ব্লাডসুগার টেস্ট কভি বেশি, কভি কম
ডাঃ তনুপ্রিয়া হাজরা
2019-02-06 12:02:57
হাস্যকর লাগছে তো ? লাগারই কথা। ব্লাড সুগারের রক্ত পরীক্ষা, তা নিয়ে এত কথার কী আছে! আছে, কারণ এই সামান্য জিনিসটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল হয়ে যায় এবং এই পরীক্ষঅ পদ্ধতির রকমফেরের কারণেই ওঠা-নামা করে আপনার ব্লাডসুগার লেভেল, যা আপনার এবং আপনার চিকিৎসকেরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে।
ডায়াবেটিস রোগটির মতো তার রক্ত পরীক্ষাও নির্ভর করে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ওপর। খাওয়া-দাওয়া নির্বিশেষে আমরা যে পরীক্ষা করে থাকি তাকে বলা হয় র্যানডাম ব্লাডসুগার (আর.বি.এস)। ডায়াবেটিস নেই এমন ব্যক্তির আর.বি.এস যদি ২০০ এম.জি/ডি.এল বা তার বেশি হয় তাকে ডায়াবেটিস আছে এবং তার চিকিৎসা চলছে এমন ব্যক্তির আর.বি.এস-এর কোনো তাৎপর্য নেই কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া। আর.বি.এস-এর ওপর ভিত্তি করে আপনার চিকিৎসার হেরফের করাও সম্ভব নয়। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে তিনটি ব্লাড সুগার পরীক্ষা প্রয়োজনীয়। যেগুলো হল ফাস্টিং ব্লাডসুগার (এফ.বি.এস) অর্থাৎ খালি পেটে, পোস্ট প্রানডিয়াল ব্লাড সুগার (পি.পি.বি.এস) অর্থাৎ খাওয়ার পর এবং গ্লাই কোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন HbA1c যেটা কিনা আপনার গত তিন মাসের ব্লাডসুগার-এর মাত্রা সফিকভাবে নির্ণয় করে।
ফাস্টিং ব্লাডসুগার-এই পরীক্ষাটিতে সাধারণত সবাই উতরে যান। আট থেকে দশ ঘন্টা খালি পেটে থাকার পর এই পরীক্ষা হয়। দিনের বেলা না খেয়ে থাকা সম্ভবপর নয় বলেই এই পরীক্ষাটি সারা রাতের উপোসের পর হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে অন্যান্য দিনের মতোই যেন থাকে রাতের মেনু। বিয়েবাড়ির ভোজ খেয়ে পরদিন সকালে রক্ত পরীক্ষা বাঞ্ছনীয় নয়। এবংরাতের নির্দিষ্ট ওষুধ কিংভা ইনসুলিন যেন বাদ না যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীরা বাড়িতে বসেই এই পরীক্ষাটি করান। কিন্তু রক্ত সংগ্রহ করবেন যে ব্যক্তি তাকে অনুরোধ করুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন এসে আপনার রক্তটি নিয়ে যান। কারণ ডায়াবেটিক রোগীর পক্ষে সকালে উঠে বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকা বাঞ্চনীয় নয়। মনে রাখবেন এই পরীক্ষার আগে কোনো ওষুধ এবং শারীরিক ব্যায়াম চলবে না। শুধুমাত্রজল পান করা যেতে পারে। অনেক চা-কে জলের সমগোত্রীয় ভেবে চা পান করে থাকেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু আপনার এফ.বি.এস সঠিক আসবে না। কিংভা যদি আপনি বেশ খানিকটা হেঁটে বা দৌড়বার পর রক্ত দেন সেক্ষেত্রেও এফ.বি.এস সঠিক হবে না কারণ তাৎক্ষণিক ব্যায়াম আপনার এফ.বি.এস কমিয়ে দেবে।
পোস্ট প্রানডিয়াল ব্লাডসুগার—পরীক্ষাটি হয় সাধারণত খাবার দু’ঘন্টা পর। কিন্তু কী খেয়ে ? কখন খেয়ে ? কীসের দু’ঘন্টা ? খাওয়ার শুরু না শেষের ? খাবার প্রথম গ্রাসটি মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের ভিতরে গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সুতরাং খাওয়া শুরুর সময়টিকেই আমাদের ধার্য করতে হবে, খাওয়ার শেষের সময়টি নয়। এবার প্রশ্ন হল, কী খেয়ে পরীক্ষা হবে ?
‘ক’ বাবু পরীক্ষার দু’দিন আগে থেকেই সব ওষুধপত্র বন্ধ করে দেন। তার বক্তব্য, দেখি না ওষুধ না খেয়ে সুগার কেমন থাকে!
‘খ’ বাবু পরীক্ষার ক’দিন আগে থেকেই মিষ্টি খাওয়া শুরু করে দেন। এটাও তার একটি অভিনব এক্সপেরিমেন্ট।
‘গ’বাবু সকাল আটটা কিংবা ন’টায় এফ.বি.এস-এর জন্য রক্ত দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়ে পি.পি.বি.এস-এর জন্য রক্ত দিয়ে থাকেন।
‘ঘ’বাবু সকালে রক্ত দিয়ে জলখাবার খান সাত তাড়াতাড়ি। তার কিছুক্ষণ পরই মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন এবং নিয়মমতো দু’ঘন্টা পর পি.পি.বি.এস-এর জন্য রক্ত দিয়ে অফিস চলে যান নিশ্চিন্তে।
প্রসঙ্গত জানাই, এই চার বুবুই কিন্তু ভুল পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা করালেন।
‘ক’বাবু বিনা ওষুধে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে কী দেখতে চাইলেন কে জানে ! আমরা চিকিৎসাকালীন রক্ত পরীক্ষা করাই এটা দেখার জন্য যে আমরা যে ওষুধ খাচ্ছি বা যে পরিমাণ ইনসুলিন নিচ্ছি তা নিয়ে আমাদের ব্লাডসুগার সঠিক নিয়ন্ত্রণে থাকছে কি না। ‘ক’ বাবুর পি.পি.বি.এস অবধারিতভাবে বেশি আসবে কিন্তু সেই রেজাল্ট দেখে বোঝা যাবে না ওষুধ না খাওয়ার জন্য ব্লাডসুগার বাড়ল নাকি ওষুধের ডোজ পর্যাপ্ত না হওয়ার জন্য বাড়ল। এবং এত সাতপাঁচ না ভেবে যদি সরাসরি পি.পি.বি.এস-এর মাত্রা দেখে ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়, পরবর্তীকালে ব্লাডসুগার বেশি মাত্রায় কমে যাওয়ার আশষ্কাও থাকবে।
‘খ’বাবু-ও যথেষ্ঠ মিষ্টি খেয়ে সেই একই ভুল করলেন।
‘গ’বাবু প্রতিদিন জলখাবার খান ন’টা নাগাদ আর লাঞ্চ সারেন দুপুর একটার মধ্যে। অথচ সেদিন সাতসকালেই ভাত খেয়ে রক্ত পরীক্ষা করালেন। কিন্তু রক্ত পরীক্ষার উদ্দেশ্য হল অন্যান্য দিনের মতো সেদিন অর্থাৎ সাধারণ একটি দিনে আপনার ব্লাযসুগারের মাত্রা কতটা থাকে সেটা দেখা। সুতরাং অন্যান্য দিন আপনি যে সময়ে যা যা খান, পরীক্ষার দিন সেই একই সময়ে একই ধরনের খাবার খেয়ে ব্লাডসুগার পরীক্ষা করতে হবে। রোজ যদি আপনি একটা বা দু’টোয় ভাত খান সেদিনও তাই খাবেন। যদি রক্ত সংগ্রহকারী দেরির কারণে রক্ত নিতে অনিচ্ছুক হন সেক্ষেত্রে আপনি জলখাবার।
‘ঘ’বাবুও সেদিন তাই করলেন যা অন্যান্য দিন করেন না। জলখাবার খাবার পরেই দুপুরের খাওয়া সারলেন। পরপর দুটো মেজর মিল খাওয়ায় গ্লাইসেমিক লোড বাড়বেই এবং যথাক্রমে পি.পি.বি.এস-এর মাত্রাও বাড়বে। আর এত প্রশ্ন না করে যদি বর্ধিত ব্লাডসুগারের রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু আপনার ওষুধ বা ইনসুলিন-এর মাত্রা বাড়ান তাহলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (হঠাৎ করে ব্লাডসুগার ফল করে যাওয়া)-র শিকার হবেন আপনি।
অতএব, আপনি নিশ্চয়ই ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’বুবুর মতো ভুল পন্থাবলম্বী হবেন না। মনে রাখবেন হঠাৎ করে কোনো টেনশন বা মানসিক চাপের পরিস্থিতি এসে পড়লে তার মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করাবেন না। কারণ টেনশন সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যদি অফিস ট্যুর কিংবা ছুটি কাটাতে বাইরে যান এবং সেখাসে খাওয়া-দাওয়া, ওষুধপত্রের অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে বাড়ি ফেরার পরে নিয়মমাফিক রোজকার রুটিন-এ ফিরে এসে তারপরেই রক্ত পরীক্ষঅ করাবেন।
HbA1c-ব্যয়সাপেক্ষ এই পরীক্ষাটির সঙ্গে খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই অর্থাৎ খালি কিংবা ভরাপেটে যখন খুশি এটি করা যায়। বিগত তিনমাসের ব্লাডসুগারের মাত্রা সঠিক ভাবে জানান দেয় রক্তের HbA1c এবং অন্য দুটো পরীক্ষার মতো এই পরীক্ষাটিতে কোনোভাবেই কারচুপি করা যায় না। তাৎক্ষণিক খাওয়া কমিয়ে কিংবা ব্যায়াম করে HbA1c হেরফের করা যায় না। সারা বছর চারবার, সম্ভব না হলে অন্তত দু’ থেকে তিনবার এই পরীক্ষাটি করানো দরকার।
সবশেষে বলি, আপনার রক্ত পরীক্ষার জন্য শুধুমাত্র ল্যাবরেটরির সুবিধের জন্য আপনার রোজকার রুটিন বদলাবার প্রয়োজন নেই। দরকার হলে অন্য ল্যাবরেটরির দ্বারস্থ হোন। ব্লাডসুগারের টেস্ট খুবই সাধরণ টেস্ট। এটার জন্য নামিদামি ল্যাবরেটরিতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার প্রয়োজন নেই। আপনার পাড়ার ছোটখাটো ল্যাবরেটরিতেই স্বচ্চন্দে এই পরীক্ষা করাতে পারেন। কিন্তু আপনি চলবেন আপনার রুটিন মতো, আপনার সময়মতো, ওদের মর্জি মাফিক নয়।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন