মাথার যন্ত্রণায় অস্থির? সাইনাসও হতে পারে
ডাঃ শ্যামল ভট্টাচার্য
2019-02-01 15:30:21
সাইনাসের অর্থ হল মাথার খুলির হাড়ের সঙ্গে যে গর্ত নাককে যুক্ত করে বা পুঁজ নিঃস্রাবী নালী। যা নাসিকার ভেতর একটি প্রাচীরের মতো এবং যা ভিন্ন অংশে ভাগ করে থাকে। একে বলা হয় সেপ্টাম। এর সামান্য ওপর দিকে অবস্থিত ইথময়েড। সেখানকার ফাঁপা অংশ বা গহ্বরকে বলা হয় ইথময়েড সাইনাস। দুটো চোখের ভিতর দিকে সেই স্থানের সুপ্রা অরবিট এবং ভ্রুর ওপর দিকে মস্তিষ্কের সামনে নালিকার মতো ফাঁপা অংশকে ফ্রন্টাল সাইনাস বলে।
সাইনাসের সংক্রমণ অতি পরিচিত যা সচরাচর লক্ষ্য করা যায়।
অনেকেরই অল্পতে ঠান্ডা লাগার প্রবণতা থাকে, বিশেষ করে শীতকালে ঠান্ডায় নাকি দিয়ে জলপড়া, সর্দি ইত্যাদি সাধারণ ব্যাপার। আবার কেউ কেউ সারা বছরই ভোগেন। কপাল ও মুখমুন্ডলের পাশে প্যারানাসাল সাইনাসগুলোর মাঝে সংক্রমষ ঘটে যে প্রদাহ শুরু হয়, তাকে সাইনুসাইটিস বলে। এর আসল কারণ অ্যালার্জি, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ইনফেকশন ইত্যাদি। তাছাড়া নাকের ভেতর কোনো পলিপ কিংবা অর্বুদ বা নাকের চামড়া অথবা হাড় বেড়ে গেলেও অসুবিধে হয়।
নাক বন্ধ অবস্থাটা সত্যি ভীষণ অস্বস্তিকর। এটা ছোট-বড় সকলেরই হতে পারে। সেই সময় যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধে হয়, তেমনই নাকি সুরে কথাও লক্ষ্য করা যায়।
প্রায় দেখা যায় অনেকেরই হঠাৎ করে যখন-তখন সর্দি হয় এবং সর্দিতে জলীয় পদার্থ নানা কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নিঃসরিত না হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকা স্থানে বা সাইনাসের মধ্যে জমতে থাকে। এরপর সেই স্থানে জীবাণুর আক্রমণে ছিদ্রগুলোতে পুঁজের সঞ্চার ঘটে ও পুঁজে ভরে যায়। এর ফলে মস্তিষ্কের সামনের দিকে কপালে যন্ত্রণা অনুভব হয়। সাথে অল্প জ্বরও থাকে। যন্ত্রণা বহুক্ষেত্রে তীব্র থেকে তীব্রতর লক্ষ করা যায়।
প্রথমাবস্থায় রোগাক্রান্ত ব্যক্তি পঁজের গন্ধ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঘ্রাণশক্তির হ্রাস ঘটে। এর ফলে রোগী নাকে কোনো গন্ধ অনুভব করতে পারে না বা নাকে কোনো গন্ধ পায় না। সাইনাসের প্রকোপ যত বৃদ্ধি পায়, তার ফলে ক্রমশ নাসিকা প্রাচীরের স্ফীতি ঘটে এবং ধীরে ধীরে শ্বাসনালীর ওপর ভাগে সংক্রমণের বিস্তার ঘটে এবং ফুলে উঠে প্রদাহের সৃষ্টি হয়, সেই অবস্থাকে সাইনুসাইটিস বলে।
রোগের কারণ
সাইনাসের বেশ কয়েকটি লক্ষ্য করা যায়। যেমন—
- নাকে কোনো সাংঘাতিক আঘাত বা চোট পেলে সাইনাস হতে পারে।
- ন্যাজাল সেপ্টাম বলে নাকের ভেতর যে অংশটি অবস্থিত, তা নরম হাড়ের দ্বারা গঠিত একটি ক্ষুদ্র প্রাচীরের মতো অংশ। সেখানে কোনো সংক্রমণ হলে রোগ হতে পারে।
- বংশগত ইতিহাসও একটি কারণ হিসেবে বহুক্ষেত্রে বিদ্যমান।
- নোংরা জল তথা পুকুর, খাল, বিল ইত্যাদির জলে স্নান করলেও রোগ সংক্রমণ হতে পারে।
- শিশুদের ক্ষেত্রে কোয়ানাল এট্রেশিয়া নামক ক্রুটি লক্ষ করা যায়। তবে এটি জন্মগত একটি ক্রুটি। মানবদেহে নাকের সম্মুখে যেমন দুটো ফুটো থাকে ঠিক তেমনি পেছনের দিকেও দুটো ফুটো থাকে। শিশুর জন্মের পর বহুক্ষেত্রে পেছনের একটা বা দুটো ফুটোই বন্ধ থাকতে পারে। তখন শিশুর স্তন পানে অসুবিধে হয়। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবে একটা ফুটো বন্ধ থাকলে অসুবিধে কম হয়।
- অ্যাডিনয়েডের স্ফীতির জন্যও অসুবিধে হয়ে থাকে।
- নাকের ভিতর কোনো বহির্বস্তুর আটকে থাকলে তা রোগের কারণ হতে পারে।
- নাকের ভেতর বাঁকা পার্টিশন বা জন্মগত ক্রুটি থেকেও সাইনাস হতে পারে।
- সাধারণতি সর্দি-কাশির উপযুকক্ত চিকিৎসার অভাবে এ রোগ হতে পারে।
- যেকোনো ধরনের অ্যালার্জি এই রোগের কারণ হতে পারে।কারণ জন্মের পর থেকে ধুলো, বালি, ধোঁয়া সহ নানা ধরনের তীব্র গন্ধ শিশুর নিত্য সঙ্গী। এর মাধ্যমে অ্যালার্জি ঘটে এবং ধীরে ধীরে রোগের কারণ হয়ে উপস্থিত হয়।
- নাকের ভেতর টিউমার হলেও বহুক্ষেত্রে এর কারণ হয়।
- নাকের পলিপ থেকেও সাইনাস হতে পারে।
- সিফিলিস নামক রোগ পরবর্তীকালে এ রোগের কারণ হতে পারে।
- অনেক সময় নাকে কাঁচা জল, সর্দি ইত্যাদি লক্ষ করা যায় এবং বহুক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ উপশমের জন্য নানারকম চেষ্টা করা হয়। এর ফলে সাময়িক আরাম হয় কিন্তু বার বার ভোগার ফলে সাইনাসের ওপর একটি প্রলেপ বা আস্তরণের সৃষ্টি হয় এবং পরে সেটা শুকিয়ে গিয়ে সংক্রমণ ঘটিয়ে রোগের কারণ হয়ে ওঠে।
রোগের লক্ষণ
এই রোগের অতি পরিচিত লক্ষণ হল মাথা যন্ত্রণা, অল্প জ্বর, নাক বন্ধ ও মাথা ভার, চোয়াল ও নাকের দু’পাশে ব্যথা, সর্দি ইত্যাদি।
- নাকের কাঁচা জল, সর্দি ইত্যাদি যখন নিঃসরিত হয় তখন হঠাৎ বেশ আরাম বোধ হয় সাথে ব্যথাও কম মনে হয়। তবে বারংবার আক্রান্ত হয়ে সর্দির ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে জমতে শুরু হলে তা থেকে ভীষণ ব্যথা হয়।
- গ্রীষ্মের সময় সাধারণক প্রকোপ অনেকটা কম থাকে কিন্তু শীতের প্রারম্ভে আবার কষ্ট শুরু হয়। নাকবন্ধ, ব্যথা, কষ্ট, যন্ত্রণা ইত্যাদি বাড়ে।
- ক্রমাগত সর্দি জমে সংক্রমণ যখন সাংঘাতিক বেড়ে যায়, তখন নাকের পেছনের কলা-কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক সময় পুঁচ মস্তিষ্কের গহ্বরে ঢুকে মেনিনজাইটিসের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
- সাইনাস থেকে চোখের নিকটবর্তী টিস্যু সকল স্ফীত হয়ে ওঠে এবং সংক্রমিত হলে ভীষণ ব্যথা-যন্ত্রণা হয়ে চোখ ফুলে ওঠে।
- এই অবস্থায় কোনো রোগীকে পরীক্ষা করতে চাইলে সে বাধা দেয়। কারণ পুঁজ ও সংক্রমণ থেকে এমন তীব্র যন্ত্রণা হয় যে রোগী চিকিৎসকের হাত দেওয়ার সাথে চেঁচিয়ে বা কুঁকিয়ে ওঠে।
- রোগ দিনে দিনে বিস্তার লাভকরে নানা, জটিল অবস্থার সৃষ্টি করে। সূর্যের আলো, তাপ, প্রথম আলোক সজ্জা, বিকট শব্দ রোগী সহ্য করতে পারে না। বহুক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসারও প্রয়োজন হয়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
প্রাথমিক ভাবে এক্স-রে ও রক্তের রুটিন পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এক্স-রে দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় রোগের বাড়-বাড়ন্ত। রক্তে ই.এস.আর-এর বৃদ্ধি ঘটে সাথে ডব্লিউ.বি.সি-ও বেশি লক্ষ্য করা যায়। রোগের জটিলতার ওপর নির্ভর করে আরও কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। যেমন—সি.টি.স্ক্যান, এম.আর.আই, ন্যাজাল সোয়াব ইত্যাদি। অনেক সময় সাইনাস থেকে মেনিনজাইটিস, সেরিব্রাল, অ্যাবসেস, অস্টিওমায়োলাইটিস, অরবিট্যাল সেলুলাইটিস, এপিস্টেকসিস ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।
সাবধানতা
- ঘন ঘন নাক বন্ধ অনেকেই নাকে বারবার ড্রপ দিয়ে আরাম পেতে চায় বা ইনহেলার ব্যবহার করে থাকেন। এতে ক্রমে বিপত্তি বাড়ে। এর চেয়ে ভালো উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ বাঞ্ছনীয়।
- নানা ধরনের খাবার-দাবার বা দ্রব্য থেকে অনেকের অ্যালার্জি হয়, সেক্ষেত্রে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
- প্রতিদিন স্নানের অভ্যাস বজায় রাখা উচিত। সম্ভব হরে সাঁতার কাটা ভালো।
- নাক-মুখ সর্বদা পরিষ্কার রাখা দরকার। নাকের সর্দি কখনও ভেতরে না টেনে বাইরে বের করে ফেলা উচিত।
- নেশা বা বদঅভ্যাস পরিত্যাক করা উচিত। যেমন বিড়ি. সিগারেট, তামাক, জর্দা, মদ্যপান সমস্যা জটিল করে।
- মাঝে মাঝে সম্ভব হলে নাসাপান মানে নাক দিয়ে অল্প পরিষ্কার জল টানতে পারলে নাসারন্ধ্র পরিষ্কার থাকে।
- স্নানের পূর্বে মাঝে মধ্যে নাকের ফুটোয় কনিষ্ঠা আঙুল দ্বার খাটি সরষের তেল স্পর্শ করলে বা লাগালে আরাম হয়। তাতে নাক পরিষ্কার থাকে এবং চট করে বাইরের ধুলোবালি নাকে প্রবেশ করতে পারে না।
- রোজ নিয়ম করে তিন থেকে পাঁচ লিটার জল পান করা ভালো। অতিরিক্ত মিষ্টি বা টক খাওয়া উচিত নয়।
- সময়ে পরিমাণ মতো আহার, প্রখর আলো, বিকট শব্দ থেকে দূরে থাকা এবং অ্যালার্জিক বস্তু, খাবার এবং ঠান্ডা থেকে সতর্ক থাকা উচিত।
- নাক দিয়ে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার অভ্যাস করা দরকার।
ব্যায়াম ও শরীরচর্চা
সাইনাসের চিকিৎসার সাথে ব্যায়ম ও শরীরচর্চা ভীষণ উপকারি। যেমন প্রাণায়াম, কপালভাতি, শীর্ষাসন, শশঙ্গাসন, মৎস্যাসন, অর্ধকুর্মাসন, ভ্রামরী, প্রাতঃভ্রমণ ইত্যাদি অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে চিকিৎসার সুফল সত্ত্বর পাওয়া সম্ভব।
চিকিৎসা
হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে সাইনাসের উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব। রোগটা শুনতে সহজ কিন্তু নিরাময় অত্যন্ত কঠিন। তাই রোগীকে ধৈর্য ধরে চিকিৎসকের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
পুরাতন বা ক্রনিক রোগের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা মায়াজম ভিত্তিক করার নির্দেশ লিপিবদ্ধ আছে। তাই রোগের জটিলতা অনুসারে মায়াজম ভিত্তিক হোমিওপ্যাথিক নিয়মে এক একটি রোগের নানা দিক নির্দেশ করে চিকিৎসায়। যেমন একপাশে রোগ বা ওয়ান সাইডেড ডিজিজ। এক্ষেত্রে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা কম থাকে। তার মধ্যে একপাশে মাথা যন্ত্রণা বা ওয়ান সাইডেড হেডেক একটি রোগ। সাইনাসের ক্ষেত্রে বহুরোগী একপাশে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই সর্বদা উপযুক্ত রোগ লিপি সংগ্রহ করে মায়াজম চিহ্নিত করেই এর চিকিৎসা একমাত্র উপায়। সাথে রোগীর শারীরিক গঠন, জীবন যাপন, চলাফেরা, কাজকর্ম, খাবার পছন্দ-অপছন্দ, অনুভূতি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন-উত্তর সমষ্টি লিপিবদ্ধ করে চিকিৎসা শুরু করতে হয়। হোমিওপ্যাথি ভান্ডারে সহস্রাধিক ওষুধ আছে, কিন্তু নাম উল্লেখ করে বিধান দেওয়া অসম্ভব। কারণ একজন রোগীর ক্ষেত্রে তার শারীরিক গঠন ও মায়াজম নির্দেশ করে এক একটি ওষুধের। তাই সকল রোগীর এক ওষুধ হওয়ার সম্ভব নয়। তবুও কয়েকটা ওষুধ উল্লেখ করা যায় যেগুলো প্রায়াই ব্যবহার হয়। যেমন আর্সেনিক, অরম মেট, হিপার সালফ, ক্যালকেরিয়া, ক্যালি-আয়ড, নেট্রাম মিউর, মার্কসল, ফসফরাস, সালফার, সাইলেসিয়া, সিফিলিনাম, সোরিনাম, মেডোরিনাম, স্যাপোনেরিয়া, পালসেটিলা, আইরস-ভার্স, থুজা ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সাবধান, কখনও দোকান থেকে নিজে ওষুধ কিনে খাবেন না। সব সময় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন