ডায়াবেটিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সফল চিকিৎসা আকুপাংচারে
ডাঃ সন্দীপ সেন গুপ্ত
2019-02-06 13:01:02
আমাদের শরীরে প্যাংক্রিয়াস নামক অঙ্গ থেকে তৈরি হয় ইনসুলিন হরমোন। এটি রক্তে গুলোকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিন হরমোনের পূর্ণ বা আপেক্ষিক ঘাটতি হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং মাত্রাতিরিক্ত হলে একসময়ে তা প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে। এটি একটি বিপাকজনিত রোগ। এই রোগের জন্য বংশ এবং পরিবেশ দুয়েরই প্রভাব থাকে। কখনও কখনও অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতা থেকেও ডায়াবেটিস হতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, খুব বেশি পিপাসা লাগে, বেশি খিদে পায়, যথেষ্ট খাওয়া সত্বেও ওজন কমে যায়। ক্লান্তিও দুর্বলতা, নানা প্রকার চর্মরোগ এবং নানারকম চোখের সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস রোগের এই লক্ষণগুলো সব সময় যে দেখা যায়, তা নয়। কখনও সখনও স্বাভাবিক ভাবে রক্ত পরীক্ষা করাতে গিয়েও ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
এছাড়া ডায়াবেটিসের ফলে বেশ কিছু জটিলতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সেগুলোর চিকিৎসা করাতে গিয়েও ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা কিন্তু আকুপাংচারের মাধ্যমে করা যায়। তবে আকুপাংচারের সাহায্যে ডায়াবেটিসের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা জটিলতার সমাধান সম্ভব।
- ডায়াবেটিসের ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। এই গ্লুকোজ প্রান্তিয় স্নায়ু বা পেরিফেরাল নার্ভকে আক্রমণ করে। এর ফলে হাতে, পায়ের তালুতে অবশ ভাব, ঝিনঝিন করা, সুঁচ ফোটার অনুভূতি হয়। কখনও কখনও হাতেপায়ে জ্বালাও হতে পারে। এই অবস্থাকে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বলে। হাতে, পায়ে বিশেষ কয়েকটি বিন্দুতে সুঁচ ফুটিয়ে মৃদু উত্তেজনা প্রদান করলে উল্লেখিত লক্ষণগুলোর ক্ষেত্রে উন্নতি লক্ষ করা যায়। আকুপাংচারের ফলে প্রদাহেরোধকারী বা অ্যান্টিইনফ্লামেটরি রাসায়নিকের মাত্রা রক্তে বৃদ্ধি পায়, যা আক্রান্ত নার্ভের প্রদাহ হ্রাস করে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির উপশমে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিসেন রোগীরা নানা সময় শরীরের বিভিন্ন অংশ নানারকম ক্ষত বা আলসারে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় দেখা যায় উপযুক্ত মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও এই আলসার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আকুপাংচার চিকিৎসায় আলসারের চারপাশে দু’-তিনটি সুঁচ ফুটিয়ে এবং হাতে-পায়ে আরো দু’-একটি বিন্দুতে সুঁচ সহযোগে মক্সার (একপ্রকার ভেষজ) তাপ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। আকুপাংচার আক্রান্ত অংশের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে দ্রুত আলসার নিরাময়ে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিসের অপর একটি ভয়ংকর জটিলতা হল ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রিন। হাতে বা পায়ে (বিশেষ করে পায়ে) রক্তে সঞ্চালনের ঘাটতির কারণে অনেক সময় গ্যাংগ্রিন বা পচন সৃষ্টি হয়। রক্ত সঞ্চালন একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে আক্রান্ত অংশ (বেশি ভাগ ক্ষেত্রে তা হাতের বা পায়ের আঙুল) পুষ্টি পায় না। ফলে ক্ষত সৃষ্টি হয়, পচে যায়। অনেক সময় অপারেশন করে আক্রান্ত আঙুল বা পায়ের পাতা বাদ দিতে হয়। আকুপাংচারের সাহায্যে এই আক্রান্ত হাত বা পা’কে অনেক সময়ই অপারেশনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রিনে অসহ্য যন্ত্রণাও হয়। আক্রান্ত হাত বা পায়ে দু’-চারটি সুঁচ ফুটিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে শরীরে মৃদুমাত্রায় ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন দেওয়া হয়। আকুপাংচারের ফলে এন্ডার্ফিন, এনকেফালিন প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ শরীরের মধ্যে ক্ষরিত হয় এবং তা যন্ত্রণা ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ক্ষত নিরাময় করতেও সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিসের রোগীরা ক্লান্তি, অবসাদ, দুর্বলতা প্রভৃতির শিকার হন খুব সহজেই। হাতে, পায়ে এবং পেটে কয়েকটি বিন্দু আছে, যেগুলোকে আকুপাংচারের ভাষায় টনিক পয়েন্ট বলা হয়, এগুলোতে মক্সা সহ সুঁচ ফোটালে ক্লান্তি, অবসাদ প্রভৃতি দূর করতে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।
- ডায়াবেটিস রোগীদের ত্বক বা চামড়া খুব সহজেই ব্যাক্টেরিয়া এবং ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে বিভিন্ন ধরনের চামড়ার রোগ, চুলকানি, র্যাশ প্রভৃতি দেখা দেয়। আকুপাংচার দ্বার এইসব সমস্যা উপশম করা সম্ভব। শরীরে বেশ কয়েকটি বিন্দুতে সুঁচ ফোটালে রক্তে নিউট্রোফিল তথা টি-লিম্ফোসাইটের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটি ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে সাহায্য করে। আকুপাংচারের ফলে ব্যাক্টেরিওলাইসিন, ওপসোনিন প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ বৃদ্ধি পায়। এগুলোও ব্যাক্টেরিয়া এবং ছত্রাক ধ্বংস করতে সাহায্য করে। ফলে চুলকানি, র্যাশ ও অন্যান্য লক্ষণ হ্রাস পায়। শেষে আকুপাংচার চিকিৎসা নিয়ে দু’-চার কথা বলতেই হচ্ছে। কারণ অনেকের কাছেই আকুপাংচার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে ধারণা খুব পরিষ্কার নয়। এই চিকিৎসায় খুব সূক্ষ্ম কয়েকটি সুঁচ শরীরের ত্বকের ওপর অবস্থিত বিন্দুতে ফোটানো হয়। সুঁচগুলো দক্ষ হাতে ফোটালে এটুকুও লাগে না। এরপর পনেরো-কুড়ি মিনিট সুঁচগুলো ওই অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়। রোগী এই অবস্থায় এতটুকুও ব্যথা বা অস্বাস্তি অনুভব করেন না। প্রসঙ্গত, প্রতিবার সুঁচ ফোটানোর আগে সুঁচগুলো এবং শরীরের ত্বক স্পিরিট দ্বারা পরিশোধিত করা হয়। সুঁচ ফোটানো ছাড়াও মক্সার চাপ, ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন, হ্যামারিং প্রভৃতি পদ্ধতিও একইসাথে যুক্ত করা হতে পারে। দশ, পনেরো বা কুড়িটি সিটিং-এর একটি কোর্স হতে পারে, যা রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ঠিক করা হয়। এই চিকিৎসায় কোনো রাসায়নিক বাইরে থেকে প্রয়োগ করা হয় না ফলে পার্শ্বপ্রক্রিয়ার ভয় থাকে না।
-
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন