রাজ্যজুড়ে হিংসার প্রকোপ
অধ্যাপক বিপ্লব মুখোপাধ্যায়
2019-02-01 14:35:55
কোরবান শাহ এক অখ্যাত যুবক ছিল, কিন্তু বর্তমানে এই নামটি প্রচার মাধ্যমের সুবাদে অধিকাংশ বঙ্গবাসীর কাছে জানা। কোরবান মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক, হত দরিদ্র পরিবারের বাসিন্দা। অভিযোগ যে সে এন.আর.এস হাসপাতালের ছাত্রাবাস থেকে প্রায়ই ডাক্তারি পড়ুয়াদের নানান সামগ্রী চুরি করত। এক রাত্রে কোরবানকে হোস্টেলের তিনতলার এক ঘুপচি স্থানে দেখা যায়। এর পরেই মেডিকেলের ছাত্ররা তাকে টেনে-হিঁচড়ে বার করে নিয়ে আসে এবং শুরু হয় গণপ্রহার। শেষ পর্যন্ত তার হাত-পা থামের সঙ্গে বেঁধে বাঁশ দিয়ে তাকে প্রহার চলতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটে। মরদেহ সেখানেই পড়ে থাকে, পরে জানাজানি হয়, মৃতদেহ উদ্ধার হয়, পুলিশ অনুসন্ধান শুর করে, কিন্তু এক বিশেষ কারণে তদন্তের কার্যে অদ্ভুত ঢিলেমি লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ হল এই মর্মান্তিক ঘটনার যারা মূল অভিযুক্ত তারা শাসক দলের এক বিশিষ্ট নেতার আশ্রয়পুষ্ট। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ যখন উত্তাল হয়ে ওঠে তখন পুলিশ নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় এবং শর্ত সাপেক্ষে মূল অভিযুক্ত চার ডাক্তারি পড়ুয়াকে গ্রেফতার করে। মামলা হয়তো অনেক টান-বাহনার পর কোর্টে উঠবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ফলাফল হবে তা নিয়ে গভীর সংশয় আছে। ঘটনাটির বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল এই ঘটনার যারা অভিযুক্ত তারা প্রত্যেকেই ডাক্তারির ছাত্র, অদূর ভবিষ্যতে যারা ডাক্তার হয়ে সমাজ অঙ্গনে পা রাখবেন। ‘সেবাই মূল ধর্ম’ এই শপথবাক্য উচ্চারণ করে একজন ডাক্তার তার সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন।
পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্ডীপুর গ্রাম মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় সভায় বক্তৃতা করছিলেন। হঠাৎই দেবাশীষ নামক এক যুবক মঞ্চে উঠে পড়ে অভিষেককে দুটি চড় মারে। আঘাত গুরুতর ছিল না। কিন্তু মঞ্চে উপস্থিত দলীয় নেতা ও কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে দেবাশীষের উপর এবং শুরু হয় গণপ্রহার। পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষে দেবাশীষকে যখন উদ্ধার করা সম্ভব হয় তখন তার অন্তিম অবস্থা। বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন। দেবাশীষও কিছু পরিমাণে মানসিক ভারসাম্যহীন। পুলিশ তার বিরুদ্ধে ‘খুনের চেষ্টা’র অভিযোগ এনেছে। কিন্তু মজার কথা হল দেবাশীষকে যারা গণপ্রহারে মৃতপ্রায় করল তারা পরিচিত মুখ হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। এক্ষেত্রে পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় কিছু যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। মামলার ফলাফল কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।
দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হল। দুটি ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির সামান্য হলেও সংযোগ রয়েছে। এই নিবন্ধে অত্যন্ত সচেতন ভাবে এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। বর্তমান নিবন্ধে যেটি সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল হিংসার নির্মম প্রকাশ। দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই একথা সমভাবে প্রযোজ্য। ডাক্তারি ছাত্ররা যেমন কোরবান শাহকে হিংস্র উল্লাসে বাঁশ দিয়ে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করেছে, তার কাতর আর্তনাদ একটুকুও ডাক্তারি পড়ুঢাদের মনকে সিক্ত করেনি। ঠিক তেমনি চন্ডীপুরে শাসকদলের নেতা-কর্মীরাও পৈশাচিক উল্লাসে দেবাশীষকে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করেছে। এক্ষেত্রে যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ফুঠে ওঠে তা হল হিংসা, হিংসার প্রকাশ। আরও একটি বিষয় এই দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে সমানভাবে উপস্থিত, তা হল আইন নিজের হাতে নেওয়ার প্রবণতা, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোরবান চোর হতে পারে, তাকে ধরে পলিশের হাতে সমর্পণ করাই কি উচিত কাজ ছিল না? দেবাশীষ অত্যন্ত ন্যক্কারজনক কাজ করেছে একজন সাংসদকে চড় মেরে। কিন্তু তার এই অপরাধের বিচার কারা করবে—হিংস্র নেতা-কর্মীরা না আদালতে? তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াই কি উচিত কাজ ছিল না? এই দুটি বিষয় অকারণ হিংসার প্রয়োগ এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া—ক্রমশই গুরুতর সামাজিক সমস্যার রূপে পরিগণিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা এই দুই-এর প্রবণতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক দূষণের অন্যতম দুটি প্রকাশ রূপে এই বিষয় দুটিকে চিহ্নিত করা যায়। হিংসা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। আদিম মানুষের মনে হিংসা যে রূপে উপস্থিত ছিল আজকের মানুষের মনেও হিংসা সেই একই ভাবে উপস্থিত। তবে পার্থক্য হল আদিম মানুষ মূলত আত্মরক্ষা বা খাদ্য অন্বেষণের জন্যই হিংস্র আচরণ করত। কিন্তু বর্তমানকালের সভ্য, শিক্ষিত, প্রগতিশীল মানুষেরা হিংসার প্রকাশ ঘটায় অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ কারণে। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির অসৎ উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রচিবোধ মানুষের মনে উপস্থিত হিংসার প্রকাশকে কিছু পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও অনুকুল পরিবেশে তা প্রবলরূপে বিস্ফারিত হয়। মানুষের হিংস্র আচরণ রোধ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর ভূমিকা নেয় আইন। আইনের শাসন হিংষাকে বহু পরিমাণে নিরস্ত করে, আইনের ভয়ে হিংস্র আচরণের প্রকাশকে বহুল পরিমাণে প্রশমিত রাখে। কিন্তু আইনের শাসন যদি শিথিল হয় তাহলে পুরো কাঠামোটাই ভেঙে পড়ে। তখণ হিংস্র আচরণের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। ঠিক এমনটাই ঘটছে সাম্প্রতিক কালে এরাজ্যে। আইনের শাসস নেই, তাই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। কারণ কোনো ভয় নেই, আইনের শাসনের ভয় অনুপস্থিত। এভাবেই ঘটছে হিংস্র আচরণের নিরন্তর বাড়বাড়ন্ত। এক অত্যন্ত অশুভ বাতাবরণে বর্তমান সমাজ অবস্থান করছে। এই অবস্থা আরো শোচনীয় পরিণতির দিকে যাবে, যদি না এক পাল্টা আন্দোলন শুরু হয়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন