ডায়াবেটিসের হাত ধরে আসে স্নায়ুরোগ
ডাঃ অমিত হালদার
2019-02-06 12:24:00
ডায়াবেটিস মেলিটাস ও স্নায়ুরোগ- মাঝে মাঝেই আমরা এই দুই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এই ডায়াবেটিক স্নায়ুরোগ হয় ? কী করে হয় ? কীভাবে তা নির্ণয় করা যায়? এই রোগের কি কোনো চিকিৎসা আছে ?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রচেষ্টার পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে প্রায় ৬৬ শতাংশ ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিক রোগীদের স্নায়ুরোগ আছে। যারা ইনসুলিন নির্ভর নন তাদের মধ্যেও প্রায় ৫৯ শতাংশেরই এই রোগ আছে। তবে ডায়াবেটিসের শুরুতে এই স্নায়ুরোগ হয় না।
পা ঝিমঝিম বা অবশ হয়ে যাওয়া এই রোগের প্রথম লক্ষণ। যেহেতু লম্বা স্নায়ুগুলো আগে আক্রান্ত হয়, তাই পা থেকে এই রোগের শুরু। পরে অবম্য হাতও আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত এই রোগ দুটো পা বা দুটো হাত প্রায় একই সময়ে আক্রান্ত হয়। কিন্তু তার মানে সব ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি একরকম, তা নয়। মোটা স্নায়গুলো জখম হলে যেমন পা অবশ হয়, ছোট স্নায়ু আক্রান্ত হলে পা জ্বালা করতে থাকে। নষ্ট হয়ে যায় ঠান্ডা আর গরম বোঝার অনুভূতি। পা বা হাতের আঙুল সহজেই পুড়ে যায়, তৈরি হয় ঘা।
কিন্তু মোটর নার্ভ আক্রান্ত হলে পায়ের পেশিগুলো হয়ে যায় শিথিল। চলতে গেলে হোঁচট লাগে বা পা থেকে বেরিয়ে আসে চটি। রোগ বাড়তে থাকলে পরে হাঁটা-চলারও সমস্যা দেখা দেয়।
ডায়াবেটিস রক্তনালীকে সরু করে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রোটিন ও পলিওল জমে নার্ভের ক্ষতি করে। রক্তে শর্করার মাত্রা যত বেশি হবে এবং বেশিক্ষণ থাকবে, ততই বাড়বে স্নায়ুরোগের সম্ভাবনা।
কিন্তু এই রোগ নির্ণয় করবেন কী করে ? একজন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ রোগীর উপসর্গ শুনে এবং রোগীকে পরীক্ষা করে এই রোগ নির্ণয় করতে পারেন। কারেন্টের সাহায্যে নার্ভ টেস্ট করেও এই রোগ নির্ণয় করা হয়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি/নার্ভ কনডাকশন স্টাডি (ই.এম.জি/এস.সি.এস)। এছাড়াও মোনোফিলামেন্ট দিয়ে পায়ের অনুভূতি পরীক্ষা করা হয়।
হাত-পায়ের নার্ভ ছাড়াও ডায়াবেটিস শরীরের অন্য নার্ভকে জখম করতে পারে। অটোমেটিক নার্ভাস সিস্টেম আক্রান্ত হলে কিন্তু রোগীরা অন্য উপসর্গ নিয়ে আসে। কেউ বা দাঁড়িয়ে থাকলে চোখে অন্ধকার দেখে, কারোর হয় বমি বমি ভাব। কারোর কারোর চলে যায় প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা। এছাড়া পুরুষদের মধ্যে যৌন অক্ষমতা এক প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
করোটি সংক্রান্ত স্নায়ু বা ক্রেনিয়াল নার্ভসও মাঝেমাঝে আক্রান্ত হয়। তখন চোখের পেশিগুলো শিথিল হয়ে আসে। কেউ বা চোখে দুটো দেখে, কারোর বা বেঁকে যায় মুখ।
তাহলে এত রকম বিবিধ লক্ষণের উপশম কী করে সম্ভব ? মনে রাখতে হবে যে ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’। তাই ডায়াবেটিস ঠিকমতো শুরুতেই নির্ণয় করে তার চিকিৎসা করালে স্নায়ুরোগ হয় না। এর সঙ্গে দরকার ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রণ রাখা। মদ বা সিগারেট এড়িয়ে চলা। ভিটামিনের অভাব হলেও স্নায়ুরোগ বাড়তে পারে।
কিন্তু স্নায়ুরোগ হয়ে গেলে তা কিন্তু পুরো ঠিক করা ভীষণ কঠিন। তখন চিকিৎসা হয় মূলত উপসর্গ অনুযায়ী। হাত বা পা ঝিনঝিন বা জ্বালার জন্য বিভিন্ন ওষুধ আছে। যেমন ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেশন, এস.এস.এন.আর.আই, অ্যান্টি এপিলেপ্টিক এবং কিছু লোকাল অয়েন্টমেন্ট এই ধরনের জ্বালা কমায়। কিন্তু একজন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে তবেই এই ওষুধগুলো শুরু করা উচিত। অটোনমিক নার্ভ জখম হলে তার চিকিৎসা কিন্তু অন্য।
তবে সবচেয়ে আগে দরকার শিক্ষা। রোগ সম্পর্কে শিক্ষা। পায়ের যত্ন নিতে শেখা। ঢাকা জুতো পরা। পায়ে ঘা হলে তাকে অবেহেলা না করা। বুঝতে হবে যে, স্নায়ুরোগ হল ডায়াবেটিসের সবচেয়ে কমন জটিলতা। রক্তে শর্করার মাত্রা কমালে এই রোগের সম্ভাবনাও কমবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন