ভিডিও গেমস কিশোর-কিশোরীদের মাথা খাচ্ছে
ডাঃ অনিল কুমার দাস
2019-02-06 15:20:28
বর্তমানে ভিডিও গেমস এক খলনায়ক তথা Hidden Killer-এর ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়ে শিশু ও অপরিণত কিশোর-কিশোরীদের সার্বিক অনিষ্ট সাধন করছে। এই হানিকার খেলা একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ জীবনের অগ্রগতি ব্যাহত করছে, অপরপক্ষে দৈহিক বিকাশে ব্যাঘাত ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহর ও শহরতলির অন্তত ৩০ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চশের অন্তত ১০ শতাংশ শিশু ও কিশোর, যাদের বয়স সাত থেকে চোদ্দ বছরের মধ্যে, সকাল ও বিকালে এই খেলার নিমগ্ন থাকে। ফলে তাদের সামাজিক আচরণ, স্নেহের বন্ধনে শিথিলতা, নৈতিকতা বা নৈতিক আচরণগুলির সবার অলক্ষ্যে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু এরা অবসর সময়ের বেশিরভাগই বা সম্পূর্ণই ভিডিও গেমসে ব্যয় করে, তাই তারা বন্ধুবিমুখ হয়ে ধীরে ধীরে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ফলে তাদের পারস্পরিক সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে বা সুদৃঢ়ভাবে গড়ে উঠছে না। আবার আত্মকেন্দ্রিকতার জন্য বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি না হওয়ায় আলোচনা বা বিতর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানলাভ করে সমৃদ্ধ হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর সেই কারণে তাদের কোনো মানসিক সমস্যা বা অন্য কোনো সামাজিক বা ব্যক্তিগত সমস্যায় বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শ বা সাহায্য পাওয়ার কোনো পথ খোলা থাকছে না। ধীরে ধীরে তারা একাকীত্বের শিকার হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই একাকীত্বের পরিণাম হচ্ছে ভয়ষ্কর। একাকীত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতে কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে। আবার কেউ কেউ মস্তিষ্কঘটিত জটিল সমস্যা নিয়ে দুঃসহ দিন কাটাচ্ছে।
তাছাড়াও, এই খেলায় যুক্ত থাকা শিশু ও কিশোরদের বিভিন্ন চোখের রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে শৈশব থেকেই অনেককেই চশমার বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অবসর সময় যারা এই খেলার মাধ্যমে অতিবাহিত করে তাদের মধ্যে বিনোদন মূলক বই তো দূরের কথা, পাঠ্যপুস্তক পাঠেও অনীহা লক্ষ্য করা যায়। শারীরিক অনুশীলন ও খেলাধুলোর মাধ্যমে যে সুস্থ ও স্বাভাবিক শরীর গঠন হয় তা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাই কেবল বৌদ্ধিক ও মানসিক পরিশ্রম হওয়ায় শিশুদের মধ্যে দৈহিক স্থূলত্বের বৃদ্ধি ঘটছে। উপরন্তু গেমস-এ বন্দুক ও গোলাগুলির ব্যবহার আখেরে শিশুদের মধ্যে অসামাজিক মানসিকতা গড়ে ওঠার বীজ পুঁতছে। তাছাড়া গতিশীল, গাড়ি ওঠার বীজ পুঁতছে। তাছাড়া গতিশীল, গাড়ি চালানোর মতো গেমসে মানসিক চাপ বৃদ্ধির কারণে শিশু ও কিশোররা অতি সহজেই ধৈর্যশক্তিহীন হয়ে পড়ছে। ফলস্বরূপ তাদের মধ্যে গঠনমূলক, সৃজনীশক্তির উন্নতি না হয়ে ক্রমাস্বয়ে অবনতি হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তারা বিকৃত মানসিকতার শিকার হয়ে সমাজে নানা অপকর্মের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে সমাজকে সমস্যা সংকুল করে তুলেছে।
যেহেতু অধিকাংশ ভিডিও গেমস ‘Pirated’, তাই এই গেমসকে কেন্দ্র করে এক অসাধুচক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তাদের শাস্তি বিধান করার জন্য আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
অপরপক্ষে, এই খেলা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিবেচনা করা যেতে পারে—
- খেলা প্রতি শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে পাড়ার ক্লাব বা সংঠনকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ ক্লাবের সদস্যরাই স্থানীয় শিশু-কিশোরদের মধ্যে মাঠের আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- স্কুল ও কলেজে খেলা আবশ্যিক করতে হবে।
- সংস্কারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্জল ও শহরঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই খেলাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
- স্কুল, কলেজ ও ক্লাবগুলিতে ভিডিও গেমসের কুফল নিয়ে অভিভাবক সহ শিশু ও কিশোরদের সতর্ক করতে হবে।
- স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালাতে হবে।
- সৃষ্টিশীল কাজে শিশু ও কিশোরদের উৎসাহিত করতে হবে।
- অভিভাকদের নিজ নিজ সন্তানদের সঙ্গে স্নেনের বন্ধন বৃদ্ধি করার নিত্যনূতন উপায় প্রয়োজনমাফিক উদ্ভাবন করতে হবে। যেমন ক্যুইজ ও অন্তক্ষরী প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি পাঠের আসর, মহাপুরুষের জন্মদিন বা মৃত্যৃদিন উদযাপন, মহাপুরুষদের জীবনীপাঠের আসর ইত্যাদিতে আগ্রহী করতে হবে। তাছাড়াও সন্তানদের জন্মদিন পালন, ভালো পরীক্ষার ফলের জন্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপহার প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
প্রসঙ্গত, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নিয়ে যদি এই খেলা রোধ করে অষ্কুরেই বিনাশ না করা যায় তবে পরবর্তীতে এই সমস্যা মহীরুহের আকার ধারণ করে সমাজকে জর্জরিত করে তুলবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন