প্যাংক্রিয়াসের ক্যানসারে কালো জিরে চমৎকার
মহুয়া বন্দোপাধ্যায়
2019-02-01 15:46:25
আরম্ভ খুঁজতে গেলে হাজার হাজার বছর অতীতে ফিরতে হবে। পয়গম্বর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে গিয়েছিলেন, ‘এই বীজ শুধুমাত্র মৃত্যুকে জীবন দান করতে পারে না। তার বাইরে আর যেকোনো অসুস্থতা সারিয়ে তুলতে পারে।’ ইসলামি বিশ্বাসে এই বীজের স্থান তাই অনেক ওপরে। মধ্যপ্রাচ্যে এ বীজের নাম রাখা হয়েছে ‘আশীর্বাদ ধন্য বীজ’। আবার এর স্বাস্থ্য এবং ওষধি গুণের ভূয়সী প্রশংসা আছে বাইবেলে। কালো জিরে—রান্না ঘরের বাইরেও যার সারা বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
মিশরের মাটিতে আবার কালো জিরের ইতিহাস অনেক প্রাচীন এবং পাকাপোক্ত। তার নিদর্শন খুঁজে পেয়েছিলে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা, আজ থেকে বহু বছর আগে। মিশরের কিশোর সম্রাট তুতেনখামেনের সমাধিতে মিলেছিল এব শিশি কালো জিরের তেল। সেই সময়কার বিশ্বাস অনুসার সম্রাটের ‘পরজন্মে প্রয়োজন’ ভেবেই তার সমাধিতে রাখা হয়েছিল এই তেল। মিশরের ফারাওদের চিকিৎসকরা অত্যন্ত বিলাসবহুল ভোজের পর সম্রাটের পেট এবং হজম সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যার সমাধানে এই কালো জিরেই যে ব্যবহার করতেন, তার প্রমাণ মিলেছে। এছাড়াও প্রাচীন মিশরে মাথার যন্ত্রণায়, দাঁতের যন্ত্রণায়, ঠান্ডা লাগা, সংক্রমণে এই কালো জিরেই ব্যবহৃত হত ওষুধ হিসেবে। প্রাচীন মিশরের প্রবাদপ্রতিম সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত রানি নেফারতিতি। জানা গেছে, তিনিও তার রূপচর্চায়, বিশেষ করে চুল আর নখের যত্নে ব্যবহার করতেন কালো জিরে। আবার প্রাচীন গ্রিসেও এর ব্যবহার ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। উল্লেখযোগ্য গ্রিক চিকিৎসক ডায়োস্কোরাইডম মাথার যন্ত্রণা এবং দাঁতের যন্ত্রণার চিকিৎসায় কালো জিরে ব্যবহার করতেন বলেও জানা গেছে। সুতরাং ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রাচীন মিশর, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল আর এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে কালো জিরের নানাবিধ ব্যবহার বেশ প্রসিদ্ধ ছিল।
উপাদান
কালো জিরেতেই বোধহয় সঠিক অর্থে বিশ্বের বিস্ময় বলা চলে। ছোট্ট একটা বীজ। অথচ তার মধ্যেই কিনা একশোর বেশি নানাধরনের রাসায়নিক যৌগ, যা মানবশরীরে যে কোনো চমৎকার দেখাতে এককথায় রাজি। যে কোনোও ধরনের ভিটামিন, প্রোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিড, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল মিলবে এতে। আর আছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, কপার, জিষ্ক এবং ফসফরাস।
গবেষণা: ক্যানসার
কিন্তু এত কিছু সত্বেও কালো জিরে নিয়ে বিশদ গবেষণা শুরু হয়েছে মাত্রই বছর চল্লিশেক আগে। তবে একের পর এক গবেষণা হয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি। এখনও অবধি তার সংখ্যা প্রায় একশো ছাড়িয়ে গেছে। গবেষণা হয়েছে মানুষের ওপর, গবেষণা হয়েছে মনুষ্যোতর প্রাণীর ওপর। তবে কালো জিরে নিয়ে সর্বপ্রথম চমকে দেওয়ার মতো গবেষণা হয়েছে ক্যানসারের ওপর এর প্রভাব নিয়ে। দক্ষিণ ক্যারোলিনার হিলটন হেড আইল্যান্ডের গবেষকরা চালিয়েছিলেন গবেষণা। তারা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, কোনো সুস্থ-সবল দেহের সুস্থ-স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্যানসার কোষকে মূলেই বিনষ্ট করতে পারে। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আসলে একটা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় রোগ প্রতিরোধকারী কোষ, বোন-ম্যারো কোষ, বি-কোষ উৎপাদিত হয় পর্যাপ্ত পরিমাণে। এগুলো একযোগে অ্যান্টিবডির জন্ম দেয়। এই অ্যান্টিবডি তৈরিতে কালো জিরের ভূমিকাও খুব উল্লেখযোগ্য। বোন-ম্যারোর ভেতরে বিশেষ ধরনের স্বল্পস্থায়ী রোগ প্রতিরোধক কোষের জন্ম দেয়। যেগুলো স্বল্পস্থায়ী হলেও যে কোনো জীবাণুবাহিত অসুখতে শুরুতেই প্রতিহত করতে পারে। শুধু তাই নয়, ক্যানসার কোষের ছড়িয়ে পড়ার গতিও হ্রাস করে দিতে পারে, তাদের হাত থেকে শরীরের সুস্থ কোষগুলো বাঁচিয়ে। আসলে কালো জিরের ফ্যাটি অ্যাসিডই ক্যানসারের মোক্ষম ওষুধ।
ক্যানসারের কথাই উঠল যখন, আরেক গবেষণার উল্লেখ করা যাক। তবে সে গবেষণা ইদুরদের নিয়ে। জোর করে তাদের দেহে ক্যানসার হওয়ার মতো পর্যাপ্ত উপকরণ ঢুকিয়ে দেওয়ার পর যে ইদুরগুলোকে আগে থেকে কালো জিরের তেল খাওয়ানো হয়েছে, তারা আরও তিরিশ দিন বেশি বেঁচে থাকতে পেরেছে আক্রান্ত অন্য ইদুরদের থেকে।
শরীরগত অন্যান্য সমস্যার সমাধান
- ক্যানসার আর কালো জিরের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। তবে প্যাংক্রিয়াসের ক্যানসারে এই আশ্চর্য চমৎকার ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। এর বাইরে বলা হচ্ছে, প্রাথমিত পর্যায়ে যে কোনো ক্যানসারের ক্ষেত্রেই প্রতিষেধকের ভূমিকা নিতে পারে কালো জিরে।
- কালো জিরের আশ্চর্য ওষধি গুণের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রয়োগ শ্বাসকষ্ট বা গলা-ফুসফুস জনিত যে কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে। হাঁপানি, ব্রষ্কাইটিস বা ঠান্ডা লাগার অব্যর্থ ওষুধ হিসেবে কাজ করে কালো জিরে।
- রিউম্যাটিজম কিংবা অস্থিসন্ধির ফোলা বা ব্যথার বহুলাংশে উপশম ঘটাতে পারে কালো জিরের তেল বা ট্যাবলেট।
- শরীরের যে কোনো জায়গায় টিউমারকে নিয়ন্ত্রণ আনতে এ অব্যর্থ।
- প্রস্রাবের বেগজনিত কোনো সমস্যায় কালো জিরে দারুণ ফলপ্রদ।
- সদ্য প্রসবকারিণী মায়েদের বুকের দুধের জোগান অব্যাহত রাখে কালো জিরে।
- মহিলাদের ঋতুস্রাবজনিত সমস্যার সমাধান করতেও এ সিদ্ধ হস্ত।
- পুরুষদের স্পার্ম কাউন্ট সঠিক রাখতেও এর জুড়ি নেই।
- অ্যালাজি, একজিমা সহ ত্বকের যেকোনো সমস্যায় কাজ করে কালো জিরে।
- কাশির উপশমে অব্যর্থ। কয়েকটা গরম করা কালো জিরে মুখে নিয়ে চিবিয়ে ফেললে ঠান্ডা লাগার থেকে সঙ্গে সঙ্গে আরাম মিলবে। গরম জলে বা গরম চায়ে ভিজিয়ে খেলেও উপকার পাবেন। আবার মধুর সঙ্গে কালো জিরে পাউডার মিশিয়ে খেলেও কাশির থেকে আরাম হবে।
- কপাল আর নাকে ভালো করে কালো জিরের তেল লাগালে অসহ্য মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের হাত থেকে নিস্তার মিলবে।
- গরমজলে কালো জিরের তেল মিশিয়ে সেই মিশ্রণ দিয়ে কুলকুচি করলে দাঁতের যন্ত্রণায় আরাম হয়।
- কালো জিরে হজম বা গ্যাসের যে কোনো সমস্যায় অব্যর্থ কাজ দেয়।
- লো ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে কালো জিরে খুব উপকারী।
- প্রাতরাশের আধঘন্টা আগে মধু দিয়ে কালো জিরে পাউডার রোজ খেতে পারলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। শরীর সুস্থ থাকে।
- কালো জিরে চুল আর নখের সৌন্দর্য বাড়াতে অব্যর্থ। কেউ কালো জিরে তেলকে ক্যাপসুল আকারে খেতে পছন্দ করেন। কেউ বা আবার সরাসরি এই তেল চুলে লাগিয়ে রাখেন কিংবা মুখ-হাত-আঙুল-নখে লাগিয়ে রাখেন। ফল একই।
- কালো জিরে এনার্জি বাড়ায়। সকালে খালি পেটে যে কোনো জ্যুসে কালো জিরে তেল মিশিয়ে রোজ খেলে তফাৎ মিলবে হাতে হাতে।
- স্নানের পর অল্প কালো জিরে তেল আর অল্প অলিভ অয়েল মিশিয়ে মাথায় লাগালে চুল পড়ার সমস্যা থেকে রেহাই মিলবে।
তবে একটা কথা মনে রাখবেন, কাঁচা অবস্থায় কালো জিরে খাবেন না। আগে হয় গরম করে নেবেন, বা গরম জলে ফেলে তারপর খাবেন। তবে কখনোই পঁচিশ গ্রামের বেশি পরিমাণ ব্যবহার করবেন না। আর গর্ভবতী মায়েরা এই তেল ব্যবহার করবেন না। গর্ভপাত ঘটে যেতে পারে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন