বৃহদন্ত্রেও পলিপ থাকতে পারে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যদি পলিপের সংখ্যা খুব বেশি থাকে তাহলে কিন্তু কোলনের অনেকটা অংশ কেটে বাদ দিতে হয়। সেখানে শুধু পলিপ কেটে বাদ দিলে সমস্যাটা মেটেনা।
হাসপাতালগুলোতে বাচ্চাদের এইধরনের সমস্যা প্রচুর দেখা যায়। এই ধরনের কেস করতে গিয়ে ডাক্তাররা চিন্তা করেন এই পলিপটা পারিবারিক কিনা, ফ্যামিলিয়ার অ্যাডেনোমেটাস পলিপ কিনা। পারিবারিক কথাটির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এই পলিপ টি ভবিষ্যতে ম্যালিগন্যান্সিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
প্রথমত থাকে সন্দেহ, তারপরে ডায়াগনোসিস করা হয়। ডায়গনোসিস করার প্রথম কথাই হল কোলোনোস্কোপি করা।
অনেক সময় দেখা গেছে পলিপের সংখ্যা কয়েকশো থেকে হাজার হতে পারে। এইরকম ক্ষেত্রে গোটা কোলোন এবং মলদ্বারের গোড়ার অংশটা বাদ দেওয়া ছাড়া অন্যকোনো রাস্তা থাকেনা।
এইরকম অবস্থায় একটি কৃত্রিম মলদ্বার তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বা কৃত্রিম একটা রেক্টামের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় যাতে রোগীর পরবর্তী জীবনে অসুবিধেটা কম হয়।
এতকিছু করার একটাই উদ্দেশ্য তা হল ক্যানসারকে প্রতিরোধ করা। আর যদি কোনো অংশে ক্যানসার হয়ে থাকে বা হওয়ার পথে থাকে তবে সেটা কে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের বিপদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া।
ওষুধের দ্বারা কি পারিবারিক পলিপকে নিবারণ করা সম্ভব
কিছুটা হলেও সম্ভব।বিশেষত যাদের অপারেশন করা হচ্ছে তাদের রেক্টাম, কোলনের অন্যান্য অংশে যাতে পলিপ পুনরায় না জন্মায় তার জন্য অ্যাসপিরিন, সুলিনড্যাক দীর্ঘদিন ধরে খাওয়ানো যায় (যার কোনো লিমিটেশন থাকেনা) তাদের নতুন করে পলিপের জন্ম অনেক কম হয় এবং কেটে ফেলা পলিপের অংশে নতুন করে পলিপও কম হয়।
তবে সুলিনড্যাক দিয়ে ম্যালিগনেন্সি প্রতিরোধ করা যায়না।
পিউটজ-জেঘারস অসুখটি জন্মগত অসুখ। যদিও জন্মের সাথে সাথে সব লক্ষণ দেখা যায়না। শিশুর মুখের মধ্যে ফ্রেকলস অর্থাৎ কালোকালো ছোপ দাগ থাকে বিশেষত ঠোঁটের চারপাশে নাকের দুই ফুটোর নীচে ফ্রেকলস থাকে।মুখের মধ্যে যে মিউকাস-মেমব্রেন থাকে সেখানে কালো ছোপছোপ দাগ থাকে। এই লক্ষণ গুলো দেখে সন্দেহ করা হয় এই বাচ্চাটির পিউটজ-জেঘারস সিনড্রোম হতে পারে। এই রোগটির প্রধান বিপদ হল এ থেকে অনেক সময় ম্যালিগনেন্সি হতে পারে। এই ছোপছোপ অংশ গুলো দেখে আগে থেকে সন্দেহ করা বা ডায়াগনোসিস করা সম্ভব হয়।
সুতরাং কারো যদি মুখগহ্বরের ভেতর ছোপ ছোপ দাগ থাকে তাহলে অবশ্যই সন্দেহ করা উচিত।বিশেষত যদি পায়খানার সাথে একটু একটু রক্ত পড়ে।
ক্যানসার হওয়ার কথা অনেকবার বলা হয়েছে।ক্যানসার বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে।
শুধুমাত্র বৃহদন্ত্রে হবে তার কোনো মানে নেই, পাকস্থলি বা খাদ্যনালীর অন্যান্য অংশেও হতে পারে। পারিবারিক অ্যাডেনোমেটাসের সিনড্রোম নিয়ে বড়রা চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের কাছে আসেন ত্রিশ বছরের পর। রোগীরা সমস্যাটা প্রথমে বুঝতে পারেন না।একদম সাইলেন্ট অসুখ।
জুভেনাইল পলিপের বাচ্চারা ডাক্তারবাবুদের কাছে সাধারণত আসে চার-পাঁচ বছর থেকে ন’বছর বয়সের মধ্যেই।
এফ.এ.পি নিয়ে যখন কোনো অ্যাডাল্ট রোগী আসে ত্রিশ বছর বয়সে তখন তার ক্যানসার হয়ে গেছে। এমনও দেখা গেছে চোদ্দ বছরের মেয়ের পেট ভর্তি পলিপ ক্যানসারে ট্রান্সফার করেছে।
চিকিৎসা
এফ.এ.পি হলে টোটাল প্রক্টোকোলেক্টমি। তবে সিদ্ধান্ত নেবে সম্পূর্ণ ভাবে সার্জন। কারণ রোগ কতটা বিস্তৃত হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে কোলন বাদ দিতে হয়। জুভেনাইল পলিপ যেটা অত্যন্ত কমন, সেক্ষেত্রে চিকিৎসা হল পলিরেক্টমি। এটা করা হয় কোলোসোস্কোপি যন্ত্রের সাহায্যে, পেট কাটার দরকার পড়েনা। এক্ষেত্রে পলিপটা কেটে দিলে ঝঞ্জাট মুক্ত হওয়া যায়।সমস্ত রকম পলিপের ক্ষেত্রে বায়োপসি করে নেওয়াটা বাধ্যতামূলক।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন