রঙের জাদুতে সারবে রোগ
ডঃ শৌর্যেন্দ্রনাথ সরকার
2019-02-01 15:51:08
অসুখ হলে ওষুধ খেতে হবে। আর ওষুধ খেতে হলে ডাক্তারবাবুর পরামর্শমতোই খেতে হবে একথা জানা আছে সকলেরই। কিন্তু যখন ডাক্তারবাবুদের ওষুধপত্রে তেমনভাবে রোগবলাইকে কব্জা করা যায় না তখনই মানুষ দিশেহারা হয়ে খুঁজে বেড়ায় বিকল্প চিকিৎসা। এধরনেরই এক বিকল্প তথা প্রাকৃতিক চিকিৎসার কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা যে নতুন প্রাকৃতিক চিকিৎসার কথা জানাচ্ছেন তা হল ‘অসুখ বা রোগাবালাই সারাতে রঙ’। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘কালার থেরাপি’। অবশ্য রোগবালাই সারাতে কতটা রঙ প্রয়োজন তা ঠিকমতো বুঝে ব্যবহার করলে তবেই জটিল ও কঠিন অসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানুষের শরীর আসলে নানরঙের সমষ্টি। আর এ নীতির ওপর ভরসা করেই দেখা মিলেছে রঙ চিকিৎসার। আমাদের এই বিশাল বিশ্বে প্রত্যেকটি স্পর্শযোগ্য বস্তুই সাতটা রঙের সমন্বয়ে তৈরি। মানুষ গাছপালা, জন্তু-জানোয়ার সবকিছুই বিভিন্ন রঙের সমষ্টি। এই প্রকান্ড বিশ্বও কয়েকটি কসমিক-রে বা মহাজগতিক রশ্মির এক সম্মিলিত অবস্থা।
বিপুলা এ পৃথিবীতে দু’দরনের মহাজাগতিক রশ্মি রয়েছে। এর মধ্যে কতকগুলো দৃশ্যমান আর কতকগুলোতে দেখা যায় না। লাল, নীল, বেগুনি, কমলা, সবুজ ও হলুদ রঙগুলো হল দৃশ্যমান রঙ। আর আমাদের দেখা যায় না সেই অদৃশ্য রঙের তালিকায় রয়েছে আলট্রাভায়োলেট ও ইনফা রেড।
বিজ্ঞানীরা বিস্তর গবেষণায় দেখেছেন যে, মানুষের দেহে কোনো একটি রঙের অভাব হলে তার শরীর ও মনে দেখা দেয় হাজারো রোগবালাই। আর শরীরে এই রঙের অভাব পূরণ করলেই নাকি রোগবালাই শরীর ছেড়ে পালাতে পথ পায় না। আর এটাই হল রঙদাওয়াইয়েল গোপন চাবিকাঠি।
অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক সব থেরাপি যখন শেষ এবং কোনো একজন রোগী যখন শুধুমাত্র ভরসা করে সিমপ্যাথির ওপর, তখন রঙ ব্যবহার করেই রোগীকে পুরোপুরিভাবে সুস্থ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দৃশ্যআলোকে ভাঙলে পাওয়া যায় সাতটা রঙ। তরঙ্গদৈর্ঘ অনুসারে ছোট থেকে বড় হিসেবে পরপর সাজালে আলোর রঙগুলো হল বেগুনি, নীল, আকশী, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লাল। বর্ণালির দুপ্রান্তে যে রঙ দু’টো রয়েছে তা হল বেগুনী আর গাড় লাল।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে মানুষের মনের ওপরও রঙের প্রভাব বেশ ভালোই। জমকালো রঙ শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনা বাড়ায় আর হালকা রঙের ছোঁয়ায় মন শান্ত হয় এবং মনের ওপর চাপও কম পড়ে। বর্ণালির সাতটা বিশুদ্ধ রঙ যে কোনো মিশ্র রঙের তুলনায় বেশি উজ্জল হবার জন্য আমাদের চোখ ও মনের পক্ষে এগুলো আরামপ্রদ। আর স্নায়ুকে শিথিল করার জন্যও এগুলো খুবই ফলপ্রদ।
একেক দেশের মানুষের কাছে রঙের একেক রকম তাৎপর্য। আবেগের রঙ যদি হয় লাল আর বিচক্ষণতার রঙ যদি হয় হলুদ তাহলে কমলা হল আবেগ আর বিচক্ষণতার মধ্যে ভারসাম্যতার রঙ। কমলা হল আগুনের রঙ আর এটা সহিষ্ণতা, শক্তি এবং আশার প্রতীক। মনোবিদদের মতে নীল রঙ হল দুঃখ আর অবসাদের রঙ। সবুজ রঙ চোখের পক্ষে আরামদায়ক। কালো রঙ সম্মান ও সরচির প্রতীক ঠিকই তবে ভয়, মৃত্যু, শোক বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। কারও কাছে এটি অশুভ রঙ বলেও আখ্যা পায়। সাদা রঙকে ধরা হয় শুদ্ধতা ও সারল্যের প্রতীক হিসেবে। লাল রঙকে আগুন, উষ্ণতা ও রাগের প্রতীক হিসেবেও ধরা হয়। ভালোবাসা এবং শারীরিক আকর্ষণ বোঝাতেও শিল্পীরা লাল রঙকে ব্যবহার করে থাকেন।
বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, লাল রঙ স্নায়ুকে উজ্জবীত করে এবং রঙ ও সংবহনতন্ত্রের উন্নতি ঘটায়। এ রঙের প্রভাবে শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। যকৃতকে সুস্থ করে এবং বামমস্তিষ্কের কাজের উন্নতি ঘটায়। সবুজ রঙ পেশি ও হাড়কে শক্তপোক্ত করে। মনকে ও শান্ত করে। এ রঙের প্রভাবে যৌনআকাঙক্ষা ও ক্ষমতা বাড়ে। ম্যালেরিয়া, আলসার,সিফিলিস, অর্শও এ রঙের প্রভাবে সেরে যায়। অনিদ্রার মহৌষধ হিসেবেও এ রঙ ব্যবহার হয়।
দুর্বল প্লীহার চিকিৎসায় আদর্শ রঙ হল হলুদ। বিষণ্ণতা রোগে এই রঙ উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। লিভারের নানা দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ. মধুমেহ, বাত এমনই নানা রোগের উল্লেখযোগ্য দাওয়াই হিসেবে ব্যবহৃত হয় হলুদ রঙ।
ম্যাজেন্ডা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে সক্রিয় ও চনমনে করে। অস্থির মানুষকে শান্ত করে এ রঙ। বেগুনি রঙ মানুষের আত্মমর্যাদা বাড়ায়। রক্তে লিউকোসাইট তৈরি হতে সাহায্য করে। স্নায়ুর নানা রোগ, বাত, বৃক্ক বা কিডনির নানা অসুখ সারে এ রঙের প্রভাবে।
নীলরঙ জীবনীশক্তি বাড়ায়। রোগীকে ঘুম পাড়াতে এবং রক্তচাপ বাড়াতে খুব ভালো কাজ দেয় এ রঙ। নিয়মিত নীল রঙের ছোঁয়ায় ক্যানসার দেখা দেবার সম্ভাবনা কমে। স্নায়বিক উত্তেজনা, ডিপ্রেশন বা অবসাদ সারায় নীলরঙ। মেয়েদের ঋতুজনিত সমস্যা, আলসার, বুক ধড়ফড়ানি বা প্যালপিটেশন ও বমি ঠেকাতে দারুন বা উল্লেখযোগ্য ফল দেয় নীল রঙ।
ইন্ডিগো রঙ রক্তকে শোধন করে। ঋতুকালীন সমস্যায় অতিরিক্ত রক্তস্রাব ঠেকাতে পারে এ রঙ। আপেন্ডিসাইটিস, ব্রষ্কাইটিস, ডিসপেপসিয়া, নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ এবং আংশিক পক্ষাঘাতের চিকিৎসাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।
মস্তিষ্ককে দারুণভাবে চনমনে করে তোলে। লেমন রঙ। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের চোখে তাই এ রঙ হল সেরিব্রাল স্টিমুলান্ট। হলুদ আর সবুজ রঙ মেশালে তৈরি হয় লেমন। অ্যাডিসের সমস্যায় বেশি ভুগলে তাদের চিকিৎসার জন্য লেমন রঙ হল আদর্শ রঙ। যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুখ বা ক্রনিক রোগ সারাতেও এ রঙ ভালোরকম সাড়া দেয়।
লাল ও নীল রঙের সমন্বয়ে তৈরি হয় পার্পল। এ রঙের প্রয়োগে বৃক্ক বা কিডনি সুস্থ হয় এবং যৌনক্ষমতা বাড়ে। কামশীতলতা বা ফ্রিজিটিতে যেসব মহিলারা ভোগেন তারা এ রঙের প্রভাবে সুস্থ হন। এছাড়া যেকোনো স্ত্রীঅঙ্গ জনিত রোগবালাই সারাতে এ রঙের প্রভাব যথেষ্ট।
লাল ও হলুত রঙের মিশ্রণে তৈরি হয় কমলা রঙ। এ রঙের প্রভাবে থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ ভালো হয়। মায়ের বুকের দুধেরও যোগান বাড়ে এ রেঙর প্রভাবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পিত্তপাথুরি, মানসিক অবসাদ এবং টিউমারও নাকি ভালোভাবে সারে এ রঙের প্রভাবে।
শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় আবার অতিবেগুরি রশ্মি বা আলট্রা ভায়োলেট রে। ব্যথাবেদনা কমাতে এবং ঘুম পাড়ানিয়া হিসেবেও আলট্রাভায়োলেট রঙের সুনাম বেশ ভালোই।
সবশেষে বলি, বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণীর কথা। তাদের মতে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কালার থেরাপিস্টের মতামত মতোই রঙ দিয়ে চিকিৎসা করা উচিত। কখনোই নিজের ইচ্ছেমতো রঙ দিয়ে চিকিৎসা করাবেন না। কেননা ভুল পদক্ষেপে জীবন নিয়ে টানাটানি হতে পারে কোনো একজন রোগীর। তাই ডাক্তারের সুচিন্তিত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই এই থেরাপি প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আসবে শতকরা একশো ভাগ সাফল্য, নতুবা নয়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন