রাগ থেকে রোগ হতে পারে দুর্ভোগ
বি.কে. রোশনী
2019-02-01 15:54:04
যতই পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, শারীরিবক সমস্যা বাড়ছে ততই মানসিক ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে বিতৃষ্ণা, অসহিষ্ণুতা, বিরক্তি ইত্যাদি। আর এই সব প্রতিদিন জন্ম দিচ্ছে ক্ষোভ ও বিক্ষোভের। যখন তা লিমিট ছাড়িয়ে যায় তখন রাগ ওঠে। প্রথমে মুড অফ, বিরক্তিভাব, ভালো না লাগার টেনডেন্সি গ্রো করে পরে তা রাগ বা ক্রোধে রূপান্তরিত হয়। এই রাগ ঘন ঘন হতে থাকলে বা নিজের কনট্রোলে না থাকলে মন-মানসিকতা যেমন অসুস্থ হয়ে যায় তেমনি শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। এই শারীরিক সমস্যা প্রথমে সাধারণ মনে হলেও পরে ধীরে ধীরে তা গভীর অসুস্থতার দিকে নিয়ে যায়। অনেকে এই রাগকে প্রশমিত করার জন্য নেশার হাত ধরেন বা অন্য পথ গ্রহণ করেন। এতে আরও ক্ষতি হয়ে যায়।
রাগ কেন হয়
রাগ হল এক ধরনের মানসিক আবেগ। সাধারণত যখন কোনো চাহিদা, ইচ্ছে অথবা প্রাপ্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়, কোনো আঘাত বা প্রত্যাঘাত আসে, অপমান-ঘৃণা-নেতিবাচকতা ও ব্যর্থ চিন্তা মনকে ভারাক্রান্ত করে তখন রাগ হয়ে থাকে। ভয়, রোগের কষ্ট, অনাদর, মানিয়ে চলার সম্যা ইত্যাদি কারণেও রাগ হয়। এছাড়াও বহু কারণ আছে, তবে প্রকৃত অর্থে যিনি রাগ করেন তিনিই বলতে পারবেন তার রাগের উৎস কোথায়।
কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক মনে করেন, দিনে তিন-চারবার রাগ করা, বিরক্ত হওয়া, ক্রুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। আবার গবেষকগণ মনে করেন যে সব ব্যক্তি সুস্থ-সবল তাদের রাগ কম হয় আর যারা দুর্বল বা অসুস্থ তারা যেকোনো অবস্থায় অতি অল্পতেই রেগে যান।
রাগ কেউ সচেতনভাবে করে থাকেন আবার কেউ অবচেতন অবস্থায়। প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে যা অতিক্রম হলেই রাগের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ শুরু হয়।
দীর্ঘ অভিজ্ঞাতা ও গবেষণায় জানা গেছে যে, মন আছে শুধু নয়, আজকের দিনে এত অসুস্থতার বা মানসিক সমস্যায় মূলে হল মন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে আমাদের শারীরিক রোগের ৮৫-৯০ শতাংশ কারণ হল মন। মন রোগ বাড়ায়, মন রোগ সারাতে সাহায্য করে থাকে। যেহেতু মন এক মেটাফিজিক্যাল বস্তু তাই তাকে দেখা বা স্পর্শ করা যায় না কিন্তু তা যখন দেহের ওপর ক্রিয়া শুরু করে তখন বোঝা যায় মন আছে। যেমন, খুশি হলে, সুখি থাকলে, দুঃখ হলে, রাগ আসলে, দুশ্চিন্তা শুরু হলে শরীরের ওপর তার যে প্রভাব পড়ে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
সাধারণত প্রতিকূল পরিবেশে মস্তিষ্কে ক্যাটেকোলামাইন নামক এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরিত হয়। এরে থেকে শরীরের বিভিন্ন কোষে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি উৎপন্ন হয়ে থাকে। রাগের জন্য বা উত্তেজনার জন্য যে সমস্ত অসংলগ্ন কথা বা কাজ করা হয় তার মূলে হল এই এনার্জি। এই সময়ে সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রের কাজ বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্লাডপ্রেসা, হার্টরেট এবং রেসপিরেশন রেট বৃদ্ধি পায়। মুখ ও হাত-পা লাল হয়ে যায়। অনেকে এত রেগে যান যে নিজের ওপরই অত্যাচার করতে থাকেন। ভাঙচুর করেন। অন্যকেও নানান ধরনের অত্যাচার করে আনন্দ পান। বিভিন্ন বিকৃত ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন।
রাগের নানান প্রকার ধরন আছে। যেমন, খিটখিটে মেজাজ, গম্ভীরতা, কথায় কথায় উত্তেজিত হওয়া, বিরক্ত হওয়া, অসন্তুষ্টতা ইত্যাদি। এগুলো রাগের অংশ-বংশ। কম হোক বা বেশি, রাগ তো রাগই। এর থেকে উৎপন্ন হয় নানান সমস্যা।
- শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ ত্বরান্বিত হয়, আয়ু কম হয়ে যায়।
- হাত-পা সহ সমগ্র দেহ কাঁপাতে থাকে।
- গরমবোধ হয়, অতিরিক্ত ঘাম হয়।
- সহসা অ্যাড্রিনাল হরমোনের প্রভাবে শক্তি বেড়ে যায়।
- মাথাব্যথা শুরু হয়।
- অনিদ্রা রোগ দেখা দেয়।
- ডিপ্রেশন শুরু হয়ে যায়।
- রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়।
- শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়।
- হজমের সমস্যা দেখা দেয়।
- হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
- স্ট্রোকও হতে পারে।
- নার্ভের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- আর্থ্রাইটিসের সমস্যা আসতে পারে।
এই প্রসঙ্গে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বৈজ্ঞানিকের গবেষণা থেকে কিছু তথ্য জানা গেছে, যা বেশ ভাবনার বিষয়। তথ্যগুলো এইরকম—
- দেহে কর্টিসোল নামক স্ট্রেস হরমোনের সিক্রিয়েশন হয় যা থেকে হার্ট রেট, ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। রক্তে শর্করা ডিসব্যালেন্স হয়ে যায়।
- এই হরমোন থাইরয়েডের হরমোনের কাজে বাধা দেয়।
- বোন ডেনসিটি কমিয়ে দেয়, আর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
- যাদের রাগ বেশি তাদের অ্যাজমা ও স্কিন ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ভীষণ রেগে গেলে মেটাবলিজমকে প্রভাবিত করে।
- পরোক্ষভাবে দেহের ওজন বৃদ্ধি করে।
- অ্যাসিডিটির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, আলসার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
- দীর্ঘদিন রাগ জমিয়ে রাখলে অবসাদ ও উগ্রভাবের সৃষ্টি হয়।
- গর্ভাবস্থায় রাগ প্রশমিত না করতে পারলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির সম্ভাবনা থাকে।
এত সব জানার পর এখন কী কী করনীয়, তা অবশ্যই জানা দরকার। ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছু কথা এখানে বলা হচ্ছে, যা উপকারে আসবে। যদি ইতিবাচক মন নিয়ে রাগকে কনট্রোল না করা যায় তাহলে বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।
- রাগ উঠলে অনুলোম-বিলোম প্রাণায়াম করতে হবে।
- রাগ উঠলে জল খাবেন, রাগ কমবে।
- আয়নায় নিজের মুখ দেখুন, রাগ কমে যাবে।
- গান গাইতে শুরু করুন, যেমনই গলা হোক না কেন।
- জোরে জোরে হাসবেন, হাঃ হাঃ—হিঃ হিঃ। রাগ কমে যাবে।
- রোজ তুলসিপাতা খাবেন, কাজে লাগবে।
- অতিরিক্ত গরম, মশলুযুক্ত খাদ্য, চা-কফি-নেশার সামগ্রী এড়িয়ে চলবেন।
- নেতিবাচক ও ব্যর্থ চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার প্রয়াস নিতে হবে।
- সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভুল বোঝাবুঝিকে কনট্রোল করা দরকার।
- ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়ার বিকল্প নেই। রাগ হবেই না।
- রাগকে সামলানোর সেরা উপায় হল, যে মানুষটা বা ঘটনাটা রাগ উৎপত্তি করায় তাকে বা তার চিন্তাটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া।
- রাগ উঠলে নামতা শুরু করুন। একে এক্কে এক/দুই এক্ক দুই।
- ঠান্ডা জলের ঝাপটা চোখে, মুখে, ঘাড়ে দিয়ে দেখুন, উপকৃত হবেন।
- রাগ উঠলে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসুন, রাগ জল হয়ে যাবে।
ওপরোক্ত সব ব্যবস্থাই সাময়িক। স্থায়ী ব্যবস্থা হল, মেডিটেশন বা ধ্যানের সাহায্য নেওয়া। রাগ কমাতে, রাগকে প্রশমিত করতে, শরীরে-মন সুস্থ রাখতে, মনকে খুশিতে ভরিয়ে রাখতে মেডিটেশনের বিকল্প নেই। দক্ষতার সঙ্গে বেশ কিছুদিন মেডিটেশন করলে মন শান্ত হয়ে যাবে, রাগ করা ভুলে যাবেন। চেতনা ও অবচেতনা মনকে সংযত রাখার জন্য ধ্যানের অভ্যাস দরকার। কিছুদিন অভ্যাস করলে মেডিটেশন করার ইচ্ছা প্রবল হবে, ফলে চলতে-ফিরতে বা যেকোনো সময়ে মেডিটেশন করতে পারবেন। এর কোনো নিয়ম নেই। খুবই সহজ-সরল পদ্ধতি যা নিখরচায় রাগকে তালাক দিতে সাহায্য করবে।
কর্মক্ষমতা বাড়াতে, শান্তি-আনন্দময় জীবন পেতে, সুস্থ জীবনে চলে দীর্ঘায়ু হতে রোজ সকাল-বিকেল কুড়ি মিনিট করে মেডিটেশন করতে থাকুন। সুফল পাবেনই। প্রচার অর্থ খরচ করে, হাসপাতাল-ডাক্তারবাবুর কাছে না দৌড়ে নিজেই চেষ্টা করে দেখুন, কেমন ভালো ফল পান, না হলে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেবেন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন