জননাঙ্গে টিবি সংক্রমণের পরে ও সন্তান
ডাঃ কৌশিকী রায়
2019-02-01 11:39:55
সংক্রমণ নিয়ে আমাদের মধ্যে স্পষ্ট ধারণার অভাব আজও রয়েছে। যার ফলে জননাঙ্গের সংক্রমণ থেকে ক্রমাগতেই বোড়ছে ইনফার্টিলিটির সমস্যা। তবে এই সব ক্ষেত্রে অবশ্যই সঠিক সময়ে সঠিক পরীক্ষায় যদি সমস্যা নির্ণয় করা যায় তাহলে বিভ্রান্তি ও জটিলতা অনেকটা কমে যায়। সুফলও মেলে চটজলদি। ঠিক তেমনি জননাঙ্গে টিউবারকুলোসিস বা টিবির জীবাণু ছড়িয়ে গেলে সেটা সমগ্র জননাঙ্গকেই অক্ষম করে দেয় সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র সংক্রমণকে সঠিকভাবে চেনার ভুলে বা ডায়াগনোসিস করার ভুলে চিকিৎসা পদ্ধতিও বিলম্বিত হচ্ছে বা বিঘ্ন ঘটছে। আসলে সমস্যার গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যুক্তিমনস্কতার পরিচয় দিলে সন্তান ধারণের সাফরল্য অধরা থাকেনা।
প্রায় অনেকটা এমনই ঘটেছিল দক্ষিণ কলকাতার দাশগুপ্ত দম্পতির পরিবারেও। হঠাৎ একদিন ওই প্রৌঢ় দম্পতি আমাদের কাছে ছুটে আসের এবং জানান যে, আচমকা এক পথ দুর্ঘটনায় তাদের একমাত্র পুত্র আঘাত পেয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গেছিলেন। মস্তিষ্কে আঘাত গুরুতর হওয়ায় এখনও বেশ অসুস্থ। এদিকে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন প্রায় চার বছর হয়েছে। কিন্তু বৌমার গর্ভে এখনও সন্তান না আসায় উদ্বিগ্ন মানুষ দুটো ফার্টিলিটি ক্লিনিকে ছুটে এসেছেন। সব সমস্যা শুনে তাদেরকে একবার ছেলে-বৌমাকে নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তারা বৌমাকে নিয়ে আসার পর যখন তার শারীরিক পরিস্থিতি, অতীতের অসুখ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছিল তখন একটি তথ্য চমকে দেয়, বালিকা বয়সে একবার তিনি টিউবারকুলোসিসে ভুগেছিলেন। যতই সেটা প্রি-মেনার্কাল বয়সে বা মেনস্ট্রুয়েশন শুরুর আগে হয়ে থাকুক না কেন টিবির ব্যাক্টেরিয়া কিন্তু জননাঙ্গে প্রবেশ করে থাকতে পারে। আসলে টিবির ব্যাক্টেরিয়া রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে এলে তা জননাঙ্গে প্রবেশ করে সেখানেও সংক্রমণের জাল ছড়াতে পারে। ফলে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়। মহিলার ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসোনোগ্রাফি করা হল। তখন তার মিড সাইকেলে ইউ.এস.জি-তে দেখা গেল যে তার ইউটেরাসের এন্ডোমেট্রয়াম খুব পাতলা। যা কিন্তু ভ্রূণকে জরায়ুতে বেড়ে ওঠার পক্ষে উপযুক্ত আশ্রয় দিতে পারে না। কিন্তু সেটাই যে তার ইনফার্টিলিটির পেছনে একমাত্র কারণ নয়, তা বোঝার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা করা হয়।
সেই সব পরীক্ষায় প্রকাশ হয় যে তিনি যেহেতু নিতান্তই কম বয়সী (তিরিশের কম) তাই তার ডিম্বাণুর স্টক বেশ ভালো। এমনকী স্বামীর শুক্রাণুর পরিমাণ ও গুণমাও যথেস্ট ভালো। দু’জনের এইসব পরীক্ষাগুলো করে বোঝা গেল স্বামীর স্পার্ম কাউন্ট যেখানে স্বাভাবিক এবং স্ত্রীর ওভারিও কর্মক্ষম তখন স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান ধারণের সমস্যা তৈরি করছে অন্য কোনো সমস্যা। আবার টিউবারকুলোসিসের আশঙ্কা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। হয়তো টিবির ব্যাক্টেরিয়া মহিলার ফ্যালোপিয়ান টিউবের পঁচাশি শতাংশ ক্ষতি করে দিয়েছে তাই টিউবের ভেতরে থাকা অচল সিলিয়ারিগুলো ডিম্বাণুকে শুক্রাণুর সঙ্গে নিষেক ঘটাতে দিচ্ছে না। নয়তো টিবির ব্যাক্টেরিয়া জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামেকে ক্ষয়িষ্ণু করে এত পাতলা করে দিয়েছে যে সেখানে ভ্রূণ ধারণা করা যাচ্ছে না। ফলে সন্তানও আসছে না। আবার টিবি থেকে ডিম্বাণুর মানেও প্রভাব পড়ে থাকতে পারে।
তাই সব দিক বিশ্লেষণ করে তারা ইন্ট্রা-ইউটেরাইন ইনসেমিনেশান বা আই.ইউ.আই করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। নিমরাজি হয়ে তিনবার আই.ইউ.আই করা হল কিন্তু কোনো ফল পাওয়া গেল না। ফলে প্রৌঢ় দম্পতি এবং তাদের বৌমারও কিছুটা ধৈর্যচ্যুতি হল। উৎকন্ঠায় তারাও কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না
এবার তাদেরকে ভালো করে কাউন্সেলিং করে আই.ভি.এফ বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশানের জন্য রাজি করা হল। একটি ফ্রেস সাইকেলে যখন এন্ডোমেট্রিয়ামও ভালোই ঠেকছিল, তখন আই.ভি.এফ করা হল। আশ্চর্য ঘটনা প্রথম আই.ভি.এফ সাইকেলেই তিনি কনসিভ করলেন। সঠিক সময়ে স্বাভাবিক উপায়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্মও দেন তিনি। স্বভাবতেই প্রোঢ় দাশগুপ্ত পরিবার খুশি।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আই.ভি.এফ করার আগে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মূল কারণটা খুঁজে বের করা। টিউবারকুলার এন্ডোমেট্রিওসিস বা খারাপ টিউবও বাধা হতে পারে না একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে। এমনকী এন্ডোমেট্রিয়ামে সংক্রমণ জনিত জটও ছাড়ানো সম্ভব হেস্টোরোস্কোপিক অ্যাডেসিওলাইসিস দ্বরা। পাশাপাশি প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ এন্ডোমেট্রিয়াম হরমোন দ্বারা তৈরি করে ফেলা। তাই পূর্বের অসুখ হতেই পারে বন্ধ্যাত্বের কারণ, তবে ইচ্ছে থাকলে উপায়ও হয়। যা আরও একবার প্রমাণিত হল দাশগুপ্ত পরিবারের ঘটনায়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন