শীতে নাকের অ্যালার্জি থেকে সাবধান
ডাঃ প্রসেনজিৎ কোনার
2019-02-06 13:23:13
নাকের ভেতরে যে মিউকাস মেমব্রেন থাকে যখন সেখানে প্রদাহ হয় এবং তার জন্য বিভিন্ন রকম লক্ষণ প্রকাশ পায়, সহজ কথায় আমরা সেই অবস্থাকে অ্যালার্জি বলে থাকি।
একন প্রশ্ন হল, এই অ্যালার্জি কত প্রকার হয়, কেন হয় এবং সর্বোপরি কোনগুলোকে অ্যালার্জি বলব।
এই রোগে রোগীদের সাধারণত আমরা দু’ভাগে ভাগ করে থাকি। একটা হচ্ছে সিজনাল অর্থাৎ বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে এই রোগে ভোগেন। এই সিজন বা সময়টা পার হলে আবার তার কষ্ট কমে যায়। অর্থাৎ ওই নির্দিষ্ট সময়ে পরিবেশে যে পরিবর্তন হয় সেটা সব মানুষের শরীর ঠিকভাবে নিতে পারে না। ওই সময়ে পরিবেশের কিছু অ্যালার্জেন মানুষের শরীরে প্রবেশ করার পর ওই অ্যালার্জি হয়। এর বিরুদ্ধে শরীরে রিঅ্যাকশন হয়। কারও হাঁচি, কাশি এসব হয়। কারও গা চুলকোয় এবং শরীরে চাকা চাকা হয়ে ফুলে যায়। এছাড়াও বিভিন্নভাবে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হতে পারে তবে সেটা তাপমাত্রা, বায়ুমন্ডলের দূষণ প্রভৃতি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।
আর একরকম হচ্ছে পেরিনিয়াল অর্থাৎ যারা সারা বছর ধরেই এই নাকের অ্যালার্জিতে ভোগেন।
কারণ কী কী
সাধারণত যে সব কারণে অ্যালার্জি হয়, সেগুলো হল—
- পরিবেশগত : তাপমাত্রার পরিবর্তন ও বায়ুদূষণ। এর ফলে নাকের মিউকোসা অ্যালার্জেনের প্রভাবে আরও বেশি প্রভাবিত হয়। যত বেশি ধুলোবালি ও দূষণ বাড়বে, অ্যালার্জিও তত বেশি হবে।
- বংশগত : বংশগত কিছু কিছু মানুষের এই রোগ হতে পারে, তাদের বেশির ভাগেরই পারিবারিক একটা ইতিহাস থাকে। তারা সাধারণত সারা বছর ধরেই কমবেশি হাঁচি, কাশির সমস্যায় ভোগেন।
- বিভিন্ন বয়সে শরীরে হরমোনের নানা পরিবর্তনের সময়ও কিছু কিছু মানুষের নাকের অ্যালার্জির সমস্যা হয়। যেমন পিউবার্টি প্রেগনেন্সি, মেনোপজ ইত্যাদি।
যেকোনো জিনিস থেকেই অ্যালার্জি হতে পারে তবে যেগুলো থেকে বেশি হয় সেগুলো হল ধুলো, ধোঁয়া, ফুলের রেণু, সিগারেট, ডিম, বেগুণ, চিংড়ি, প্রসাধন সামগ্রি, ওষুধ প্রভৃতি।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পেটের কৃমি থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে। তখন হাঁচি, কাশি বেশি হয়।
লক্ষণ কী কী
নাকের ভেতরের অংশ ফুলে যায়। ভেতরে ফ্লুইড জমে যায়, নাকের টার্বিনেটগুলো মোটা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পলিপও জমে যায়।
এছাড়া নাক চুলকোয়, হাঁচি হয় একসঙ্গে অনেক বার, হাঁচি থামাতেই চায় না, নাক দিয়ে সবসময় জলের মতো পড়তে থাকে। নাক বন্ধ হয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রে নাকের গন্ধ বোঝার ক্ষমতা সাময়িক ভাবে কমে যায়।
নাকের ভেতরটা ফোলা ভাব হয় এবং ফ্যাকাশে মতো দেখতে হয়। নাকে অনেক সময় পলিপ তৈরি হয়। নাকের পলিপ বড় হলে অনেক সময় নাকের গন্ধ নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। খাবারের স্বাদ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। নাকে অন্য ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
বারে বারে নাকে অ্যালার্জি হলে শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির মতো অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
যারা সারা বছর ধরে অ্যালার্জিতে ভোগেন তাদের বারে বারে সর্দি হয়,গলায় খুসখুসে কাশি লেগে থাকে, মাঝে মাঝে কান বন্ধ হয়ে যায়, শ্বাস কষ্টও হতে পারে।
নাকে বেশি অ্যালার্জি হলে চোখও চুলকোয়, চোখের পাতা ফোলাভাব হয়।
গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে, ভোকাল কর্ডে অনেক সময় অ্যালার্জিক ইডিমা হয়।
চিকিৎসা
রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা করার দরকার হয়। তবে রোগীর রোগের ইতিহাস ও রোগের লক্ষণ দেখেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসকে আমরা সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হচ্ছে শারীরিক চিকিৎসা এবং অন্যটি হচ্ছে পরিবেশের চিকিৎসা।
শারীরিক চিকিৎসা বলতে যে কারণে অ্যালার্জিটা হচ্ছে সেটা শরীরে প্রবেশ করতে যাতে না পারে তা খেয়াল রাখতে হবে। কী কারণে অ্যালার্জি হচ্ছে সেটা ধুলোবালি, খাবার, বাড়ির কোনো পোষা প্রাণী, বালিশ, বিছানা, ফুলের পরাগরেণু ইত্যাদি যে কোনো জিনিসই হতে পারে। অল্প গরম লবণ জলে নাক ধুয়ে নিতে পারলে অনেকটা আরাম পাবেন।
ওষুধ বলতে অ্যান্টি অ্যালার্জিক মেডিসিন প্রয়োজন মতো দিতে হয়। এছাড়া নাকের মধ্যে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ স্প্রে আকারে দেওয়া যেতে পারে। অনেক সময় মুখে খাওয়ানো স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দিতে হয়।
অনেক সময় পলিপ, নাকের বাঁকা সেপটাম ও বড় টার্বিনেট অপারেশন করে ঠিক করতে হয়।
আজকাল ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে এটা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ।
এবার আসি পরিবেশগত চিকিৎসার কথায়। এটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। আজকাল গাছ কাটার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। গাছের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বায়ুদূষণ যে ভাবে বেড়েছে তাতে নাকের অ্যালার্জির অসুখ ক্রমশ বাড়ছে আমাদের দেশে, বিশেষত শহরে। গাড়ির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে তাতে বায়ুদূষণও বাড়েছে। যেটা করতে হবে গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং কারখানা ও অটোমোবাইল পলিউশন কমাতে হবে এবং কারখানা ও অটোমোবাইল পলিউশন কমাতে হবে। মোট কথা অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্টের অসুখ কমাতে হলে পরিবেশ দূষণ কমাতে হবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে গাছ লাগাতে হবে ও সেগুলো যাতে বেঁচে থাকে ও বড় হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বেশি বেশি বড় গাছ লাগানো যায় সেটা দেখতে হবে। কেননা একটা বড় গাছ হাজারটা ছোট গাছের পরিপূরক হতে পারে। রাস্তায় যেখানে লাইটপোস্ট আছে তার থেকে একটু দূরে গাছ লাগাতে হবে যাতে আলো আড়াল হওয়ার অজুহাতে বারেবারে গাছগুলোকে কাটতে না হয়।
অটোমোবাইল পলিউশন কমানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির বড় বড় গাড়ি দিতে হবে এবং গাড়ির গতি যাতে ঠিক থাকে (রাস্তার জ্যাম কমাতে হবে) সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কলকারখানয় শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ কমাতে হবে। শুধু বিজ্ঞাপন দিলে হবে না, সেটাকে বাস্তবে কাজে পরিণত করে নিজেদের পরিবেশের উন্নতি করতে হবে। তবে সকলে মিলে চেষ্টা করলে অবশ্যেই হবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন