যেসব বাবা-মায়েরা এগিয়ে থাকতে চান
ডাঃ সিদ্ধার্থ গঙ্গোপাধ্যায়
2019-02-06 13:44:24
আপনাদের ছেলে-মেয়েদের উৎসাহ জোগানোর জন্য তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, গল্প বলা, একসঙ্গে খেলাধুলো করা, তাদের ভালো গুণ তুলে ধরা, এগুলো তো আছেই। এগুলো মধ্যে কোনও কোনওটার কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি। তবে এখানে একটা সম্পূর্ণ নতুন রাস্তার চলার কথা আমি বলতে চাই—আপনার সেই রাস্তায় গিয়ে সেটা করতে পারেন। মামুলি রাস্তা ছেড়ে নতুন রাস্তায় চলতে গেলে শারীরিক প্ররিশ্রম হয়তো বেশি হয়, কিন্তু মানসিক ফলটাও অনুপাতে বেশি পাওয়া যায়।
নতুন রাস্তায় চলতে গেলে আপনাদের ছেলে-মেয়েদের সামনে তুলে ধরতে হবে কিছু টাটকা খবর-কিছু সমসাময়িক চরিত্রের দৃষ্টান্ত। যার কিছু নমুনা আপনাদের দিচ্ছি। বাকিগুলো আপনাদেরই জোগাড় করতে হবে খবরের কাগজ আর পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে, টিভির নিউজ চ্যানেল দেখে, আর ইন্টারনেট ঘেঁটে। তবে এগুলো স্রেফ গল্পের ছলে পেশ করবেন। কখনোই ভুলে বলবেন না ‘এর বা এদের মতো হবার চেষ্টা কর’ বা ‘তোমার চেষ্টা করলে পারবে’। আজকালকার অল্পবয়সীরা জ্ঞান দেওয়া পছন্দ করে না—বড়দের কাছ থেকে জ্ঞান নিতে চায় না।
শ্রীলক্ষ্মী সুরেশ : শ্রীলক্ষ্মী সুরেশ একটি শিশু প্রতিভা। মাত্র আট বছর বয়সে সে তার স্কুলের জন্য একটা সুন্দর ওয়েবসাইট বানিয়ে সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এটা কিন্তু সাত বছর আগেকার ঘটনা। এখন পনেরো বছর বয়সে এই ক্লাস টেনের ছাত্রী আর একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সে তার নিজস্ব ৫০ লক্ষ টাকার একটি আই.টি সংস্থা খুলে ফেলেছে। আর সারা পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সের সি.ই.ও-দের মধ্যে প্রথম সারিতেই জায়গা পেয়ে গিয়েছে।
শ্রীলক্ষ্মী কেরলের কোজিকোড় স্কুলের ছাত্রী, আর ওর নিজস্ব ওয়েবসাইট ডিজাইন সংস্থার নাম হল Yglobes। আরও দুটি বেশি বয়সের ছাত্রী (কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ মেডিকেলের ছাত্রী) হল ওই কাজে ওর সহকারী। এবং ওই সংস্থার বোর্ডের সদস্য। ওর ওই কাজের জন্য শ্রীলক্ষ্মী ত্রিশটিরও বেশি সম্মান অর্জন করেছে। এছাড়া Association of American Webmaster-এর মেম্বারশিপ তো আছেই। শ্রীলক্ষ্মী সংস্থার ডিরেক্টররা ছাড়াও আরও কুড়িজন কর্মী যুক্ত রয়েছে।
জন টার্নার : মাত্র ১৫ বছর বয়সে একটি আমেরিকান ছেলে, জন টার্নার। যে ডাউন সিনড্রোমের রোগী, সে ১১৩ কিলোমিটার পথ হেঁটে ১৭,৬০০ ফুট ওপরে নেপালের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত মাউন্ট এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে পৌঁছে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই প্রথম একজন ডাউন সিনড্রোমের রোগীর অসাধারণ সাফল্য।
ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রশ্নবাণ : ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের মায়েদের সারা দিনে গড়ে ৩০০টার মতো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে এবং তাদের মধ্যে ৪ বছর বয়সের বাচ্চারা করে সবচেয়ে বেশি ৪০০টার মতো প্রশ্ন। আর সবচেয়ে শক্ত প্রশ্নগুলোর একটু নমুনা দিচ্ছি। ‘জল ভিজে কেন’? ‘আমাদের ছায়াগুলো কী দিয়ে তৈরি’ ?
পল্পবী সচদেব: মাত্র ২৩ বছর বয়সে দিল্লীর তরুণী পল্লবী সচদেব একাধারে চাটার্ড অ্যাকাউটেন্সি, কস্ট অ্যাকাউটেন্সি এবং কোম্পানি সেক্রেটারিশিপ—তিনটে বাঘা বাঘা প্রফেশনাল পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। হয়তো একদিক দিয়ে সে সবচেয়ে কমবয়সী যে ওই তিনটে পরীক্ষাতেই একসঙ্গে সফল হল। ওর সাফল্যের পিছনে যে কানণগুলো রয়েছে, তার মধ্যে দুটির কথা বলি। এক, আই.সি.আই.সি.আই (ICICI) ব্যাষ্কের সি.ই.ও ছন্দা কোচর হল ওর আদর্শ। দুই, ও সব বিষয় খুব ভালো করে বুঝে পড়ে পড়া তৈরি করে, না বুঝে মুখস্ত করে না। যার ফলে ওর প্রত্যেকটা বিষয়েই ফান্ডা ক্লিয়ার (funda clear)!
টেনশন কমানোর টোটকা: অল্পবয়সীদের টেনশন তো লেগেই আছে। লেখাপড়ার টেনশন, টিচার-টিউটরের ধমকের টেনশন, বন্ধু-বান্ধবের পিছনে লাগার টেনশন। এইটেনশন থেকে মুক্তি পাবার একটা টোটকা তো deep breathing---গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া, একটুক্ষণ ধরে রেখে তারপর শ্বাস নেওয়া, একটুক্ষণ ধরে রেখে তারপর শ্বাস ছাড়া। এটাকে চালিয়ে যাওয়া দশ থেকে বারো বার। এটার কথা আগে নিশ্চয়ইকোথাও বলেছি। এখানে একটা নতুন টোটকার কথা বলি।
কোনো বাচ্চা কঁকিয়ে কেঁদে উঠলে তার হৃদস্পদন বেড়ে যায়—অর্থাৎ কোনও কারণে তার টেনশন হয়েছে। কেঁদে ওঠাটা তার আত্মরক্ষার একটা উপায় অন্যের নজর কাড়ার উদ্দেশ্যে। তার হৃদস্পন্দন কমিয়ে আনলে তার কান্নাটাও থেকে যাবে। কিন্তু কী করে তার হৃদস্পন্দন কমানো যায় ? বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে দু’হাতে একটু দোলালে বা মৃদুছন্দে নাচালে তার কান্নাটা থেকে যাবে, কারণ হৃদস্পন্দনটা তখন স্বাভাবিক মাত্রায় এসে দাঁড়িয়ে গেছে। ঠিক তেমনি যে ছেলে কি মেয়ের টেনশন এসে গেছে সে যদি বসা অবস্থায় সামনে-পিছনে একটু দোলে দু’-তিন মিনিট ধরে তাহলে তার হৃদস্পন্দনটা স্বাভাকিক হয়ে গিয়ে টেনশন থেকে মুক্তি আসবে। পিছনে একটা মৃদু ছন্দের যন্ত্রসংগীত থাকলে হৃদযন্ত্র আর মগজ দুটোই ওই ছন্দটাতে কাজ করতে শুরু করবে।
যেসব ছেলে-মেয়েরা শারীরিক দিক থেকে অতটা সক্রিয় নয় এবং কোনও ব্যায়াম-ট্যায়ামের ধারেকাছে ঘেঁষে না, তাদের ক্ষেত্রে চাপ বা stress-এর প্রকোপটা খুব বেশি। ওই আরামের দাস (ইংরেজিতে যাদের couch potato বলা হয়) ছেলে-মেয়েদের মাঝে-মাঝেই চাপের রসায়ন কর্টিসোলের (cortisol) মাত্রাটা বেড়ে যায় একটু উত্তেজনা জাগানোর মতো কিছু ঘটলেই, একটা টেনশন এসে গেলেই, এদের ক্ষেত্রে ওই হৃদস্পন্দন দৃঢ় ছন্দময় করার টোটকা খুব ভালো কাজ করে।
ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আপনাদের কথাবার্তায় কি কিছু নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন আছে
আমাদের সমাজে ‘মাথা’, ‘মগজ’, ‘মন’—এই শব্দগুলোর খারাপ অর্থে ব্যবহার আমরা সকাল-দুপুর-সন্ধেবেলা আমাদের চারপাশে সবসময় শুনতে পাই। এটা আপনারা সবাই জানেন। নতুন করে আর আপনাদের কাছে আমাদের বলার কোনও প্রয়োজন বোধ হয় নেই। দু’চারটে উদাহরণ দিচ্ছি: ‘মাথায় কিছু নেই’, ‘মাথা খারাপ’, ‘কিছু মনে করা’, ‘মন কেমন করা’ ইত্যাদি।
আপনাদের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ওই একই শব্দগুলো ভালো অর্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। যেমন : ‘মাথার কাজ বেশি করে করলে মাথাটা পরিষ্কার থাকবে’, ‘মনে রাখার জন্য মুখস্ত করো না, বুছে মনে রাখার চেষ্টা করবে’, ‘বা মগজ দিয়ে চিন্তা কর, আর ডান মগজ দিয়ে জিনিসটা উপলব্ধি কর’ ইত্যাদি।
খারাপ অর্থে কোনো শব্ধ ব্যবহার করার অর্থ হল স্বভাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ কম। এই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র হল আমাদের মগজের এ.সি.সি-অ্যান্টিরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্স (ACC-Anterior Cingulatr Cortex) নামক অঞ্চল। ওই অঞ্চল একটু কমজোর থাকলে স্বভাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। একটু চেনতনাভাবে স্বভাবটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেই দু’তিন মাসের মধ্যে আপনি একটু শুভ পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন