ডায়াবেটিসে সঠিক রক্ত পরীক্ষা খুবই জরুরি
সঞ্জীব আচার্য (চেয়ারম্যান, সেরাম থ্যালাসেমিয়া প্রিভেনশন ফেডারেশন)
2019-02-06 12:50:32
কোনো ডায়াবেটিক রোগীর সুগার সংক্রান্ত ব্লাড বা ইউরিনের টেস্ট রিপোর্ট সঠিক না হলে বহুমুখী বিপদের মোকাবিলা করতে হয় রোগীকে। মূলত চিকিৎসক যদি সেই ভুল রিপোর্টকে ভিত্তি করে চিকিৎসা শুরু করে, তাহলে রোগীর ব্যাধি নিরাময় হওয়া তো দুর অস্ত, জটিলতা বাড়তেই থাকবে। সর্বাগ্রে বুঝে নিতে হবে ডায়াবেটিসের উৎসটা কী, উপসর্গের রকমফের। এই রোগে ক্ষেত্রবিশেষে যেসব ওষুধ নিতে হয়, তা সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা রাখার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে।
ডায়াবেটিস আক্রান্তদের প্রথমেই জানতে হবে, এই রোগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ইনসুলিন হরমোন অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হয়। ইনসুলিনের কাজ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা প্রতিনিয়ত যে সব খাদ্যগ্রহণ করে থাকি, তার অধিকাংশই শর্করা জাতীয়। সেই খাদ্য অন্ত্রে প্রবেশ করে গ্লুকোজে পরিণত হয়। সেই গ্লুকোজ সহজেই রক্তে মিশে যায়। রক্তে মিশ্রিত গ্লুকোজের মাত্রা ১৪০ এম.জি%-এর ওপরে পৌঁছলেই প্যাংক্রিয়াম থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন সেটাকে নিচে নামিয়ে আনতে সাহায্য করে। খাবারের সঙ্গে যেমন ইনসুলিন নিঃসৃত হয়, তেমনি সারাদিন ধরে অল্প অল্প পরিমাণেও ইনসুলিন নিঃসারিত হতে থাকে। এই ইনসুলিনকে বলা হয় ব্যাসাল ইনসুলিন। খাওয়ার পর যে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়, তাকে বলা হয় প্রানডিয়াল ইনসুলিন। পাশাপাশি এটা মনে রাখতে হবে, শরীরে মেদের পরিমাণ বেশি থাকলে ইনসুলিন কাজ করতে বাধা পায়। যেটাকে বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
তাহলে আমরা তিনটে ইনসুলিনের পর্যায় জানতে পারলাম—ব্যাসাল ইনসুলিন, প্রানডিয়াল ইনসুলিন এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। এই তিনটের মধ্যে কোনো গন্ডগোল হলে ইনসুলিনের নিঃসরণের মাত্রা কম-বেশি হয় এবং তখনই একজন ডায়াবেটিসের পথে পা বাড়ায়। পাঠকেরা এবার সহজেই বুঝতে পারছেন, ইনসুলিনের মাত্রার তারতম্য ঘটলেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে প্যাংক্রিয়াস থেকে ইনসুলিনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পেলেই, প্রয়োজন হয়ে পড়ে ওষুধের। ওষুধ ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়িয়ে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। আবার অনক সময় শারীরবৃত্তীয় কারণে হঠাৎ গ্লুকোজের মাত্রা ৫০ এম.জি% নিচে নেমে যায়। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া। এক্ষেত্রেই মুখ্য হয়ে ওঠে রক্ত পরীক্ষাগারের ভূমিকা। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ন্যূনতম থাকা উচিত ৮০ এম.জি। যখন গ্লুকোজের পরিমাণ ২০/৩০ এম.জি-তে নেমে যায়, তখন রক্তে পরীক্ষার সেই রিপোর্টটিকেই কিছুক্ষেত্রে একটু বাড়িয়ে অর্থাৎ স্বাভাবিক মাত্রায় এনে রিপোর্ট দেওয়া হয়। এই অবস্থায় অনেক সময় রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, আবার কোমাতেও চলে যেতে পারে রোগী। রোগীর সঠিক তথ্য (২০/৩০ এম.জি) যদি জানা থাকে, তাহলে এই অবস্থায় রোগীকে তক্ষণাৎ যদি চিনি বা গ্লুকোজ অথবা মিষ্টি জাতীয় কিছু খাইয়ে দিলে রোগীর গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং খানিকটা সুস্থবোধ করবেন। মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে রোগীর প্রকৃত সুগার ভ্যালু জানা খুবই প্রয়োজন।
এবার ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। মেটাফরমিন এবং পাইয়োগ্লাইটেনোন-এরা দু’জনেই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে। অম্বল, গ্যাস, ছাড়া মেটাফরমিনের সেরকম কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। মেটাফরমিন সবসময়ই ভরা পেটে খাওয়া উচিত। কারণ এটা খেলে অম্বলের একটা প্রবণতা থেকে যায়। রক্তে ক্রিয়েটিনিন ১.৫ এম.জি%-এর ওপরে গেলে মেটাফরমিন বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এখানেও নিখুঁত রক্ত পরীক্ষার একটা ভূমিকা রয়েছে। দেখা গেল, ব্লাড ক্রিয়েটিনিন ভ্যালু ১.৫ এম.জি% বা তার বেশি, কিন্তু রিপোর্ট তার প্রতিফলন ঘটল না, সংশ্লিষ্ট ডাক্তারও মেটাফরমিন চালিয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় রোগীর কিডনি সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার কোলাইটিস জাতীয় রোগ থাকলে মেটাফরমিন দেওয়া চলবে না।
এবার আসি গ্লাইকোসাইলেটেড (HbA1C) হিমোগ্লোবিনের কথায়। প্রথমেই বুঝতে হবে সুগার টেস্ট এবং HbA1C হিমোগ্লোবিন টেস্টের মধ্যে সম্পর্কটা কী। HbA1C পরীক্ষা থেকে বিগত তিনমাসের গড়পড়তা ব্লাড সুগারের মাত্রা জানা সম্ভব। সুগার পি.পি. এবং ফাস্টিং পরীক্ষা থেকে তৎক্ষণাৎ রক্তে সুগারের পরিমাণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া। আজকের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়লেই যে, HbA1C বাড়বে এমনটা নয়। আমাদের একটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, রক্তে আৎক্ষণিক গ্লুকোজের পরিমাণের সঙ্গে HbA1C সরাসরি আনুপাতিক হারে যুক্ত। কিন্তু আদপে তা নয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আজকে একজন রোগীর ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষার রিপোর্ট স্বাভাবিক হতেই পারে, তার সঙ্গে HbA1C-এর রিপোর্ট মেলালে হবে না। কারণ HbA1C-এর রিপোর্ট হচ্ছে গত নব্বই দিনে রোগী তার গ্লুকোজের পরিমাণ কতটা আয়ত্বে রাখতে পেরেছেন, তার তথ্যসমষ্টি। এখানেও রক্ত পরীক্ষাগারগুলোর একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। পরীক্ষাগারগুলোর দু’টোকে মিলিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করার প্রবণতা রয়েছে। যেটা সম্পূর্ণ ভুল এবং তাতে রোগীর চিকিৎসা ভুলপথে পরিচালিত হয়।
পরিশেষে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ডায়াবেটিসের সেরা চিকিৎসা হচ্ছে ইনসুলিন। রোগী যদি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ডায়াবেটিসকে আয়ত্তে রাখতে সক্ষম হবেন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন