কার্টুনে শৈশব নষ্ট
নিতাই কোঙার
2019-02-01 12:50:25
চিন্তামণির প্রতি বিল্বমঙ্গলের যেমন পাগলপরা ভালোবাসা, ঠিক তেমনি বর্তমান শিশুদেরও টিভিতে প্রদর্শিত কার্টুনের প্রতি ভালোবাসা। শাস্ত্র বলে, ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। শিশুদের কাছে কার্টুনই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা। ড্রাগাসক্ত যেমন থাকতে পারে না ড্রাগ ছাড়া, ঠিক তেমনি শিশুরাও থাকতে পারে না কার্টুন দর্শন ছাড়া। কার্টুন তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ওদের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে আছে শুধু কার্টুন। তার ফল হচ্ছে মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। বিল্বমঙ্গলের পতিতাপ্রেম থেকে কৃষ্ণপ্রেমে ঘটেছিল। কার্টুনের নেশায় মত্ত শিশুদের উত্তরণের উপায় কী? উত্তরণের পথ জানার আগে জানতে হবে সমগ্র পরিস্থিতি। এখন সেই দিকেই আলোকপাত করছি।
কার্টুন নিয়ে সমীক্ষা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় শিশুদের ওপর কার্টুনের প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছে, সেই সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলি:
কার্টুন দেখে—
- ৩% শিশু এক থেকে দু’ঘন্টা।
- ১৭% শিশু তিন থেকে ছ’ঘন্টা।
- ৮০% শিশু ছ’ঘন্টা বা তার বেশি।
তিন বছরের ষাট জন শিশুকে নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়। এদের মধ্যে তিরিশজনকে কেবল কার্টুন। দেখতে দেওয়া হয়, বাকি তিরিশ জনকে কেবল বই পড়তে দেওয়া হয়। কার্টুন দেখা শিশুদের প্রশ্ন করে বিশেষ সদুত্তর মেলেনি। উত্তর মিললেও তাতে শিশুদের নিজস্ব চিন্তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।
বইপড়া শিশুদের প্রশ্ন করে যেমন সদুত্তর পাওয়া গেছে, তেমনি তাদের উত্তরদানের মধ্যে মৌলিক চিন্তার পরিচয় মিলেছে।
একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিশুদের বলা হয়, তোমরা যারা কার্টুন দেখতে ভালোবাস হাত তোল। সকলেই একযোগে হাত তোলে।
তারপর প্রশ্ন করা হয় যদি তোমাদের কার্টুন দেখতে না দেওয়া হয়, তাহলে তোমরা কী করবে?
কেউ বলে, সব ভেঙে দেব, কেউ বলে চুল ছিঁড়ব, চেঁচাব। কেউ বলে, ছাদ থেকে ঝাঁপ দেব। কেউ বলে অন্য গ্রহে চলে যাব। সবাই সমস্বরে প্রতিবাদে মুখর হয়, কার্টুন বন্ধ করা চলবে না, কার্টুন ছাড়া আমরা বাঁচব না। কার্টুনের মধ্যে ছোটা ভীম আর বার্বি ডল তাদের বেশি পছন্দ, এ কথা জানতেও তারা ভোলেনি।
কার্টুনের কুপ্রভাব
স্বনামধন্য সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বাবা-মায়ের সদাই ব্যস্ত, তাই শিশুদের চুপ করিয়ে রাখার জন্য বোকা বাক্সের সামনে কার্টুন চ্যানেল খুলে বসিয়ে দিচ্ছেন। এর ফলেনষ্ট হচ্ছে শৈশব।’
কার্টুনের কুপ্রভাবে শিশুদের সর্বনাশ হচ্ছে। সেই সর্বনাশের তালিকা দীর্ঘ। যেমন—
- শিশুদের কল্পনাশক্তি, সৃষ্টিশীলতা কমে যায়, মস্তিষ্ক স্থবির হয়ে পড়ে।
- বিচার শক্তি, বিশ্লেষণ শক্তি হ্রাস পায়।
- বাচন ভঙ্গি ও চিন্তাভাবনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
- খেতে খেতে কার্টুন দেখল খাওয়া হয় না, গেলা হয়। ফলে হজম হয় না। শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। তার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। অনেক সময় হয়ে যায় অতিভোজন, তাতে দ্রুত বাড়ে ওজন। ফলে জড়ত্বা বিৃদ্ধি পায়, অলসতা বাড়ে, বই পড়ার ইচ্ছেটাও মরে যায়।
- শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। শক্তিমান নামক কার্টুনের শক্তিমানের নকল করতে গিয়ে কত শিশুর জীবন কুসুম ঝরে পড়েছে অকালে। কার্টুন চরিত্রের আচরণ ও কণ্ঠস্বর ননকল করছে শিশুরা। কার্টুন প্রকৃতপক্ষে শিশুদের বিকৃত করে দিচ্ছে।
- কার্টুন দেখে শিশুরা অস্থির, অসহিষ্ণু, উচ্ছৃঙ্খলা হয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে এই লাইন, ‘বাঁধ ভেঙে দাও’। শিশুরা কার্টুন দেখে বাঁধানহারা। সৃষ্টি নয়, ধ্বংসই হচ্ছে তাদের জীবনবেদ।
- শিশুদের কোনো বন্ধু নেই। তাই টিভি হয়ে উঠেছে তাদের প্রকৃত বন্ধু। ফলে কার্টুন নামক অসৎবন্ধুর প্রভাবে তাদের হচ্ছে সর্বনাশ।
- কার্টুন দেখে শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, ফলে অনেক সময় তারা সহচরকেও খুন করে ফেলছে।
- কার্টুন দেখার নেশায় শিশুরা ঘরের বাইরে যেতে চাইছে না। ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে তাদের যোগ ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের সুকুমার বৃত্তিলোর বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
- কার্টুন দেখা শিশুরা দলে ভারি। যারা দেখে না তারা হীনম্মন্যতায় ভুগছে। ঘরে, বাইরে, শিক্ষালয়ে তারা ব্যঙ্গের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে।
প্রতিকার
- কার্টুন মাত্রই খারাপ, এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। আগে এমন সব কার্টুন ছিল, যাতে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন বার্তা ছিল, তাতে ছিল শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু। রূপকথার গল্প অবলম্বনে কার্টুন হলে সেই কার্টুন শিশুদের বিকৃত করে না।
- যারা কার্টুন তৈরি করেন, তারা মনোবিজ্ঞানী। তারা জানেন কীরকম বিষয় অবলম্বনে কার্টুন নির্মাণ করলে শিশুরা কার্টুনের নেশায় পাগল হয়ে অন্য কিছুর প্রতি আকর্ষণ নেশায় পাগল হয়ে অন্য কিছুর প্রতি আকর্ষণ হারাবে। তাই শিশু উপযোগী বিষয় অবলম্বনে কার্টুন না হলে, সেই কার্টুন টি.ভি-তে প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। বিদেশে এ বিষয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আছে, আমাদের দেশেও এই নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি।
- অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। ‘ছোট ভীম’, ‘মিকি মাউস’, ‘বার্বি ডল’ ইত্যাদি কার্টুন শিশুদের বড় প্রিয়। এইসব কার্টুন শিশুদের দেখতে দেওয়া যেতে পারে, তবে বেশিক্ষণ কিছুতেই নয়। মনে রাখবেন, ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ তথ্য হল একটানা পনেরো মিনিট কার্টুন দেখলেও শিশুদের ক্ষতি হতে পারে।
- শিশুদের খেলার সাথী নেই, দাদু-ঠাকুমাদেরই হতে হবে ওদের খেলার সাথী। ওদের সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলুন। নিজেরা ঘোড়া হয়ে ওদের করুন ঘোড় সওয়ার। ওদের সঙ্গে পুতুল খেলুন, ছেলে পুতুলের সঙ্গে মেয়ে পুতুলের বিয়ে দিন, অনুষ্ঠানে মাতুন। শিশুদের নিয়ে প্রকৃতির অঙ্গনে ভ্রমণ করুন। গাছ, ফুল, পাখিদের চেনান। পার্কে যান, মেলায় নিয়ে গিয়ে ওদের নাগরদোলায় চড়ান, বাদাম, ফুসকা, ভেলপুরী খাওয়ান।
- শিশুদের মধ্যে ছবি আঁকার নেশা আর গানের নেশা জাগান।
কার্টুনে মজে শিশুরা গৃহবন্দী। ওরা মেলে না আকাশে কল্পনার ডানা। ওদের দেখে মনে হয় যেন ডানা কাটা জটায়ু। শিশুরা ভালোবাসর কাঙাল। ওদের ভালোবাসুন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন